প্রশ্নঃ সত্য সম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে সঙ্গতিবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।

অথবা, সত্যতা সম্পৰ্কীয় মতবাদ হিসেবে সঙ্গতিবাদ ব্যাখ্যা ও পরীক্ষা কর।

অথবা, সত্য সম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে সঙ্গতিবাদের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা তুলে ধর। স্বতঃপ্রতীতিবাদের সাথে এর সম্পর্ক তুলে ধর।

ভূমিকাঃ ‘সত্যতা’ এবং ‘মিথ্যাত্বের’ প্রশ্নটি অবধারণের সাথে জড়িত। আর এই অবধারণ সত্য কিংবা মিথ্যা হতে পারে। অবধারণের সত্যতা যাচাই করা দার্শনিক আলােচনার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। দর্শনের ইতিহাসে আমরা সত্যের প্রকৃতি ও সত্যের পরীক্ষা রূপ নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতবিরােধ দেখি। দর্শনের ইতিহাস আলােচনা করলে আমরা সত্যসম্পর্কীয় চারটি মতবাদ পাব। এগুলাে হলাে স্বতঃপ্রতীতিবাদ, সঙ্গীতবাদ, অনুরূপতাবাদ এবং প্রয়ােগবাদ।

সঙ্গতিবাদের পরিচয়ঃ একত্ববাদী ভাববাদীরা সত্যতার স্বরূপ ও সত্যতা নিরূপণের মানদণ্ড হিসেবে যে মতবাদের অবতারণা করেন দর্শনের ইতিহাসে তাই সঙ্গতিবাদ নামে পরিচিত। হেগেল, তার অনুসারী ব্রাডলি, কোয়েট প্রমুখ দার্শনিকরা এ মতবাদের সমর্থক। এ ছাড়া অন্যান্য অনেক বস্তুবাদীও এ মতবাদ সমর্থন করেন।

হেগেল এবং তার অনুসারীদের মতঃ হেগেল এবং তার অনুসারীদের মতে বিভিন বচনের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপরই বচনের সত্যতা নির্ভর করে। কোনাে বচন যদি অন্য কোনাে বচনের সাথে কোনাে একটি সুসংবদ্ধমণ্ডলি রচনা করতে সক্ষম হয় তাহলেই ঐ বচনটিকে সত্য বচন বলে অভিহিত করা যায়। তাই কোনাে বচনের সত্যতা বা মিথ্যাত্ব নির্ণয় করতে হলে গৃহীত বচনমণ্ডলির সাথে বচনটির আদৌ কোনাে সঙ্গতি আছে কি-না তা দেখা দরকার। যদি দেখা যায় কোনাে বচন অন্যান্য বচনের সাথে কোনাে একটি সুসংবদ্ধমণ্ডলি রচনা করতে সক্ষম হয়নি তাহলে সেই বচনটিকে মিথ্যা বচন বলে আখ্যা দিতে হবে। বচনের সত্যতা পরীক্ষা করার অর্থই হচ্ছে বচনের সঙ্গতি পরীক্ষা করা। এ মতবাদ অনুযায়ী, কোনাে বচনের সত্যতা বলতে বচনটি কোনাে বচনমণ্ডলির সাথে সঙ্গতির সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়াকে বােঝায়। আর মিথ্যাত্ব বলতে বােঝায়, অন্যান্য বচন এমন একত্রে মিলিত হয়ে যে মণ্ডলি রচনা করে। তার সাথে ঐ বচনটির কোনাে সঙ্গতি নেই। এ মতবাদ অনুযায়ী তাই কোনাে বিচ্ছিন্ন বচনের ওপর সত্যতা বা মিথ্যাত্বের প্রয়ােগ করা যায় না। অতএব সত্যতা হলাে কোনাে বচনের সঙ্গে অন্যান্য বচনের এমন এক ধরনের সম্পর্ক যাকে সঙ্গতি বলে অভিহিত করা যায়। সঙ্গতিবাদ আলােচনায় বচনমণ্ডলির আলােচনা আবশ্যক। নিচে আমরা এটি আলােচনা করব।

বচনমণ্ডলীঃ সঙ্গতিবাদ বচনমণ্ডলির সাথে বচনের সঙ্গতির কথা বলা হয়েছে। এই বচনমণ্ডলি কি এটা জানতে হবে। সাধারণভাবে বলা যায়, যে বচন সমষ্টির মধ্যে ব্যঞ্জনা বা প্রসক্তির সম্বন্ধ রয়েছে সেই বচন সমষ্টিকে বলে বচনমণ্ডলি। বিশুদ্ধ গণিতশাস্ত্র হচ্ছে বচনমণ্ডলির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিশুদ্ধ গণিতের বচনগুলাের প্রকৃতি আলােচনা করলে দেখা যায় যে, এ সকল বচন পরস্পরের সঙ্গে এমন সম্পর্কে আবদ্ধ যাদের একটি মিথ্যা হলে অপরটিও মিথ্যা হতে বাধ্য, আবার একটি সত্য হলে অপরটিও সত্য হতে বাধ্য।

সঙ্গতিবাদের স্বরূপঃ এতক্ষণ আমরা সঙ্গতিবাদের মূল বক্তব্য নিয়ে আলােচনা করলাম। এখন আমরা সঙ্গতিবাদের স্বরূপ নিয়ে আলােচনা করব।

(১) সঙ্গতিবাদ সত্যের প্রকৃতি সূচনা করেঃ হেগেল এবং হেগেলপন্থীদের মতে সঙ্গতি শুধু সত্য পরীক্ষার উপায় নয়, সত্যের প্রকৃতিও সূচনা করে। যেকোনাে বচনই পৃথক বা স্বতন্ত্রভাবে সত্য বা মিথ্যা হতে পারে। কোনাে বচন যখন অন্যান্য বচনের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে তখনই সে বচনের ‘সত্যতা’ গুণ উৎপন্ন হয়। অন্য কথায় কোনাে বিশেষ বচন যখন অন্য বচনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে সুসংবদ্ধমণ্ডলি গড়ে তােলে তখনই তা সত্য হয়। সুসংবদ্ধমণ্ডলী গড়তে না পারলে কোনাে বচনই সত্য হতে পারে না।

(২) সঙ্গতিবাদ আর সত্যতা একঃ সঙ্গতি, সংবদ্ধতা বা সম্বন্ধ আর সত্যতা আলাদা নয়, একই কথা। আমরা যখন বলি আকাশ নীল, পাতা সবুজ ইত্যাদি তখন এর যেকোনাে বচনই স্বতন্ত্রভাবে সত্য বা মিথ্যা হতে পারে না। যখন এ দুটি বচনের যে কোনােটি অন্যান্য বচনের সঙ্গে মিলে একটা সঙ্গতিপূর্ণ মণ্ডলি সৃষ্টি করে তখনই তা সত্য হয়।

সমালােচনা/ মূল্যায়নঃ সত্যতার স্বরূপ ও সত্যতা নিরূপণের মানদণ্ড সম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে সঙ্গতিবাদ বিভিন্ন সমালােচনার সম্মুখীন হয়েছে। এ মতবাদের বিরুদ্ধে সাধারণত উত্থাপিত হয় এমন প্রধান অভিযােগগুলাে নিচে উল্লেখ করা হলাে-

(১) এ মতবাদ পূর্ণাঙ্গ ও সাশ্রয়ী নয়ঃ সঙ্গতিবাদীরা বচনের আপেক্ষিক সত্যতা এবং আংশিক বা অপূর্ণ সত্যতায় বিশ্বাসী। এ মতে প্রতিটি সত্যবচন অন্যান্য সব ধরনের বচনের ওপর যৌক্তিক দিক দিয়ে নির্ভরশীল। এদিক থেকে এ মতবাদকে চূড়ান্ত, পূর্ণাঙ্গ ও সাশ্রয়ী বলা যায় না।

(২) এ মতবাদ বিভ্রান্তিকরঃ সঙ্গতিবাদ বচনের অভ্যন্তরীণ সম্বন্ধের ওপর নির্ভরশীল। সমালােচকদের মতে, এটি বিভ্রান্তিকর। কেননা, কোন বচন সত্য না মিথ্যা, এ প্রশ্নটি বচনটির সত্যতা যেসব পূর্বশর্তের ওপর নির্ভর করে তার জ্ঞানের ওপর আদৌ নির্ভর করে না।

(৩) এ মতবাদ আংশিক সত্য, আংশিক মিথ্যাঃ বস্তুবাদীরা এ মতবাদের সমালােচনা করে বলেন যে, কীভাবে একই অবধারণ আংশিকভাবে সত্য, আংশিকভাবে মিথ্যা তা বােঝা যায় না। কারণ বাস্তব জীবনে আমরা সত্য ও মিথ্যাকে সম্পূর্ণ পৃথক বলে মনে করি অর্থাৎ সত্যকে মিথ্যার বিপরীত বলে গ্রহণ করি।

(৪) এ মতবাদ যৌক্তিক নয়ঃ সমালােচকদের মতে, যদি পরস্পর বিরােধী দু’টি বিকল্প সঙ্গতিপূর্ণ বচনমণ্ডলি প্রতিস্থাপন করা যায় তাহলে সঙ্গতিবাদের মূল বক্তব্যের কোনাে যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

(৫) এ মতবাদ বাস্তবতা বিরােধীঃ সঙ্গতিবাদীরা যে ধরনের বচনমণ্ডলির কথা বলেছেন তারা অসীম। কিন্তু সঙ্গতিবাদীরা তাদের এক, অদ্বিতীয় ও অনাপােষ বৃহত্তম জ্ঞানমণ্ডলির কথা বলেছেন। এ জন্যই এ বক্তব্য বাস্তবতাবিরােধী।

(৬) এ মতবাদ চক্রদোষে দুষ্টঃ সঙ্গতিবাদীরা সত্যতার ধারণাকে পূর্ব থেকে স্বীকার করে নিয়ে সত্যতার সংজ্ঞা দিয়েছেন। আবার সত্যতার সংজ্ঞা থেকে তারা সত্যতার ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এতে করে তারা তাদের মতবাদকে চক্রদোষে ত্রুটিপূর্ণ করেছেন।

স্বতঃপ্রতীতিবাদের ব্যাখ্যা (Self-evidence theory): স্বতঃপ্রতীতিবাদ অনুসারে, একটি বাক্য বা অবধারণের সত্যতা স্বতঃই প্রতীত হয়, কেননা এর সত্যতা স্পষ্ট ও স্বতঃসিদ্ধ। অবধারণের সত্যতা অবধারণের ওপরই নির্ভরশীল, অন্য কোনাে কিছুর ওপর নয়। অর্থাৎ এর বস্তুগত বা বিষয়গত প্রকাশের ওপর নয়। আর সেজন্য এ ক্ষেত্রে বিষয় বা ঘটনার কোনাে প্রসঙ্গের প্রয়ােজন পড়ে না। এ মতে, স্বতঃপ্রতীতিই সত্যতা নির্ণয়ের প্রকৃত বা নির্ভরযােগ্য মানদণ্ড। চিন্তার মৌলিক নিয়ম বা নীতি ও গণিতের এমন কতগুলাে স্বতঃসিদ্ধ সত্য রয়েছে, যেগুলাের কোনাে প্রমাণের প্রয়ােজন পড়ে না। এ ধরনের অবধারণ সন্দেহপূর্ণ নয়, বরং সন্দেহাতীত এবং এ ধরনের সন্দেহাতীত অবধারণ সত্য। এ ধরনের সন্দেহাতীত অবধারণ থেকে অনিবার্যভাবে যেসব অবধারণ পাওয়া যায় সেগুলােও সত্য। যুক্তিবিদ্যা ও গণিতের মতাে অভিজ্ঞতানিরপেক্ষ আকারগত বিদ্যা এমন কতকগুলাে মৌলিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেগুলােকে স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়। এদিক থেকে স্বতঃপ্রতীতিবাদের সত্যের মানদণ্ড এসব বিদ্যার ক্ষেত্রে সর্বজনগ্রাহ্য ও সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু দার্শনিকরা এই সত্যের মানদণ্ড অভিজ্ঞতানিরপেক্ষ নীতির ক্ষেত্র ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে অর্থাৎ বিষয় বা ঘটনাসম্পৰ্কীয় অবধারণের ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সান্তয়ানা (Santyana) সংবেদনসমূহকে স্বতঃসিদ্ধ সত্য এবং সংবেদনগ্রাহ্য জগৎকে বাস্তব বলে মনে করেন। ডেকার্ট ও স্পিনােজা স্পষ্টতা ও পরিস্ফুটতাকে সত্যতার মানদণ্ড হিসেবে মনে করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ডেকার্ট মনে করেন, “আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি” এ সত্য আমার কাছে খুব স্পষ্ট ও পরিস্ফুট। এ বাক্যের সত্যতা স্বতঃপ্রতীত বলে নিশ্চিত হতে পারা যায় যে, বাক্যটি সত্য। তাই ডেকার্টের মতে, আত্মা বা আত্মজ্ঞানসম্পৰ্কীয় অবধারণ স্পষ্ট ও পরিস্ফুট এবং জ্ঞান সন্দেহাতীতভাবে সত্য।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, এ মতবাদের বিভিন্ন ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও আমরা এ কথা বলতে পারি যে এটা সব রকম চরমপন্থাকে অস্বীকার করে সত্যের পরীক্ষা সম্পর্কে সঠিক আলােচনা করতে সক্ষম। বিখ্যাত দার্শনিক রাসেল অতিবাদের একজন কঠোর সমালােচক হয়েও সত্যতা নিরূপণের মানদণ্ড হিসেবে সহৃতিকে একটা গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড বলে মনে করেন। সুতরাং সত্যতার মানদণ্ড হিসেবে সঙ্গতিবাদকে কোনােক্রমেই গুরুত্বহীন বলে মনে করা যায় না। তা ছাড়া স্বতঃপ্রতীতিবাদের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে।