দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে উদারনীতিবাদের প্রকৃতিগত পরিবর্তন ঘটেছে। সমষ্টিবাদী ব্যবস্থার স্বৈরাচার থেকে মানুষকে রক্ষা করার বিষয়টি সাম্প্রতিককালের উদারনীতিবাদের অন্যতম মৌল বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিককালের উদারনীতিবাদের মধ্যে বুদ্ধিবাদের বিরুদ্ধে এক স্বাভাবিক প্রবণতার প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। বিরোধিতার এই প্রবণতা সাধারণভাবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবং বিশেষভাবে রাষ্ট্রের হেগেলীয় ও সমষ্টিবাদী মতবাদসমূহের বিরুদ্ধে। অধুনা উদারনীতিবাদে বড় কথা হল ব্যক্তিকে যেকোন ধরনের স্বৈরাচার থেকে রক্ষা করা। এই স্বৈরাচার শ্রেণীগত হতে পারে, দলগত হতে পারে বা জনতার হাতে হতে পারে। কমিউনিস্ট ব্যবস্থায় শ্রেণীগত স্বৈরাচারের সৃষ্টি হয়। ফ্যাসীবাদী ব্যবস্থায় দলীয় স্বৈরাচারের সৃষ্টি হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনতার স্বৈরাচার সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এখনকার উদারনীতিবাদে ব্যক্তিকে সব রকম স্বৈরাচারের প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের এবং তার সামাজিক গোষ্ঠীসমূহের উপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এবং এইভাবে রাষ্ট্রকে গোষ্ঠীসমূহের সমবায়, সঙ্ঘসমূহের (Guilds) ইউনিয়ন, বা সম্প্রদায়সমূহের সমাহার অপেক্ষা একটু অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। রাষ্ট্রকে একটি প্রশাসনিক যন্ত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বিবদমান গোষ্ঠীসমূহের কাজকর্মকে সুবিন্যাস্ত করার ক্ষেত্রে এবং কাজকর্মকে সমন্বিত করার ব্যাপারে এই প্রশাসনিক যন্ত্রটির প্রয়োজনীয়তা প্রতিপন্ন হয়। সমসাময়িক উদারনীতিবাদে কতকগুলি বিষয়ের উপর বিশেষ মূল্যবোধ বা গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই বিষয়গুলি হল: ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের স্বাধীন অভিব্যক্তি; এই অভিব্যক্তিকে নিজেদের কাছে এবং সমাজের কাছে অর্থবহ ও মূল্যমানযুক্ত করে তোলার ব্যাপারে মানুষের সামর্থ্য; এবং সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও নীতিকে তুলে ধরা যেগুলি স্বাধীন অভিব্যক্তি ও সেই স্বাধীনতার উপর আস্থাকে রক্ষা ও বিকশিত করে।

মিলটন ফ্রিডম্যান তাঁর Capitalism and Freedom শীর্ষক গ্রন্থে সমকালীন উদারনীতিবাদের অর্থ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন এবং এ ধরনের উদারনীতিবাদকে দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করেছেন। অধ্যাপক ফ্রিডম্যানের মূল উদ্দেশ্য হল এই নীতিকে সমর্থন করা যে, রাজনীতির স্বাধীনতার সঙ্গে সমাজতন্ত্রবাদ সামঞ্জস্য-রহিত। উন্মুক্ত বাজার সমাজব্যবস্থায় আর্থনীতিক স্বাধীনতার উপর নতুন করে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে সমসাময়িক উদারনীতিবাদ। তারফলে উদারনীতিবাদ সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া থেকে স্বতন্ত্র হয়ে পড়েছে। ফ্রিডম্যানের মতানুসারে রাজনীতিক পূর্বশর্ত হল প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। সুতরাং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা এমনভাবে সংগঠিত যে, এ ধরনের ব্যবস্থায় রাজনীতিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকে না।

সমকালীন উদারনীতিবাদে মুক্ত ও স্বাধীন সমাজের প্রয়োজনীয়তার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। অর্থাৎ এর দ্বারা প্রকৃত প্রস্তাবে কমিউনিস্ট ব্যবস্থা ও সমাজের বিরোধিতার কথা বলা হয়েছে। বস্তুত সমসাময়িক উদারনীতিবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদারনীতিবাদীদের সঙ্গে এর গভীর সংযোগ-সম্পর্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদারনীতিকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় সাধারণতান্ত্রিক-রাষ্ট্রপতি শাসিত রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অনুরূপভাবে সাম্প্রতিককালের উদারনীতিবাদীরা সংসদীয় শাসনব্যবস্থার থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থার সপক্ষে মতপ্রকাশ করেন; এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের থেকে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণকে সমর্থন করেন। তবে মার্কিন উদারনীতিবাদী ধ্যান-ধারণায় সাম্প্রতিককালে এক ধরনের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের পরিচায়ক হিসাবে কতকগুলি বিষয়ের কথা বলা যায়। মার্কিন উদারনীতিকরা শাসন বিভাগীয় ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির প্রবণতায় আস্থাশীল; আইন বিভাগীয় ক্ষেত্রে সিনেটের প্রাধান্য প্রসারের প্রবণতায় আস্থাশীল; এবং বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে সুপ্রীম কোর্টের কর্তৃত্ব বৃদ্ধিতে বিশ্বাসী। তবে মার্কিন উদারনীতিক মতবাদের তথা মার্কিন রাজনীতিক ধারার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল একটি উন্মুক্ত ও বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থার আদর্শে আস্থা ও বিশ্বাস।

সাবেকি বা সাম্প্রতিক যাই হোক না কেন, উদারনীতিবাদের মূল বিষয় হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। জন লক্ থেকে শুরু করে হ্যারল্ড ল্যাস্কি অবধি উদারনীতিবাদী মতাদর্শের ধ্যান-ধারণার অগ্রগমনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয় যে, এই রাজনীতিক দর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। তবে কালক্রমে উদারনীতিবাদী ধ্যান-ধারণার অল্পবিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে বিভিন্ন গোষ্ঠীর রাষ্ট্রদার্শনিকদের হাতে। জন লকের প্রাথমিক পর্বের উদারনীতিবাদের সংস্কার সাধিত হয়েছে উপযোগবাদী বেনথাম ও তাঁর অনুগামীদের হাতে পরবর্তীকালে মিলের অভিজ্ঞতাবাদী সমষ্টিবাদের মাধ্যমে পুনরায় হিতবাদী উদারনীতিবাদের সংস্কার সাধিত হয়েছে। এর পরেও উদারনীতিবাদের পরিবর্তন ও অগ্রগমন অব্যাহত থেকে গেছে। গ্রীণের নরমপন্থী আদর্শবাদী ব্যাখ্যায় মিলের মতাদর্শেরও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আবার বার্কার ও লিওসের বহুত্ববাদী আলোচনায় পূর্ববর্তী উদারনীতিবাদী দর্শনের পরিবর্তন ঘটেছে। তারপর জি. ডি. এইচ. কোল এবং হ্যারল্ড ল্যাস্কির সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার প্রভাবও এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উদারনীতিবাদের এই ক্রমপরিবর্তনের বা বিবর্তনের ধারা এখনও অপ্রতিহত ভাবে অব্যাহত। এ প্রসঙ্গে ম্যাক্ফারসন মন্তব্য করেছেন: “The process is still going on as a result of which the Premises of liberalism may be seen. adequately revised in the philosophy of Possessive individualism’….”

বুর্জোয়া শ্রেণীর উদারনীতিক:

সাম্প্রতিককালের উদারনীতিবাদকে অনেকে বুর্জোয়া বিন্যাসের পক্ষাবলম্বী বলে মনে করেন। কারণ বর্তমানে উদারনীতিবাদে প্রত্যেকের জন্য ন্যায়বিচার বা ‘বিভাজনমূলক ন্যায়বিচার’ (distributive justice)-এর উপর নতুন করে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এর অর্থ হল ব্যক্তির জন্য আর্থনীতিক স্বাধীনতার ব্যবস্থা। এ বিষয়ে শোধনবাদী উদারনীতিবাদ নিয়ে কয়েকজন বিশিষ্ট আধুনিক রাষ্ট্রদার্শনিক আলোচনা করেছেন। এঁদের মধ্যে শ্যূমপিটার, চ্যাপম্যান, রবার্ট ডাল, জন রলস প্রমুখ চিন্তাবিদদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রদার্শনিকরা তাঁদের শোধনবাদী উদারনীতিবাদে কার্যত সাবেকি উদারনীতিক গণতান্ত্রিক মতবাদের গণতান্ত্রিক উপাদানসমূহকে অপসারিত করার লক্ষ্যে এগিয়েছেন। প্রতিনিধিমূলক ব্যবস্থার সমালোচনা ও সমর্থন উভয়ের মধ্যেই এ ধরনের উদারনীতিবাদের উপাদানের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাম-শ্যাম-যদু প্রত্যেকের উপর অকারণ ও অপ্রয়োজনীয় গুরুত্ব আরোপ করা হয়। মানুষের স্বাধীনতার সহায়ক ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিপন্ন করে প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থাকে সর্বোৎকৃষ্ট ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা হিসাবে তুলে ধরা হয়।

শ্যূমপিটার তাঁর Capitalism, Socialism and Democracy শীর্ষক গ্রন্থে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন এবং সমালোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী জনপ্রতিনিধিরা জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতির উদ্দেশ্য হল সর্বসাধারণের কল্যাণ সাধন—এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। এই ধারণা অদ্ভুত রকমের এক অর্থহীন বোকামি হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হল ব্যক্তিবর্গের দিক থেকে কেবলমাত্র এক ধরনের উদ্যোগ। এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য হল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জন। এর উপায় হল জনগণের ভোটের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এক সংগ্রাম। অধ্যাপক চ্যাপম্যান তাঁর Justice and Fairness শীর্ষক গ্রন্থে এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, ন্যায়বিচারে অসাম্যের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় শুধু তাই নয় ন্যায়বিচারে অসাম্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। কারণ বিভাজনমূলক ন্যায় বা প্রত্যেকের জন্য ন্যায়ের ক্ষেত্রে প্রথম নীতি হল সুযোগ-সুবিধার বণ্টন। ভোক্তাদের সার্বভৌমত্বের নীতি অনুসারে সুযোগ-সুবিধা সর্বাধিক হয়। রবার্ট ডালও তাঁর A Perface to Democratic Theory শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ডালের বক্তব্য ব্যাখ্যা করে জোহারী তাঁর Contemporary Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “R. Dahltreates democracy as a mechanism the essential function of which is to maintain the equilibrium so that the principle of distributive justice remains undistributed.” অধ্যাপক জন রলস্ তাঁর Distributive Justice শীর্ষক রচনায় এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, কিছু অসাম্য প্রতিষ্ঠানিকৃত (institutionalised)। প্রতিষ্ঠানিকৃত অসাম্য মানবজীবনের সম্ভাবনাসমূহকে প্রভাবিত করে। এ ধরনের অসাম্য যে কোন সমাজে অনিবার্য। আয় ও সম্পদের ভিত্তিতে সামাজিক পার্থক্য হল প্রচলিত রীতি। এই ধরনের অসাম্য ‘বিভাজক ন্যায়’ (Distributive justice)-এর বিষয়বস্তু হিসাবে বিবেচিত হয়। এইভাবে অধ্যাপক রলস্ শ্রেণী-বিভক্ত সমাজে তাঁর ন্যায়ের নীতির প্রস্তাবও সমর্থন করেছেন। এই নীতির মানদণ্ডে তিনি বিভিন্ন অধিকার ও আয়ের বিভিন্ন রকম বণ্টনের নৈতিক মূল্য বিচার করেছেন। বুর্জোয়া শ্রেণীর বিশিষ্ট উদারনীতিকরা এইভাবে উদারনীতিবাদ ব্যাখ্যা করেছেন। অধ্যাপক জোহারী এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন: “…the eminent liber als of the bourgeois class have tried to introduce, or reintroduce, a concept of man as essentially a doer, an exerter, and enjoyer of his human attributes.” পরিশেষে কোকার-এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর Some Present Day Critics of Liberalism শীর্ষক এক রচনায় এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী উদারনীতিবাদীদের কাছে অধিকার হল অলঙ্ঘনীয়। কতকগুলি মূল্যবোধের উপলব্ধির জন্য মানুষ অধিকার ভোগ করে। শুধু তাই নয়, অধিকারসমূহই হল মূল্যবোধযুক্ত। উদারনীতিবাদীর কাছে মানুষের অধিকারসমূহ হল ‘স্বাভাবিক’ বা ‘প্রাকৃতিক’। কারণ যুক্তিবোধ, ন্যায়নীতিবোধ, স্বাধীন চিন্তা ও কর্মের সামর্থ্য প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ অন্যান্য প্রাণীর থেকে আলাদা। উদারনীতিবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, শৃঙ্খলা ও সমঝোতার জন্য অকারণে অমিতব্যয়ী হতে হয়। কারণ এ ক্ষেত্রে যে সমস্ত উপায়-পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় তারফলে সহমত তালগোল পাকিয়ে যায় বা বিনষ্ট হয়। অথচ এই সহমতের উপরই গণতন্ত্রের শক্তি ও নিরাপত্তা নির্ভরশীল। কোকার বলেছেন: “He (a liberal) believes that order and agreement are goods that may be sought extravagantly, by means that confuse or destroy the sort of consensus upon which the security and strength of a democracy depend.”

সমকালীন উদারনীতিবাদের সমালোচনা

রাষ্ট্রের কার্যাবলী ও প্রকৃতি সম্পর্কিত উদারনীতিক মতবাদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিককালের সমালোচনাসমূহ বহু ও বিভিন্ন। এই সমস্ত সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন দিক বা উৎস থেকে। সংশ্লিষ্ট সমালোচনাসমূহের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতাও আছে। উদারনীতিবাদের রাজনীতিক দর্শন বিরুদ্ধবাদীদের দ্বারা যেমন সমালোচিত হয়েছে, তেমনি আবার সমর্থকদের দ্বারাও সমালোচিত হয়েছে। এ বিষয়ে অধ্যাপক জোহারী তাঁর Contemporary Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন : “The political philosophy of liberalism has been a subject of criticism at the hands of its advocates as well as its opponents, by the former on account of their polemical interpretation and by the latter on account of their indictment of the premises of individualism.”

(১) অস্পষ্টতা: উদারনীতিক মতবাদ অত্যন্ত নমনীয় (flexible) এবং এই কারণে অস্পষ্টতা দোষে দুষ্ট। রুশো, লক্ বেহাম, মিল, গ্রীন, ম্যাকাইভার, ল্যাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ এবং এমনকি অত্যাধুনিক আচরণবাদী চিন্তাবিরাও উদারনীতিবিদ হিসাবে পরিচিত। অথচ এই সমস্ত মনীষীদের চিন্তা-ভাবনা ও বক্তব্যের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বর্তমান। রাষ্ট্র ও তার ভূমিকা, নাগরিকদের আনুগত্য, স্বাধীনতা প্রভৃতি প্রশ্নে এই সমস্ত রাষ্ট্রদার্শনিকদের মধ্যে লক্ষণীয় মতপার্থক্য বর্তমান ছিল। উদারনীতিবিদদের চিন্তা-ভাবনার এই বৈচিত্র্যের কারণে উদারনীতির যথার্থ স্বরূপ অনুধাবন করা কঠিন। অধ্যাপক জোহারী এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন : “The weakest point in the principle of liberalism is contained in its being a highly flexible and fluid philosophy that may mean anything from this much to that much of liberty of the individual.”

(২) পরস্পরবিরোধী ধারণা: উদারনীতিক বক্তব্যের মধ্যে পরস্পরবিরোধী ধারণাও বর্তমান। উদারনীতিক মতবাদে একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা উভয়কেই স্বীকার করা হয়েছে। তেমনি আবার উদারনীতিক দর্শন আদর্শবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ উভয়ের দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছে। অথচ আদর্শবাদী ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দর্শন পরস্পর-বিরোধী। আবার লুথার ও ক্যালভিন সংস্কারের প্রশ্নে ভিন্ন মতাবলম্বী ছিলেন। এই সমস্ত পরস্পর-বিরোধী ধ্যান-ধারণার অস্তিত্ব হেতু উদারনীতিক দর্শন বিভ্রান্তিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

(৩) রক্ষণশীলতা: উদারনীতিক মতবাদ রক্ষণশীলতা দোষেও দুষ্ট। উদারনীতিবিদদের কেউই সমকালীন বিশ্বাস বা ঐতিহ্যকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। হস রাজনীতিক কর্তৃত্বের কেন্দ্রীভবন, অসীম রাজতন্ত্র বা রাজার স্বৈরী ক্ষমতাকে স্বীকার করেছেন। লুথার রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে অস্বীকার করেছেন।

(৪) মার্কসীয় সমালোচনা: মার্কসবাদীদের মতানুসারে উদারনীতিক মতবাদ হল বুর্জোয়া শ্রেণীর রাষ্ট্রদর্শন। এই মতবাদ বুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনীতিক ও অর্থনীতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অনুকূল। পুঁজিবাদের বিশ্বব্যাপী সংকটের সময় মুমূর্ষু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা-কে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে আধুনিককালের উদারনীতিবিদরা জন কল্যাণকর রাষ্ট্রতত্ত্বের কথা বলেছেন। মার্কসবাদীদের মতানুসারে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হল একচেটিয়া পুঁজিবাদের কার্যনির্বাহ কমিটি’ (Executive Committee of Monopoly Capitalism) মাত্র। দেশাই-এর মতে একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণী নিজেদের স্বার্থে এই ধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এ প্রসঙ্গে জোহারীর অভিমত হল: “It (liberalism) may be denounced for dealing with appearances only ruminating on the materials provided by scientific economy in search of plausible explanations of the most obstructive phenomena for the daily use of the bourgeois class.”

(৫) স্বাধীনতার নেতিবাচক ধারণা: রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব, নাগরিকদের অধিকার, স্বাধীনতা, আনুগত্য, সাম্য প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কিত ধারণাকে উদারনীতিক দর্শন সুস্পষ্ট ও সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে। উদারনীতিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণার ভিত্তিতে স্বাধীনতার অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। স্বাধীনতার এই ধারণা নিতান্তই নেতিবাচক।

(৬) সম্পত্তিবান শ্রেণীর স্বার্থের রক্ষক: উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ হল যে, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও বিশেষ শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতা করাই হল এই মতবাদের মূল উদ্দেশ্য। সমালোচকদের অভিমত অনুযায়ী বাস্তবে বাজারী সভ্যতা বা বণিকতন্ত্রের স্বার্থেই অ্যাডাম স্মিথ অবাধ বাণিজ্য ও আর্থিক স্বাধীনতার ধারণার কথা বলেছেন। জন লকের উদারনীতি সমকালীন উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছে। সমালোচকদের মতানুসারে লকের উদারবাদ হল হুইগ উদারবাদ। সম্পত্তিবান শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্যোগ এই উদারবাদে বর্তমান। অর্থাৎ উদারনীতিবাদ বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। জোহারী মন্তব্য করেছেন: “…it cannot be denied that in the main, it has been the philosophy of the well-to-do class. Most of the liberals have belonged to the bourgeois class and their arguments have subscribed to the reactionary and anti-socialist literature.”

(৭) শ্রেণীর দর্শনের প্রভাব: সমালোচকদের আরও অভিযোগ হল যে, মিল স্বাধীনতার সমর্থক হিসাবে পরিচিত। কিন্তু তিনি ঔপনিবেশিকতারও সমর্থক হিসাবে অভিযুক্ত। হিসেবী মানুষের মতই বেহামকে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের ব্যাপারে অধিকতর আন্তরিক ও উদ্যোগী দেখা যায়। গ্রীণের সমাজকল্যাণের দর্শনেও শ্রেণী-দর্শনের প্রভাব পড়েছে। হিতবাদী বেহাম ও মিলের উদারনীতিবাদ আপাত বিচারে বিপ্লবী হিসাবে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এঁদের উদারনীতিবাদ বিপ্লবের মূল ঐতিহ্যকে দুর্বল করেছে। বেন্থাম ও মিল বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে সমর্থন করার লক্ষ্যে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদী ব্যবস্থাকে সমর্থন করেছেন। ম্যাকফারসন তাঁর Democratic Theory: Essays in Retrieval শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Over the whole span of three hundred years of liberal society and thought, the deceptive lask of political theory appears to vary inversely as the limitation of bourgeois vision and directly as the extent of the apprehended threat to liberal values.”

(৮) সংশয় ও বিভ্রান্তি: পরিশেষে বলা প্রয়োজন যে, উদারনীতিক দর্শন কখনই একটি পরিণত ও পরিপক্ক তত্ত্বের জন্ম দিতে পারে নি। উদারনীতিক চিন্তা-ভাবনা সব সময়ই সংশয় ও এক ধরনের বিভ্রান্তির দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। উদারনীতিতে ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব উভয়কেই পাশাপাশি রাখা হয়েছে। কিন্তু কোনটির প্রতি সুবিচার করা হয়নি। অনেকের মতে এই তত্ত্ব নেতিবাচক, সংকীর্ণ ও প্রতিক্রিয়াশীল।

সমকালীন উদারনীতিবাদের মূল্যায়ন

উপরিউক্ত বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনায় উদারনীতিক দর্শনের গুরুত্ব ও অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। মানবতাবাদী ধ্যান-ধারণার প্রসারে উদারনীতির আবেদন সাড়া জাগিয়েছে। ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিকাশ ও বিস্তারের ক্ষেত্রেও মতবাদটির অবদান গুরুত্বপূর্ণ। মতবাদটি মধ্যযুগের অন্ধকারময় অবস্থা থেকে রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তা-ভাবনাকে মুক্ত করেছে এবং গতিশীল সমাজের পরিবর্তনশীল ভাবধারাকে ব্যক্ত করেছে। আর্নেস্ট বেরী তাঁর Modern Liberalism শীর্ষক এক রচনায় এ বিষয়ে বলেছেন: “…the principal postulates of the liberal movement individual freedom, human rights, the rule of law-are today, at least nominally the accepted common ground of all democratic forces.”

ল্যাস্কি-র অভিমত অনুসারে উদারনীতিক মতবাদ হল নতুন জগতের পরিবর্তিত চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক মতবাদ। উদারনীতিক মতবাদে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ককে পৃথকভাবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। উদারনীতিবাদের এই রাজনীতিক তাৎপর্য অনস্বীকার্য। উদারনীতিক মতবাদ মানবসমাজে বৈজ্ঞানিক ধ্যান ধারণার বিকাশ ও বিস্তারে সাহায্য করেছে। এই মতবাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি, শিক্ষার সম্প্রসারণ, প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি প্রভৃতি। মধ্যযুগে সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ক কায়েম ছিল। উদারনীতিক মতবাদ এই সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ককে হীনবল করেছে। আগে ধর্মীয় সাম্রাজ্য রোম ধর্মীয় সংস্থাসমূহের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রকেও নিয়ন্ত্রণ করত। উদারনীতিবাদ এই নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটিয়েছে।

‘সকলে সমান ও সমানাধিকার সম্পন্ন’ আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ফরাসী বিপ্লবের এই মহান আদর্শ উদারনীতিবাদের মাধ্যমে তাত্ত্বিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য লাভ করেছে। আর্থ-সামাজিক, রাজনীতিক ও ধর্মীয় অন্যায়-অবিচারের হাত থেকে অব্যাহতির উপায় মানুষ খুঁজে পেয়েছে উদারনীতিবাদের মাধ্যমে। জোহারী মন্তব্য করেছেন: “It may, however, not be denied that liberalism is the philosophy of humanism-emphasis on the worth and dignity of the individual who is free to make the best of himself. It may be described as the ‘timeless quality’ of this philosophy.”