চলিত চিত্রকলায় শিল্পের ছবিকে লেখক দুটি দিকে বিচার করেছেন—প্রসঙ্গ ও আঙ্গিক মূল পটুয়া ছবিকে বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে বোঝা যাবে শিল্প সাধনার অনিবার্য অধ্যায় ও শিল্প সত্যের আবিষ্কৃত রূপ। পটুয়া শিল্পের মধ্য দিয়ে শিল্পীর দল তাদের কথাকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন। শিল্পের জগতে বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য হল শিল্পের প্রতিরূপ। শিল্পের সৌন্দর্য রক্ষার তাগিদে শিল্পীর বোধের প্রকাশ তার বলবার কথাতেই প্রকাশিত। বক্তব্যের পাশাপাশি আঙ্গিক ও শিল্পের জগতে এক অধ্যায় সৃষ্টি করে। ভাষার মধ্য দিয়ে শিল্পীর প্রকৃত স্বরূপকে রূপায়িত করা হয় এক রসবোধের জগতে। তাই শিল্প সাধনার প্রকৃত অঙ্গ হিসাবে লেখক যামিনী রায় শিল্পের ছবিকে দুটি দিক থেকে বিচার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এক সুন্দর ভাবসত্যে রূপান্তরিত হয়েছে।
মূল পটুয়া শিল্পের বক্তব্যে বা প্রসঙ্গে বলতে লেখক জানিয়েছেন—“নিঃসন্দেহে বিশ্বপ্রকৃতির নিখুঁত প্রতিলিপি নয়, অথচ প্রকৃতির মূল কথাটুকু দেওয়া নিশ্চয়ই।” এই ছবির উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বপ্রকৃতির লক্ষণকে নগ্নভাবে প্রকাশ করা। শিল্পের প্রসঙ্গে উল্লেখের মধ্য দিয়ে লেখক গাছের কথা বলেছেন। নির্দিষ্ট ভাবে একটা গাছকে দেখলে মনে হয় ওটা একটা গাছ, যাকে অন্য কোনও গাছের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। প্রাগৈতিহাসিক ছবির সঙ্গে পটুয়া ছবির প্রসঙ্গ অনেক ক্ষেত্রে মিল আছে, আবার তফাত ও লক্ষ্য করার মতো প্রকৃত পটুয়া ছবির আবেগ দানা বেঁধেছিল পুরাণের ওপর। প্রাগৈতিহাসিক ছবির কথা সম্পূর্ণ পুরাণ নির্ভর ছিল না। পুরাণ নির্ভরতার মধ্য দিয়ে পুরাতাত্ত্বিক বিষয়কে অবলম্বন করে চলিত চিত্রকলার জগতে প্রাচীন পটুয়ারা বিশিষ্ট দিকের সন্ধান পেয়েছিল। তাই – “যে জগৎ সামান্য লক্ষণের জগৎ।” সংহত পুরাণের মধ্য লেখক জটায়ু ও হনুমানের বাস্তব পরিচয় দিয়ে তাদের চিনতে সাহায্য করেছে। কোনো পাখি বা বানর বলে চিনতে পারলেও তাদের জন্ম পরিচয় ও ক্রিয়াকলাপ কোনোটাই ঘরলোকের নয়। তাই লেখকের সিদ্ধান্ত— “পুরাণের জগতে ঘরলোকের জগৎ নয়; সামান্য লক্ষণের জগৎ। তবু সংহত জগৎ।” পটুয়া শিল্পির দল এই জগতের মধ্য দিয়ে পুরাণের প্রয়োজনীতা বিশ্লেষণ করেছেন।
ইউরোপীয় শিল্প ভাবধারায় পৌরাণিক জগতের বিশ্বাস ও প্রয়োজনীয়তা ছিল এক বিশিষ্ট দিক। তারা খ্রিস্টের পুরাণকে বিশ্বাস করে এগিয়ে চলার সাধনায় ব্রতী হয়েছেন। কিন্তু রেখব্রান্টের পর সামাজিক অবস্থার প্রভাবে পড়ে পুরাণে বিশ্বাস তাদের কমে গেল। শিল্প জগতে সৃষ্টি হল অশান্তি। এইভাবে বিশ্বাস করার ফলে সংস্কৃত জগতে অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকল। জগত জীবনে ইউরোপীয় দিশাহারা হয়ে গতানুগতিক পট এঁকে চলল। ইউরোপীয় শান্তি ফেরাতে চেষ্টা করল শিল্পীর দল। এরপর শিল্প সাধনার মধ্যে সহজ, সরলতা ভিত্তিক বিষয় উপস্থাপনা করে শিল্পের প্লট এঁকে চলল ইউরোপীয় শিল্পীর দল। পটুয়া শিল্পের জগতে লেখক এইভাবে একের পর এক বক্তব্য দিয়ে শিল্প ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখল।
শিল্পের মধ্যে ভাষা হল প্রকৃতবঙ্গ। বক্তব্যের পাশাপাশি ভাষা ও তার প্রকৃত রূপকে প্রত্যক্ষ করে। কলকাতা শহরের আসার আগে গ্রাম্য শিল্পীর ভাষা ছিল দেশজ বা আটপৌরে কিন্তু শহরের আঙিনায় পৌঁছে শহরতলীর চাহিদা মেটাতে ভাষার মধ্যে এল কৃত্রিমতা। আটপৌরে ভাষার পরিবর্তে এল পোশাকি ভাষা। গড়ে উঠতে শুরু করল সাধুভাষার শিল্প। গ্রামের যে মানুষ প্রতিমা গড়ত শহরে এসে তার ছবি আঁকতে শুরু করল এবং তা বিক্রি করে উপার্জন করতে শুরু করল। ভাষার গাম্ভীর্য, শৌখিনতা হয়ে উঠল অতি সংস্কৃত। শহরে এসে শিল্পীর জীবনে এই অমূল পরিবর্তন অভূতপূর্ব ঘটে গেল। শিশু জীবনে অজ্ঞানে যে কথা বলে থাকে তা এই ছবির মধ্যে প্রকাশ পেল। পুরাণের আঁকা ছবির মধ্য দিয়ে শিল্পীর জীবন বিকাশ ঘটতে শুরু করলে নাগরিকতার আলোকে পৌঁছে আজ তা অনেকটাই উন্নত। ছবির মধ্যে কৃত্রিমতা থাকায় আসল সত্যকে শিল্পীরা সজ্ঞানে বলে না আর পটুয়া ছবিতে ও তা বলা হয়নি।
পটুয়া ছবির জগতে পটুয়ারা সংহত কোনো পৌরাণিক জগতের স্থিতি পেয়েছিল। প্রাগৈতিহাসিক যুগে পটুয়া ছবি লুপ্ত হতে শুরু করলে ও প্রকৃত পটুয়া ছবি শেষ হয়ে যায়নি। পোশাকি ছবিতে ভারতের চিত্রশিল্পীরা প্রমাণ করেছে শিল্পের শৌখিনতা, উন্নত কারুকার্য, ও পালিশ করার দক্ষতা, গৃহস্থ পাড়ার ছবিতে ঘরোয়া ভাষার পরিবর্তে এল পোশাকি ভাষা। ভাষা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শিল্পের জগতে এক বিকল্প ভাবধারার রূপায়ণ করেছেন লেখক যামিনী রায়।
ইতিহাস সৃষ্টির পূর্বের ছবি হল প্রাগৈতিহাসিক ছবি। ইতিহাসের আদিম যুগে মানুষ ছিল যাযাবর। তখন তাদের শিল্প ছিল, ছিল সৃষ্টির ঐকান্তিক ইচ্ছা। হাতের কাছে উন্নত জিনিসপত্র না থাকায় প্রকৃতির উপকরণকে কাজে লাগিয়ে গুহার গায়ে বা মাটির উপরে তারা তাদের মনের কামনা বাসনাকে এঁকে রাখত। তাদের বিচ্ছিন্ন শিল্পের মধ্য দিয়ে প্রকৃত শিল্প রহস্যকে তারা বাস্তবায়িত করে তুলেছিল। তাদের জীবন সংহত জগৎ ছিল না। পুরাণও ছিল না কারণ পুরাণ রচিত হয়েছে সংহত সামাজিক যুগে। কিন্তু পটুয়া শিল্পের জগৎ ছিল সংহত ও পুরাণ নির্ভর। পটুয়ারা পুরাণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তাদের স্বরূপকে অঙ্কন করতে পেরেছে। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক ছবিতে অবলম্বনের কোনো অবকাশ ছিল না, ছিল কেবল নিজস্ব দক্ষতা। তাদের মধ্যে পালিশ করা ভাষা ও পুরাণে বিশ্বাস না থাকা স্বর্তে ও পটুয়া শিল্পীদের মতো তারাও শিল্পের আসল সত্যকে আবিষ্কার করতে পেরেছিল। লেখকের মতে–এই আবিষ্কার হয়েছিল অজ্ঞানে বা অজ্ঞাতসারে।
সভ্যতার অগ্রসরতায় জীবন সমাজে নানা শৌখিনতা ও চাকচিক্যের প্রভাবে হারিয়ে গেল প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের প্রাণসত্তা। আধুনিকতার ভাবধারায় শিল্পীর দল পালিশ করার কাজে লেগে পড়ল। তারা আর পিছনে ফিরে তাকাবার অবকাশ রাখল না তাই শিল্পের আসল ভাবদৃশ্য তারা ভুলে গেল। শিল্পের সাধনা ছিল যোগসাধনার মতো। প্রাগৈতিহাসিক শিল্প ইতিহাস পূর্ব ছিল বলে পালিশ করার কাজ তারা জানতো না। পটুয়া শিল্পের ভাষা ছিল সহজ, সরল, স্বাভাবিক ও ঘরোয়া। তাই প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের সঙ্গে তার কিছুটা মিল ছিল। পুরাণের ওপর ভিত্তি করে ছবি সৃষ্টি হলে তা ভাষাগত ভঙ্গিমা জন্য প্রাগৈতিহাসিক শিল্পীর চিত্রকলার সঙ্গে বাংলার পুরানো শিল্পীরা পটের বুকে যে সব চিত্রকলা আঁকতো তা অনেকটাই একই। প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের পর বাংলার শিল্পজ্ঞাতে এই বোধ পটুয়া শিল্প হতে এসেছিল। শিল্পের এই ভাবসত্যকে তারা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রাণবন্ত করে তুলেছিল।
আধুনিকতার আঙিনায় দাঁড়িয়ে আসল ভাবসত্যের মূল রহস্যকে উদ্ঘাটন করতে পটুয়া শিল্পীর মনে প্রাণের সন্ধান দিয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক ছবি। আদিমতা অবলম্বন করে তার ওপর পালিশের তুলি বুলিয়ে উন্নত সমাজের সামঞ্জস্য রক্ষার তাগিদে আধুনিক শিল্পীর দল পৌঁছে গেল উন্নত জগতে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের আটপৌরে ভাষার মধ্যে এল পোশাকি ভাষা বা সাধুভাষা। এই ভাষার জগতে দাঁড়িয়ে বোঝা যায় প্রাগৈতিহাসিক ছবির মধ্যে ছিল খাপছাড়া ভাবধারা কিন্তু সেই ভাবধারা বদলে ভাষায় এল নতুন দীপ্তি। শিল্প সাধনার দীর্ঘ ইতিহাসে পুরাণের ভিত্তি ছাড়া কখনও সংহত শিল্প প্রত্যাশা করা যায় না। চলিত চিত্রকলার ছবির মধ্যে বক্তব্য ও আঙ্গিক গঠনে প্রাগৈতিহাসিক ছবি ও পটুয়া ছবির প্রভেদ লক্ষণীয়। সংহত ও খাপছাড়া সত্যকে প্রণিধান করলে শিল্প সত্যকে প্রকৃত জানা যায়। তাই বলা যায় অন্যান্য দেশের প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের সঙ্গে পটুয়া শিল্পের প্রভেদ লেখক যামিনী রায় তার দক্ষতার সঙ্গে সুনিপুণ রূপ দিয়েছে।
Leave a comment