সনাতন উদারনীতিবাদকে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাবিদ নিজেদের মতাে করে ভিন্ন ভিন্ন ধারায় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করায় এই মতবাদের চিন্তা দর্শনের অভিমুখ একটি ধারায় প্রবাহিত হয়নি। সনাতন উদারনীতিবাদের চারটি প্রধান ধারা পরিলক্ষিত হয়। যেমন一
(১) ব্যক্তিস্বাত্ত্যবাদী চিন্তাধারা: সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীর রাজকীয় স্বৈরাচারিতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উদ্ভব ঘটে। আমেরিকার স্বাধীনতা ঘােষণা, ফরাসি বিপ্লব, হিতবাদ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের শক্তিশালী ভিত রচনা করে। জন লক, স্পেন্সার, বেন্থাম, জেমস মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল, অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো, সিজউইক, ম্যালথাস প্রমুখ রাষ্ট্রচিন্তাবিদ এই মতবাদের মুখ্য প্রবক্তা। এই উদারনীতিবাদের প্রধান কাজ হল ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারকে সুরক্ষিত রাখা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তাধারার আবার দুটি ভাগ বা ধারা一
- সাবেকি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ: সাবেকি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ রাষ্ট্রকে প্রয়ােজনীয় অথচ ক্ষতিকর প্রতিষ্ঠান বলে গণ্য করে। এ প্রসঙ্গে স্পেন্সার্ তার ‘The Man Versus the State’ গ্রন্থে এবং জে এস মিল তাঁর ‘On Liberty’ গ্রন্থে বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। মিলের ভাষায়, The state is necessary evil. সাবেকি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ রাষ্ট্র কী করতে পারে তা অপেক্ষা রাষ্ট্র কী করতে পারে না, সে বিষয়ে বেশি গুরুত্ব আরােপ করার পক্ষপাতী। সাবেকি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ নেতিবাচক রাষ্ট্র তত্ত্বে বিশ্বাসী।
- আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ: আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সাবেকি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের মূল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নর্মান অ্যাঞ্জেল, ওয়ালেস বেলক প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।নর্মান অ্যাঞ্জেল তার ‘The Great Illusion’ গ্রন্থে, ওয়ালেস তাঁর ‘Great Society’ গ্রন্থে, বেলক তার ‘The Servile State’ গ্রন্থে আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মূল বক্তব্যকে তুলে ধরেছেন। আধুনিক ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা সুরক্ষিত করার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতাকে যথাসম্ভব সীমিত রাখতে চায়। অ্যাডাম স্মিথ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত অবাধ বাণিজ্য নীতি (Lassiezfaire)-র প্রবক্তা। তিনি রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে তিনটি ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছেন, সেগুলি হল— (a) সমাজে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা, (b) ব্যক্তিগত উদ্যোগে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ না করা এবং (c) বৈদেশিক আক্রমণ থেকে স্বদেশকে রক্ষা করা ও জনকল্যাণমূলক কার্য সম্পাদন করা।
(২) বেন্থামের হিতবাদী চিন্তাধারা: হিতবাদ বা উপযােগিতাবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন জেরেমি বেন্থাম। বেন্থামের হিতবাদ বা উপযােগিতাবাদী তত্ত্বের সার কথা হল প্রত্যেক ব্যক্তি মানুষের যাবতীয় আচরণ ও কর্মের উদ্দেশ্য হল সুখ অর্জন করা। এখানে নিছক পার্থিব জীবনের সুখের বােঝানাে হয়েছে। বেন্থামের ভাষায় সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক পরিমাণ সুখ (“Greatest happiness of the greatest number”)।
যে-কোনাে সুখই উত্তম এবং যে কাজের ফলে সর্বাধিক সুখ অর্জন করা যায়, সে কাজই সঠিক ও যুক্তিসংগত। সর্বাধিক সুখ অর্জন যেমন ব্যক্তির জীবনের একটি অন্তিম লক্ষ্য, তেমনি সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তির সর্বোচ্চ পরিমাণ সুখের উৎপাদন সমাজেরও চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে বিবেচিত হয়। সমাজ সম্পর্কে জৈব মতবাদের ধারণা ত্যাগ করে বেন্থাম সমাজকে ব্যক্তি সমষ্টি রূপে চিত্রিত করেছেন এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে উদারনীতিবাদের একটি যুক্তিসঙ্গত উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
বেন্থামের মতে, জনকল্যাণ বা সামাজিক কল্যাণ (Public good) হল কেবলমাত্র সংখ্যায় সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বোচ্চ পরিমাণ সুখ। উপযোগিতা এই নৈতিক সূত্র ধরে বেন্থাম তার উদারনৈতিক রাষ্ট্রতত্ত্ব বর্ণনা করেছেন। তিনি মনে করেন যে, ব্যক্তির জীবন ও সমাজজীবনকে সর্বদা উপযােগিতা নীতি এর অনুগামী করে তােলার জন্য অর্থাৎ সর্বাধিক সংখ্যক লােকের সর্বাধিক সুখ অর্জন সুনিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে।
(১) রাষ্ট্রের মূলভিত্তি হল জনগণের সম্মতি: ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন লকের (সপ্তদশ শতাব্দী) চিন্তাধারার মধ্যে সনাতন উদারনীতিবাদের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর মতে, জনগণের কল্যাণসাধনের উপরই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। অর্থাৎ রাষ্ট্রের মূলভিত্তি হল জনগণের সম্মতি। রাষ্ট্রের কোনােভাবেই ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। বরঞ্ ব্যক্তিস্বাধীনতার পথে রাষ্ট্র বাধাগুলি দূর করতে চেষ্টা করবে। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে কর্তৃত্ব প্রয়ােগ করে এবং আইনের অনুশাসনের উপর ভিত্তি করে সরকার প্রতিষ্ঠা করে এবং এই প্রাকৃতিক আইনের দ্বারা রাষ্ট্রগুলি সীমাবদ্ধ থাকে। সনাতন উদারনীতিবাদ ব্যক্তিগত স্বাধীনতার উপর সবিশেষ গুরুত্ব দেয়।
(২) রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয় প্রাকৃতিক অধিকার সুরক্ষার জন্য: সাবেকি উদারনীতিবাদের ধারণায় ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি প্রাকৃতিক অধিকার গুলি রক্ষার জন্যই রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটে চুক্তির মাধ্যমে। চুক্তির মাধ্যমেই রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাই চুক্তি অনুযায়ী রাষ্ট্র যদি কাজ না করে, তাহলে জনগণের অধিকার থাকবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরােধের মাধ্যমে সেই সরকারকে সরিয়ে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করার।
(৩) সনাতন উদারনীতিবাদ রক্ষণশীল, কর্তৃত্ববিরােধী মতবাদ: উদারনীতিবাদ হল মধ্যযুগীয় কুসংস্কার এবং সবরকম রক্ষণশীল, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বাদের বিরােধী মতবাদ। এই মতবাদ মূলত রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে সীমিত করে ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রসারিত করতে চায়।
(৪) ব্যক্তির মর্যাদা ও স্বাধীনতার অধিকারকে গুরুত্ব দেয়া: সনাতন উদারনীতিবাদ ব্যক্তির মর্যাদা ও স্বাধীনতার অধিকারকে ভীষণ গুরুত্ব দেয়। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা প্রভৃতি পৌর স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব দেয় সনাতন উদারনীতিবাদ।
(৫) রাজনৈতিক সাম্য ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ প্রতিষ্ঠা: উদারনীতিবাদ মনে করে রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই গণতন্ত্র সফল হতে পারে। এর পাশাপাশি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা হল উদারনীতিবাদের আর-একটি উল্লেখযােগ্য লক্ষ্য বা নীতি। বেন্থাম মনে করেন, ব্যক্তির স্বার্থই হল প্রকৃত স্বার্থ। উদারনৈতিক মতবাদ ব্যক্তির পূর্ণ স্বাধীনতার সম্প্রসারণ চায়।
(৬) সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক সুখ: সনাতন উদারনীতিবাদের অন্যতম প্রবক্তা বেন্থামের মতে, সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক পরিমাণ সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা হল রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। রাষ্ট্র যেহেতু আইন প্রণয়নকারী সংস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়, তাই ব্যক্তির সার্বিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের মাপকাঠির বিচার ব্যক্তি নিজে করতে পারবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রয়ােজনীয়তা নেই।
(৭) সকলের সমানাধিকারে বিশ্বাসী: সাবেকি উদারনীতিবাদ সামাজিক অধিকার ও সুযােগসুবিধা ভােগের ক্ষেত্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমানাধিকারে বিশ্বাসী।
(৮) নৈতিক উন্নতি সাধন: সনাতন উদারনীতিবাদ জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হল ব্যক্তির নৈতিক উন্নতিসাধন। ব্যক্তিস্বাধীনতা কি সুরক্ষিত রাখার জন্য রাষ্ট্রের প্রয়ােজন। সমাজের সমষ্টিগত মঙ্গলের জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যেমন- সম্পত্তির উত্তরাধিকারের উপর নিয়ন্ত্রণ, একচেটিয়া কারবারের উপর নিয়ন্ত্রণ, আবশ্যিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন, শিশুদের স্বার্থে কারখানা আইন নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ মিল ব্যক্তির স্বাধীনতার উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ক্ষতিকারক বললেও রাষ্ট্রের প্রয়ােজনীয়তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে পারেননি।
(৯) আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযােগিতা: সনাতন উদারনীতিবাদ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি ও সহযােগিতার কথা উল্লেখ আছে। এবং বিশ্বের সমস্ত দেশকে নিয়ে একটি বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথাও বলা হয়েছে।
উপসংহার: উপরের আলােচনা থেকে বােঝা যায় যে, সনাতন উদারনীতিবাদীরা রাষ্ট্রের কার্যাবলিকে সীমিত করে ব্যক্তিস্বাধীনতা বড় করে দেখানাের সমর্থক ছিলেন। এঁরা ছিলেন চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পক্ষে। কিন্তু উনিশ শতকের শেষের দিকে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রভাবে ইউরােপীয় দেশগুলিতে একদিকে মুষ্টিমেয় বণিক শ্রেণির হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটে এবং অন্যদিকে সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশা বেড়ে যায়। এইসময় সাধারণ মানুষ উদারনীতিবাদের উপর আস্থা হারাতে থাকে এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। ফলে সনাতন উদারনীতিবাদের সংশােধন করে জনসাধারণের কাছে গ্রহণযােগ্য একটি মতবাদ গড়ে তােলার চেষ্টা করা হয়।
Leave a comment