চর্যাপদ থেকে শাক্ত পদাবলী পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হিন্দু ধর্মের নানা শাখা প্রশাখার প্রভাবে প্রস্ফুটিত। তুর্কি আক্রমণে বাংলার রাজনৈতিক ও সমাজনৈতিক চেহারা কিছুটা পালটে যায়। মুসলিম সম্প্রদায়ের অত্যাচার এবং জবরদস্তি ধারা বাংলার হিন্দু ধর্মের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ধর্মান্তরীকরণ করে। ফলে ধর্মে মুসলমান হলেও মর্মে তাঁরা হিন্দু সংস্কৃতি থেকে একেবারে বিমুক্ত হতে পারেননি। বিশেষ করে লেখক ও কবিরা অনেক বেশি উদার ও সংস্কার মুক্ত মনের অধিকারী হন। বাংলাদেশে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, বেদ, উপনিষদ, কথা-সরিৎসাগর, বেতাল পঞ্চবিংশতি এবং ভারতের নানা বীরের গৌরব কাহিনি ও সতী নারীর মাহাত্ম্য প্রচারিত হয়েছিল। ফলে হিন্দু মুসলমান যে কোন কবি হোন না কেন তাঁর পক্ষে এর বাইরে যাওয়া খুব কষ্টকর ছিল। বিশেষ করে মুসলমান কবিদের আরবী সাহিত্যের কিছু দৃষ্টান্ত বা মুসলিম প্রণয় গীতিগাথা মানবিক আবেগ ও প্রেমে ভরপুর হয়ে তাঁদের কবিত্ব শক্তিকে জাগ্রত করেছে। তাঁদের কবিত্ব শক্তিতে হিন্দু ধর্ম ও মুসলিম ধর্মে খুব কাছাকাছি এসেছিল। সেইজন্য সপ্তদশ শতাব্দীতে বেশ কয়েকজন মুসলিম কবি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। এঁদের মধ্যে সৈয়দ আলাওল ও দৌলত কাজী সর্বজন পরিচিত।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সৈয়দ আলাওলের সাহিত্যকৃতি স্থান

সৈয়দ আলাওল মধ্যযুগের মুসলমান কবিদের অন্যতম। আলাওল বিচিত্র বিষয়ের সম্ভারে কাব্য রচনা করে তাঁর প্রতিভার ব্যাপকতর পরিচয় দিয়েছেন। তিনি দৌলত কাজীর মতো নিজের জীবন সম্বন্ধে নীরব থাকেননি। বরং তাঁর বিচিত্র জীবনের সব খবর আমাদের জানিয়েছেন। সেকেন্দার নামা ও সৈফুলমুলুকে এর বিস্তৃত পরিচয় আছে। এতে জানা যায় ভাগ্যের বিপর্যয়ে পিতৃহীন কবি জীবিকার জন্য মগরাজের সৈন্যবাহিনীতে চাকরী নিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে আরাকানের অভিজাত মুসলমান সমাজে তাঁর কবিত্ব শক্তি ও সঙ্গীত গুণ প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর আরাকানের মুসলমান শাসকদের অনুপ্রেরণায় আরবি, ফার্সী ও হিন্দি কাব্য অনুসরণে আলাওল বাংলা কাব্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর আত্মজীবনীতে বর্ণিত আছে যে তাঁকে বিনা দোষে আরাকানের কারাগারে বন্দি রেখে অসহ্য যন্ত্রণা আর অপমান সহ্য করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কারাগার থেকে মুক্তির পর তিনি আরাকানের প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুর, অর্থমন্ত্রী সুলেমান, পণ্ডিত সৈয়দ মুসা, সৈয়দ মুসুদ ও আরাকান রাজ সুধর্মার নির্দেশে অনেকগুলি কাব্য অনুবাদ করেন। আলাওলের মৌলিক কাব্য নেই বললেই হয়। একমাত্র দৌলত কাজীর লোর চন্দ্রানীর অসমাপ্ত কাব্যাংশ সমাপ্ত করা ছাড়া আর কোন স্বাধীন রচনা এই কবি করেননি।

সৈয়দ আলাওলের রচনা সমূহ

মুসলমান সমাজে আলাওলের অত্যধিক জনপ্রিয়তার কারণ তিনি ইসলামী কাহিনির অনুবাদ করেছিলেন। যেমন— সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জমাল (১৭৫৮ ৭০) হপ্ত বা সপ্ত পয়কর (১৬০০) তোহফা (১৬৬৩-৬৯) সেকেন্দার নামা (১৬৭২)। বলা বাহুল্য এ জাতীয় গ্রন্থ হিন্দু সমাজে মোটেই প্রসার লাভ করেনি। কিন্তু তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পদ্মাবতী’ (১৬৪৬) হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাংলার পাঠক সমাজে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বস্তত পদ্মাবতীর কাহিনিটি হিন্দি কবি মহম্মদ জায়সীর পুদমাবৎ কাব্য থেকে অনূদিত। চিতোরের রানী পদ্মিনী ও সুলতান আলাউদ্দিন সম্বন্ধে প্রচুর গর্ কাহিনি রাজস্থানে প্রচলিত ছিল। চিতোর-রাজ রত্ন সেনের রানী পদ্মাবতীর অসাধারণ রূপ ও লাবণ্যের খ্যাতিতে মোহগ্রস্ত হয়ে দিল্লীর পাঠান সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী চিতোর আক্রমণ করে। প্রচণ্ড যুদ্ধে রত্নসেন ও তার অনুগামীরা প্রাণ দেন ও পদ্মাবতী সখীদের সঙ্গে জহরব্রত অবলম্বন করে অগ্নিশিখায় আত্মবিসর্জন দেন। এই অসাধারণ সতীধর্মের মাহাত্ম্য সারা উত্তর ও পূর্বভারতে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

এই কাব্যে ইতিহাসের তথ্যের চেয়ে কল্পনার প্রাধান্য অধিক। জায়সী যে রূপক কল্পনার সাহায্য নিয়েছিলেন আলাওল তা বর্জন করে এটিকে প্রকৃত রোমান্টিক ঐতিহাসিক কাব্য হিসাবে শিল্পিত করেছিলেন। কোন ধর্মীয় প্রভাব এতে নেই, যদিও সূদূর রাজস্থানের প্রভাব লক্ষণীয়। এ কাব্যের একটি ধর্ম নিরপেক্ষ লৌকিক আবেদন আছে। নায়ক নায়িকা নামে মাত্র রাজা রানী, কিন্তু এ কাব্যে সর্বত্রই মাটির মানুষের কথা বাত্ময় হয়ে উঠেছে। কবি আলাওল ছিলেন বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত। এই গ্রন্থে বাংলার সঙ্গে বর্মী-আরবী-ফারসী সংস্কৃতের মিশ্রণ ঘটেছে। পুরাণ শাস্ত্রাদির উপর কবির গভীর পাণ্ডিত্যের ছাপ আছে। হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে মুসলিম সংস্কৃতির একটি সুন্দর মিলন আছে। প্রেমকে কবি এই কাব্যে মূলীভূত শক্তি হিসাবে দেখেছেন। প্রেমের পরিস্ফুটনের সঙ্গে কবির কাব্য, পাণ্ডিত্য, মনীষা ও ধী শক্তির পরিচয় মেলে। কাব্যের গঠনে পয়ার ও ত্রিপদীছন্দ বেশ নিখুঁতভাবে রক্ষিত হয়েছে। অনেকের মতে এ কাব্য দৌলত কাজীর মতো উৎকৃষ্ট হয়ে উঠেনি। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে মধ্য যুগীয় বাংলা সাহিত্যের এটি একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

‘পদ্মাবতী’ কাহিনি ও কাব্যগুণের জন্যে হিন্দু মুসলমান উভয় সমাজে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁর অন্য কয়েকটি রচনা কেবলমাত্র মুসলমান সমাজে সীমাবদ্ধ ছিল। তাঁর সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জমাল ইসলামী রোমান্টিক কাহিনি অবলম্বন রচিত। কাব্যটির সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের মর্মান্তিক কাহিনি বিজড়িত, নায়ক সয়ফুলমুলুক ও নায়িকা বদিউজ্জুমালের প্রেম কাহিনি এই কাব্যের মূল বিষয়। অনেকে মনে করেন এ প্রেমের উৎস আরব্য উপন্যাসের (আলিফ লায়লা) বা ফারসী প্রেমের গল্প। মানবিকতার জন্য এ কাব্য মুসলমান সমাজে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এখানেও আলাওলের সহজাত পাণ্ডিত্য এবং কবিত্ব শক্তি লক্ষণীয়। হপ্ত বা সপ্ত পয়করকাব্যে আরবের রাজকুমার রাহরমের যুদ্ধজয় ও সপ্ত পত্নী লাভ নিয়ে আরব্য উপন্যাসের ঢঙে গল্প বর্ণিত হয়েছে। “তোহফা ঃ ঠিক কাব্য বলতে যা বোঝায় তা নয়, এটি ইসলামী শাস্ত্র সংহিতার উপদেশ-পূর্ণ নীতি গ্রন্থ। এরও মূলে আছে ‘শেখ মুসুফের তুহ ফান্নসা’ নামে একটি ফারসী নীতি কাব্য। তাঁর শেষ কাব্য ‘সেকেন্দার নামা’ : ফারসী কবি ‘নেজামী সমর কন্দির’ কাব্য ‘ইসকান্দার নামার’ সরল অনুবাদ। আলেকজান্দারের বিজয় কাহিনিকে এতে অনেকটা মুসলমানী ঢঙে সাজানো হয়েছে। নানা যুদ্ধ বিগ্রহ রূপকথা ও গাল গল্পের সমাবেশে এটি রচিত। এখানে অলংকার সুষম গুরুগম্ভীর ভাষায় বর্ণিত। এছাড়া আলাওল বহু বৈক্ষ্ণব পদ রচনা করেছিলেন। ইসলামী সংস্কৃতের সঙ্গে এই রাধা কৃষ্ণের পদাবলী রচনা করে তাঁর প্রতিভার বিচিত্র শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনিও বৈব ভাবাপন্ন মুসলমান কবিদের অন্যতম। হিন্দুদের গুরুবাদ সম্পর্কে তিনি বলেছেন : ঈশ্বর সেবার এই মূল দৃঢ়ভাবী। ভাবস্থির চাহ যদি গুরপদসের।। মুসলমান কবি হয়েও এটাই হল তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দৌলত কাজীর সাহিত্যকৃতি স্থান

মাত্র একখানি অসমাপ্ত কাব্য রচনা করে দৌলত কাজী বাংলা কাব্য সাহিত্যে এক স্থায়ী আসন দখল করেছেন। কবির এ কীর্তি সমুজ্জ্বল। কাব্যটির পূর্ণ নাম “সতীময়না ও লোরচন্দ্রনী।” দৌলত কাজী চট্টগ্রামের রাউজাম থানার অন্তর্গত সুলতান গ্রামের কাজী বংশে জন্মগ্রহণ করেন। কবি অল্প বয়সেই অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হন। আরাকান রাজ শ্রী সুধর্মার সমর সচিব ছিলেন আসরফ খাঁ। তাঁর স্নেহ পুষ্ট হয়ে তাঁরই প্রেরণায় দৌলত কাজী সতীময়না কাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু কাব্য অর্ধ সমাপ্ত অবস্থায় তিনি আকস্মিক পরলোক গমন করেন।

এ কাব্যের কাহিনি কবির মৌলিক নয়। ‘ঠেট গহরী’ হিন্দি ভাষার চৌপদী ও দোহার ছন্দে বিরচিত ‘মিয়াসাধন’ নামক কোন হিন্দি কবির সতী ময়নার কাহিনি শুনে আসরফ খান দৌলত কাজীকে দেশীয় ভাষায় রূপ দিতে অনুরোধ করেন। কাব্যটি অসম্পূর্ণ হলেও আরাকানের মুসলিম কবিদের মধ্যে তিনি একজন শক্তিশালী কবি। মূল কাহিনিতে দেব নির্ভর মানবতার সুরটি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে—

“নিরঞ্জন সৃষ্টি নর অমূল্য রতন। 

ত্রিভুবনে নাহি কেহ তাহার সমান।। 

নর বিনে চিন নাহি কি ভার কোবাম।

নর সে পরম দেব তন্ত্র মন্ত্রে স্মরণ।।”

নর যে পরম দেব নর যে ঈশ্বর।

নর বিনে ভেদ নাহি ঠাকুর কিঙ্কর।।”

আলাওল দৌলত কাজী অপেক্ষা অধিকতর পণ্ডিত ব্যক্তি, কিন্তু অনুভবের গভীরতায় দৌলত ঊর্ধ্বে। আলাওল যেখানে কাব্যের শেষে বাক্য জাল বিস্তার করে কাব্যের স্বতঃস্ফূর্ত গতিকে শিথিল করে দিয়েছেন দৌলত যেখানে অনুভূতির গভীরতায় সহজ মর্মস্পর্শী বাক্য বিন্যাসে সমগ্র কাব্যখানিকে করে তুলেছেন নাটকীয় সংঘাতে দ্বন্দ্ব সঙ্কুল। তাছাড়া টুকরো টুকরো বর্ণনার মাধ্যমে একটি অখণ্ড চিত্রকে পাঠক চিত্তে সঞ্চারিত করে দেবার দুর্লভ ক্ষমতা ছিল দৌলত কাজীর। এর সঙ্গে মিশেছিল প্রকাশ ভঙ্গীর ঋজুতা। তাছাড়া ব্রজবুলি ভাষার ব্যবহারে কাজী কবি মুনসীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। বৈষ্ণব পদাবলীর বাইরেও ব্রজবুলির এমন সার্থক প্রয়োগ এবং প্রতিষ্ঠা হতে পারে তা তাঁর অসামান্য প্রতিভা দিয়ে প্রমাণ করেছেন। এই সব দিক দিয়ে আলাওলকে দৌলত কাজীর নিকট দীন বলে মনে হবে। আসলে শ্রেষ্ঠ বৈশ্বব কবিদের কাব্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয় গভীর হওয়ার ফলে শ্রাবণের অবিরল বারি ধারার মতো নায়িকার হৃদয়ের বেদনার্তিকে অভিনব করে তোলার একটি মস্ত সুযোগ তাঁর এসেছিল। সেদিক দিয়ে দৌলত কাজী পুরোপুরি সার্থক।