স্বাধীনােত্তর ভারতে 1960-এর দশকে কৃষিক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে ফসল উৎপাদনে যে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে, তাকে সবুজ বিপ্লব আখ্যা দেওয়া হয়েছে। শস্যের রং সবুজ বলে সবুজ বিপ্লব শব্দটি জনপ্রিয় হয়।
দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (1956-1961) ফোর্ড ফাউন্ডেশন-এর একদল বিজ্ঞানী ‘India’s Food Crisis and Steps to Meet It’ নামে যে রিপোের্ট জমা দেন তার ভিত্তিতে 1960 খ্রিস্টাব্দে অন্ধ্রপ্রদেশের পশ্চিম গােদাবরী, বিহারের শাহাবাদ, ছত্তিশগড়ের রায়পুর, তামিলনাড়ুর থাঞ্জাভূর, পাঞ্জাবের লুধিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের আলিগড় এবং রাজস্থানের পালি জেলায় নিবিড় কৃষি উন্নয়ন কর্মসূচি (Intensive Agricultural Development Programme or IADP)-র কাজ শুরু হয়। এই কর্মসূচিটিই পরে উচ্চফলনশীল বীজ কর্মসূচি (High-yielding Varieties Programme or HYVP) নামে পরিচিত হয়। কৃষির দ্রুত ও বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনমুখী এই কর্মসূচি পরবর্তীকালে সবুজ বিপ্লব বা Green Revolution নাম ধারণ করে।
সবুজ বিপ্লবের সার্থক রূপায়ণের জন্য যে পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা হয়েছে তাদেরকে প্রধান ও অপ্রধান এই দুই ভা ভাগ করে আলােচনা করা যেতে পারে।
প্রধান পদক্ষেপগুলি হল
-
উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার।
-
জলসেচ ব্যবস্থার প্রসার।
-
পর্যাপ্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার।
-
উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার।
অপ্রধান পদক্ষেপগুলি হল
-
ভূমি সংস্কারের সম্প্রসারণ।
-
পাট্টা ও তহবিল প্রদান।
-
ঋণ প্রদান।
-
গ্রামীণ বৈদ্যুতিকরণ।
-
গ্রামীণ রাস্তা ও বাজারিকরণ।
-
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণার সম্প্রসারণ ইত্যাদি।
প্রখ্যাত কৃষিবিজ্ঞানী নরম্যান বােরলগ (Norman Borlaug) ও তার সহযােগীদের প্রচেষ্টায় উদ্ভাবিত এক বিশেষ জাতের সংকর বীজ গম উৎপাদনে অভূতপূর্ব সাফল্যলাভ করে। লারমা রােজো -644 (Lerma Rojo-644), সােনারা-64 (Sonara-64), কল্যাণ সােনা (Kalyan Sona) প্রভৃতি উচ্চফলনশীল গমের বীজ এবং আই আর-৪ (IR-8), জয়া (Jaya), পদ্মা (Padma) প্রভৃতি ধানের বীজ কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
উৎপাদন বৃদ্ধি : সবুজ বিপ্লব ভারতে ধান ও গমের উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করে। 1960-61 খ্রিস্টাব্দ থেকে 2011-12 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চাল উৎপাদনের পরিমাণ 3.46 কোটি টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় 15.26 কোটি টনে পৌছায়। একই সময়ে গম উৎপাদনের পরিমাণ 1.1 কোটি টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে প্রায় 9.49 কোটি টন। এই সময়ের মধ্যে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ৪.2 কোটি টন থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে 25.74 কোটি টনে। বস্তুত গম উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লবের প্রভাব সবচেয়ে বেশি বলে, অনেকে সবুজ বিপ্লবকে গম বিপ্লব আখ্যা দিয়েছেন।
খাদ্য সমস্যার সমাধান : স্বাধীনতার পরে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে বহু শরণার্থীর আগমনের ফলে ভারতে যে চরম খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল। সবুজ বিপ্লব এই খাদ্য সমস্যার কিছুটা সমাধান করতে সমর্থ হয়।
কৃষকের সমৃদ্ধি : জমিতে উৎপাদন বাড়ায় কৃষকদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটে।
শিল্পের বিকাশ : সবুজ বিপ্লবের ফলে কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষিনির্ভর শিল্পগুলির বিকাশ দ্রুত হয়।
গ্রামীণ কর্মসংস্থান : বহু-ফসলি কৃষিব্যবস্থার প্রচলন হওয়ায় গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযােগ বৃদ্ধি পায়।
কৃষিতে অগ্রগতির ক্ষেত্রে আঞ্লিক বৈষম্য : সবুজ বিপ্লবের ফলে কৃষিক্ষেত্রে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে যতটা সুফল পাওয়া গেছে, অসম, রাজস্থান, কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার প্রভৃতি রাজ্যে ততটা অগ্রগতি ঘটেনি। ফলে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন, কৃষি থেকে আয়, এমনকি কৃষিকাজের জন্য পরিকাঠামাের উন্নতি সবক্ষেত্রেই আঞ্চলিক বৈষম্য দেখা দিয়েছে।
আংশিক সাফল্য : সবুজ বিপ্লবের প্রভাবে খাদ্যশস্যের মধ্যে গমের উৎপাদন যতটা বৃদ্ধি পেয়েছে জোয়ার, বাজরা প্রভৃতি ক্ষুদ্র দানাশস্যজাতীয় খাদ্যশস্যের উৎপাদন ততটা বাড়েনি। ফলে সবুজ বিপ্লব সম্পূর্ণ সাফল্য লাভ করেনি।
আয়ের বৈষম্য : পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাংশে সবুজ বিপ্লবের সাফল্যের দরুন ওই এলাকার কৃষকদের আর্থিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু দেশের সর্বত্র ওই একই হারে কৃষকদের আয় বাড়েনি। বিশেষত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা তাদের জমিতে চাষের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি, উন্নত জলসেচ ব্যবস্থা, ভালাে জাতের বীজ ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে পারেননি বলে তারা কৃষি পণ্যের উৎপাদনও বাড়াতে পারেননি। ফলে, তাদের আয় ধনী চাষিদের তুলনায় সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। এই কারণে সবুজ বিপ্লব ধনতান্ত্রিক চাষ-ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে বলে অনেকে সমালােচনা করেন। বস্তুত সবুজ বিপ্লবের প্রভাবে ধনী চাষি আরও ধনী হলেও প্রান্তিক চাষিরা এই বিপ্লবের সুবিধা গ্রহণ করতে পারেননি।
অনিশ্চিত কর্মসংস্থান : কৃষিক্ষেত্রে যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রমিকের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। ফলে কৃষির সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের কাজের সুযােগ হ্রাস পেয়েছে।
পরিবেশের ওপর প্রভাব : অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও ভৌমজলের ব্যবহার মৃত্তিকা দূষণ ঘটাচ্ছে এবং পরিবেশের গুণগত মানের ক্ষতিসাধন করছে।
উপরিউক্ত অসুবিধাগুলির জন্য অনেকেই সবুজ বিপ্লবকে ‘ধূসর বিপ্লব’ আখ্যা দিয়ে থাকেন। তবে একথা কখনােই অস্বীকার করা যাবে না যে, সবুজ বিপ্লবের কারণেই ভারত খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে এবং বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়েছে।
Leave a comment