অথবা, সনাতন বা আনুষ্ঠানিক মতবাদ কি? সনাতন মতবাদের স্তম্ভ ও সীমাবদ্ধতাসমূহ লিখ।
ভূমিকাঃ যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রশাসনিক সংগঠন সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ গড়ে উঠেছে। এ সকল মতবাদের মধ্যে ক্রীড়া মতবাদ (Game Theory), সিদ্ধান্ত মতবাদ (Decision Theory), তথ্য মতবাদ (Information Theory), যোগাযোগ মতবাদ (Communica-tion Theory), কাঠামোগত মতবাদ (Structural Theory),গাণিতিক মতবাদ (Mathematical Theory), গোষ্ঠী মতবাদ (Group Theory), প্রেষণা মতবাদ (Motivational Theory), আচরণগত মতবাদ (Behavioural Theory) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এ সকল মতবাদের মধ্যে কোনটাই সম্পূর্ণরূপে সন্তোষজনক এবং সঠিক নয়। এদের ব্যাখ্যা হতে এ ধারণায় উপনীত হওয়া যায় যে, সংগঠনে মূলত তিনটি ভিন্ন অথচ পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ মতবাদ বিদ্যমান। যথা ঃ সনাতন বা আনুষ্ঠানিক মতবাদ (Classical or Formal Theory), নয়া সনাতন বা অনানুষ্ঠানিক মতবাদ (Neo-classical or Informal Theory) এবং আধুনিক মতবাদ (Modern Theory)।
সনাতন বা আনুষ্ঠানিক মতবাদ (Classical or Formal Theory): ক্লাসিক্যাল বা সনাতন মতবাদ হলো সম্পূর্ণরূপে আনুষ্ঠানিক মতবাদ। এরূপ আনুষ্ঠানিক মতবাদে সংগঠন কোন মানবিক সম্পর্কের উপর বা মানবতাবাদী মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। সনাতন মতবাদ অনুসারে সংগঠন হলো এক প্রকার আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা কাঠামো, যা কতকগুলো সুস্পষ্ট নীতি বা সূত্রের মাধ্যমে গড়ে তোলা যায়৷ এ মতবাদে সংগঠন হলো এক প্রকার ঘোষিত আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক যা সরকার পদ্ধতির মধ্যে আইন এবং ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। কর্মসম্পাদনের প্রকৃতি ও পরিধি হলো, সংগঠনের ভিত্তি এবং এর উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তি ও সম্পদের যথার্থ ব্যবহার। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত একপ্রকার পদক্রমিক সংগঠনই হলো সনাতন বা আনুষ্ঠানিক সংগঠনের মূল বৈশিষ্ট্য।
সংক্ষেপে বলা যায়, সনাতন মতবাদ আনুষ্ঠানিক সংগঠনের কেবল কাঠামোগত দিক নিয়ে আলোচনা করে। সনাতন মতবাদের জন্ম ও উৎপত্তি সম্পর্কে ফ্রেডারিক ডব্লিউ, টেলরের কার্যগত তত্ত্বাবধান এবং পরিকল্পনার বিষয়টি আলোচনা করা যেতে পারে। অবশ্য অনেকে মনে করেন ১৯৩১ সালে মুনী ও রেইলী ( Mooney and Railey) তাদের গ্রন্থ ‘Onword Industry’ তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংগঠন সম্পর্কে সর্বপ্রথম সুবিন্যস্ত ও ব্যাপক আলোচনা এবং সর্বজনীন নীতির বিষয়টি উপস্থাপন করেন।
এল. ডি. হোয়াইট (L. D. White)-এর ভাষায়, “Organization is a formally declared pattern of relationships established in government by law and by top management. It is based on the nature and volume of work to be done and is dictated by the requirements of efficiency in the sense of securing the most effective use of men and materials and by the need for responsibility. The organization is established and supported by authority and can be set out, although imperfectly, on a chart of the diagram. It is normally the dominant set work relationship.”
অর্থাৎ সংগঠন হচ্ছে আইন ও সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের দ্বারা সরকারের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এক ধরনের আনুষ্ঠানিক ঘোষিত সম্পর্ক। সম্পাদনীয় কাজের প্রকৃতি ও পরিমাণের ভিত্তিতে এ সম্পর্ক গড়ে তোলা হয় এবং কার্যদক্ষতার (যার অর্থ হলো মানুষ ও বস্তুসমূহকে সর্বাপেক্ষা কার্যকরভাবে ব্যবহার করা) প্রয়োজন ও দায়িত্বশীলতার প্রয়োজন অনুযায়ী এ সম্পর্ক নির্দেশিত হয়। এ সংগঠন কর্তৃত্বের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও সমর্থিত হয় এবং তা যথাযথভাবে না হলেও— কোন চার্ট বা রেখাচিত্রে অংকন করা যেতে পারে। এটি সাধারণত সর্বপ্রধান কার্য সম্পর্ক। [L. D. White, Introduction to the Study of Public Administration, p. 26.]
এডউইন ও স্টেন (Edwin O. Stene) সনাতন সংগঠনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, “আনুষ্ঠানিক সংগঠন হচ্ছে এমন কতকগুলো ব্যক্তিবর্গের সমষ্টি যারা সুসংগঠিতভাবে এবং সচেতনভাবে নিজেদের ব্যক্তিগত কর্ম প্রচেষ্টাকে একটি সাধারণ কর্মসম্পাদনে একত্রিত করে।” (Formal organization is a number of persons who systematically and consciously combine their individual efforts for the accomplishment of a common task.) [Edwin O. Stene, An Approach to a Science of Administration.]
অবশ্য আনুষ্ঠানিক সংগঠনের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের আলোচনাকে ম্যাক্স ওয়েবার (Max Waber) গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলে মনে করেন। ওয়েবার প্রদত্ত আনুষ্ঠানিক সংগঠনের ব্যাখ্যা প্রশাসনিক সংগঠনের পদক্রম নীতি অনুসারে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বণ্টন নিশ্চিত করে। সনাতন পদ্ধতির মতবাদী লেখকগণের মতামত পর্যালোচনায় দেখা যায়, সনাতন সংগঠন হলো অত্যন্ত সহজ ও সাদাসিধা পদ্ধতির প্রশাসনিক ব্যবস্থা। এরূপ সাংগঠনিক কাঠামোতে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা সরাসরি উপর থেকে নিচে প্রবাহিত হয়। সংগঠনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ের মাঝামাঝি স্তরে আরও কয়েকটি স্তর বিদ্যমান থাকে।
ট্যালকট পারসন্স (Tolcott Parsons) তার ‘Structure and Process in Modern Societies’ গ্রন্থে আনুষ্ঠানিক সংগঠনের ভিন্নধর্মী একটি ধারণা ব্যক্ত করেছেন। তিনি আনুষ্ঠানিক সংগঠনকে আধুনিক সমাজে গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য অর্জনের স্বার্থে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব যোগান দেয়ার একটি প্রধান উপায় বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
চেস্টার আই বার্নার্ড (Chester I. Barnard) সনাতন সংগঠনের বর্ণনা দিতে গিয়ে এর তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেন। এ বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে (ক) কাজ করার ইচ্ছা (Willingness to Serve), (খ) সাধারণ উদ্দেশ্য (Common Purpose) এবং (গ) যোগাযোগ (Communication between persons)। [C. I. Barnard, The Functions of the Executive, pp. 24-28.]
প্রকৃতপক্ষে সংগঠনের যথার্থতা নির্ভর করে কর্মচারীদের সংগঠনে কাজ করার ইচ্ছার উপর । সংগঠনে কর্মচারীদের কাজ করার ইচ্ছা না থাকলে, সেরূপ সংগঠন সম্পর্কে ধারণা করা একেবারেই অসম্ভব বলে তিনি অভিমত পোষণ করেন। সংগঠনের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উদ্দেশ্য।
প্রত্যেক সংগঠনই কোন না কোন উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। উদ্দেশ্যহীন কোন সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আবার সংগঠনের উদ্দেশ্য সঠিকভাবে জানা না থাকলে সে উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সঠিক কোন উপায় অবলম্বন করা উচিত তাও নির্ধারণ করা যায় না৷ সংগঠনের সাধারণ উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হবার পরে তা প্রচার করা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় এবং এ প্রচার কেবলমাত্র সুষ্ঠু, সঠিক ও পদ্ধতিগত যোগাযোগের মাধ্যমেই সম্ভবপর হয়ে উঠে। এক কথায় যোগাযোগকে সংগঠনের জীবনীশক্তি বলা হয়ে থাকে।
সনাতন মতবাদের স্তম্ভসমূহ (Pillars of the Classical Theory): সনাতন সংগঠন চারটি প্রধান স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। যথাঃ (১) শ্রমবিভাগ, (২) পদসোপান এবং কার্যগত প্রক্রিয়া, (৩) কাঠামো এবং (৪) নিয়ন্ত্রিত সীমা। এগুলো নিচে বর্ণনা করা হলোঃ
১। শ্রমবিভাগঃ সনাতন সংগঠনের চারটি স্তম্ভের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বম্ভ হলো শ্রমবিভাগ, শ্রমবিভাগকে কেন্দ্র করেই অন্যান্য সকল উপাদানের বিকাশ ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পদসোপান এবং কার্যগত প্রক্রিয়ার সম্প্রসারণের জন্যই কাজের বিশেষীকরণ এবং বিভাগীকরণ প্রয়োজন। বিশেষীকরণ থেকেই উদ্ভব ঘটেছে নিয়ন্ত্রণ ক্ষেত্র বিষয়ক সমস্যার।
২। পদসোপান এবং কার্যগত প্রক্রিয়াঃ এ প্রক্রিয়া একটি সংগঠনের বিপ্রতীপ বা উল্লম্ব (Vertical) এবং সমান্তরাল দিক আলোচনা করা হয়। পদসোপান প্রক্রিয়ায় আদেশ শৃঙ্খলা মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর ও দায়িত্ব, আদেশ ঐক্য এবং প্রতিবেদন প্রণয়নের দায়িত্ববোধকে বুঝায়। সংগঠনকে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করা’ এবং বিভিন্ন অংশের পুনঃএকত্রীকরণের মাধ্যমে সংগঠনকে একটি যুক্তিসিদ্ধ সংগঠনে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়াই হলো কার্যগত প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিক সংগঠনের আদেশ ও উপদেষ্টা সংস্থার সমান্তরাল বিবর্তনের উপর বিশেষ ধরনের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
৩। কাঠামোঃ সংগঠনের কাঠামো বলতে বুঝায় ব্যবস্থা ও পদ্ধতিকে। সংগঠনের উদ্দেশ্য সুষ্ঠুভাবে পালন করার লক্ষ্যে সংগঠনের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যুক্তিসংগত এবং কার্যকর সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। সনাতন সংগঠনের দু’টি প্রধান ও মৌল কাঠামো হলো আদেশ ও উপদেশমূলক সংস্থা। সংগঠনের মাধ্যমেই বিবিধ কার্যের যুক্তিসিদ্ধ ও সুসংহত সম্পর্ক স্থাপন করা হয়।
৪। নিয়ন্ত্রণসীমাঃ প্রশাসক কর্তৃক কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রিত নির্দিষ্ট অধস্তন কর্মচারীদের সংখ্যাই হলো সংগঠনের নিয়ন্ত্রণসীমা। কার্যকরভাবে একজন কর্মকর্তা কতজন অধস্তন কর্মচারীকে নিয়ন্ত্ৰণ করতে পারবেন তার সংখ্যা সম্পর্কে ভি. এ. গ্যারিকিউনাস অভিমত প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি ব্রেক তার এক বক্তব্যে নিয়ন্ত্রণক্ষেত্র বলতে বুঝিয়েছেন ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধান কার্যে নিয়োজিত কর্মচারীর সংখ্যাকে৷ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এদেরকে পরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণ, এদের মধ্যে প্রেরণা সৃষ্টি, বিভিন্ন কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন, পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রভৃতি বিষয়ে সামগ্রিক দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নিয়ন্ত্রণক্ষেত্র বিস্তৃত হলে সমতল প্রকৃতির এক ধরনের কাঠামো সৃষ্টি হয়। নিয়ন্ত্রিত সীমিতক্ষেত্র যে কাঠামো সৃষ্টি করে তা খাড়া বা লম্বালম্বি ধরনের কাঠামো বলে পরিচিত।
সনাতন মতবাদের সীমাবদ্ধতা (Limitations of Classical Theory): সংগঠন সম্পর্কিত সনাতন বা ক্লাসিক্যাল তত্ত্বে যথেষ্ট পরিমাণে সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। সনাতন তত্ত্বে মানবসম্পর্ককে গুরুত্বহীন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকের মতে, সনাতন মতবাদ অবাস্তবভিত্তিক। এ তত্ত্বে সংগঠন ব্যক্তিত্ব আনুষ্ঠানিক গোষ্ঠী, সংগঠনের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং আনুষ্ঠানিক কাঠামোতে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন ইত্যাদি সম্পর্কে কোন গুরুত্ব প্রদান করে না। সনাতন সংগঠনে কর্মচারীদেরকে সংগঠনের যন্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। কর্ম সম্পাদনের হাতিয়ার ছাড়াও মানুষের যে মনের চাহিদা, স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি থাকতে পারে সে দিকে সনাতনবাদীরা দৃষ্টি দেয় না। প্রশাসনিক সংগঠনকে একটি মানবিক সংগঠন হিসেবেও তারা স্বীকার করে না। সনাতনপন্থীরা মনে করে, সংগঠন কেবলমাত্র কার্যকাঠামোভিত্তিক নিষ্প্রাণ যান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। সনাতনবাদীগণ সংগঠনকে বাইরের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আলোচনা করেন। তারা সংগঠনের কাঠামোতে বাহ্যিক পরিবেশের সুষ্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করেন না। সনাতনবাদীরা আচরণবাদীদের অবদানকে হেয় দৃষ্টিতে দেখেন এবং তাদের আলোচনাকে সনাতন মতবাদের সম্পূরক বলেও মানতে রাজি নন। অনেকে মনে করেন, সনাতন গোষ্ঠীর প্রবক্তাগণ সংগঠনের দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজ সম্পর্কে সচেতন নন। সনাতনবাদীদের এরূপ ভাবনাকে অযৌক্তিক বলা যায়। তবে এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, সংগঠনের প্রকৃতি সম্পর্কে সনাতনবাদীদের যথেষ্ট অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে। কিন্তু তাদের এ দৃষ্টি কেবলমাত্র সংগঠনের আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যেই সীমিত।
Leave a comment