পটুয়া ছবির স্বরূপ-ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এই কথা বলা হয়েছে।

শিল্পের দুইদিক নিয়ে শিল্প গড়ে ওঠে। ভাববস্তু আর আঙ্গিক। ‘ভাববস্তুকে’ লেখক বলেছেন ‘বলবার কথা, আর ‘আঙ্গিক’কে বলেছেন ‘বলবার ভাষা’। Form, Content নিয়ে কাব্য, শিল্প, সংগীত ও চিত্রকলা নির্মিত। এই কারণে সমালোচকগণ ‘Form’ বা আঙ্গিক, ‘Content’ বা বিষয়বস্তুর কথা বলে থাকেন বা বিশ্লেষণ করেন। বিশ্লেষণমুখে এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও এই দু’য়ের মধ্যে ঐক্য না হলে কাব্য বা শিল্প সার্থকভাবে সৃষ্টি হয় না। আঙ্গিক বলতে বোঝায় যেভাবে ছবি বা শিল্পকে অঙ্কিত বা নির্মিত করা হয়। এই নির্মাণ নির্ভর করে কয়েকটি বিধিনিয়মের ওপর। এই বিধিবৈশিষ্ট্য মান্য না করলে শিল্প সার্থক হয় না। এই কারণে অবনীন্দ্রনাথ চিত্রশিল্পকে বলেছেন ‘রূপকলা’। ‘রূপকলা’ বলতে রূপের শৈলী বা style বোঝায়। আঙ্গিকের মধ্যে এই ‘style’ প্রাধান্য পায়। ‘বলবার কথা’, বলতে বোঝায় ‘Content’ বা বিষয়বস্তু। সব শিল্পীর শিল্পে থাকে একটি বিশেষ বক্তব্য। জগৎ ও প্রকৃতি সম্পর্কে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি শিল্পের বক্তব্যকে নিয়ন্ত্রিত করে। শিল্প, সংগীত বা চিত্রকলার মধ্যে এই বাণী বা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে যার দ্বারা আমরা জীবন ও প্রকৃতি সম্বন্ধে অনেক সত্য জানতে পারি। জীবন ও প্রকৃতি সম্বন্ধে কবির অনুভূতিকে কবি শিল্পমাধ্যম দিয়ে প্রকাশ করেন। পটুয়া শিল্প আলোচনা প্রসঙ্গে লেখক এই কথা বলেছেন।

শিল্পে আঙ্গিক ও বিষয় সম্পর্কে পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা নানারকম আলোচনা করেছেন। তার মধ্যে H. Caudwell বলেছেন, “Every artist has an individual approach to life and an individual method of dealing with it. …..The greater a man’s individuality’ the more clearly he shows it in a style of his own” এই ব্যক্তিবৈশিষ্ট্য শিল্পের ‘style’ এর মধ্যে ফুটে ওঠে। শিল্পের বিষয়বস্তুর মধ্যে প্রধান ব্যাপার দেশীয় ঐতিহ্য, প্রকৃতিচেতনা বা জীবনচেতনা। পুরাণ দেশের পুরাতন কাহিনি। পটুয়া শিল্পে এই পুরাণের কাহিনি ও বিশ্বাস আছে। শিল্পসাধনার ইতিহাসে পটুয়া শিল্প এক অনিবার্য অধ্যায়। এই উক্তিটির পশ্চাতে একটি তাৎপর্য নিহিত আছে। এর মধ্যে শিল্পের সত্যকে লাভ করা যায়।

পটুয়া শিল্পের বক্তব্য বিষয় প্রকৃতির মূল কথাকে ফুটিয়ে তোলা নয়। বিশ্বপ্রকৃতির প্রতিলিপি সৃষ্টি পটুয়া শিল্পের মূল উদ্দেশ্য নয়। বিশ্বপ্রকৃতির সামান্যলক্ষণ আছে। এই সামান্যলক্ষণ মানুষের মনে আবেগ জাগায়। এই আবেগসৃষ্টি শিল্পের অবদান। এই আবেগকে অকপটভাবে প্রকাশ করাই শিল্পের উদ্দেশ্য। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, পটের ছবি একটা গাছ দেখলে মনে হয় এমনই একটা গাছ যাকে অন্য গাছের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায় না। পটুয়াশিল্পীর হাতে আঁকা গাছের সামান্য লক্ষণ আছে–এই সামান্যলক্ষণ রসিকের মনে আবেগ সৃষ্টি করে। গাছের পরিচয় আছে, অথচ গাছের বিশেষ লক্ষণগুলো নেই অর্থাৎ গ্লানি নেই। এইভাবে দেখলে প্রকৃতির সামান্যলক্ষণকে ফুটিয়ে তোলাই পটুয়াশিল্পের উদ্দেশ্য। এইভাবে বিচার করলে বোঝা যায়, পটুয়াশিল্পের বক্তব্য বিষয় কী। শিল্পের জগতে ছিল পৌরাণিক কাহিনি, চিত্র আর বিশ্বাস। ইউরোপের সংস্কৃত শিল্প একদা খ্রিস্টীয় পুরাণে বিশ্বাসের ওপর ভর করে বেঁচেছিল। এই বিশ্বাস যেই নড়ে গেল, শিল্পের ক্ষেত্রে এল অশান্তি। পটুয়া শিল্পের সৃষ্টিশীলতার পেছনে আছে পুরাণ-বিশ্বাসের ওপর নির্ভরতা। পটুয়া শিল্পের বক্তব্য বা Content হিসেবে এই কথা বলা চলে।

“এবার বলবার ভাষা নিয়ে আলোচনা করা যাক”। এখানে বলবার ভাষাকে Form’ বা treatment বলা চলে। এই treatment-কে H. Caudwell বলেছেন, “individual way of seeing an individual teachnique”। এখানে ‘style’ বা treatment পটুয়া শিল্পীদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। পটুয়া শিল্পের শিল্পীরা শিল্পকে অঙ্কিত করেছিল ঘরোয়া ভাষায়। তার মধ্যে ঘোরপ্যাঁচ নেই, বিলাসের চিহ্ন নেই, সূক্ষ্ম কারিগরি নেই। শিল্প-সমালোচকরা একে বলেছেন ‘মণ্ডনকলা’। এই “মণ্ডনকলা’’র পরিচয় ঘরোয়া শিল্পে নেই, আছে পোশাকি শিল্পে। এই রীতি-বৈশিষ্ট্যটি পটুয়াশিল্পকে সহজ ও জীবন্ত করেছে।