‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক ‘স্বভাব কবি’-র কোন্ কোন্ বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন?

‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু স্বভাবকবির সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য নির্ণয় প্রসঙ্গে কবি গোবিন্দচন্দ্র দাসের নাম উল্লেখ করেছেন। স্বভাব কবি বলতে সেই কবিকেই বোঝানো হয় যিনি হৃদয়নির্ভর প্রেরণায় বিশ্বাসী হয়ে কবিতা লেখেন এবং মনে করেন হৃদয়ের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তির সম্পর্ক ভিন্ন শিবিরের। সংযমের যদি কবিত্বকে নিয়ন্ত্রিত করার শক্তি না থাকে তবে স্বভাবকবিত্ব শব্দটি আরোপিত হয়। স্বভাবকবিত্বের এই লক্ষণ কবিদের মধ্যে আরোপিত হয় কখনও বা ব্যক্তিগত কারণে আর কখনও বা ঐতিহাসিক কারণে। অর্থাৎ কেউ কেউ স্বভাবতই স্বভাব কবি আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাহিত্যের অবস্থার ফলে কেউ কেউ স্বভাব কবি হয়ে যান। প্রাবন্ধিক গোবিন্দ দাসকে স্বভাবকবিরূপে চিহ্নিত করেছেন এই কারণে যে তাঁর কবিমানসে আবেগের প্রাচুর্য থাকলেও সংযমের শাসন ছিল না। তিনি রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক হয়েও রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্ব অনুভব করেননি।

সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর সময়ে প্রবলভাবে জনপ্রিয় হয়েছিলেন কেন?

রবীন্দ্রনাথের কবিতা জীবনের সম্পদস্বরূপ হলেও সেই কবিতাকে আদর্শ হিসাবে সামনে রাখা বিপজ্জনক। রবীন্দ্রনাথের কবিতা আদর্শ হিসাবে সামনে থাকার ফলে যে সমস্যার সৃষ্টি হল তার প্রতিফলন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় লক্ষণীয়। রবীন্দ্র সমসাময়িক কবিদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথের কবিত্ব শক্তি ও রচনা নৈপুণ্য থাকলেও একথা স্বীকার করতে হয় রবীন্দ্রনাথ পড়া থাকলে সত্যেন্দ্রনাথ পড়ার প্রয়োজনীয়তা নেই বললেই চলে। সত্যেন্দ্রনাথের কবিতায় রাবীন্দ্রিক কবিতার অনুষঙ্গগুলিই ব্যবহৃত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মতো সত্যেন্দ্রনাথের কবিতাতেও পাওয়া যায় ঋতুরঙ্গ, পল্লিচিত্র, ফুল, পাখি, চাঁদ, মেঘ, শিশির, দেশপ্রেম ইত্যাদি। কিন্তু উক্ত অনুষঙ্গগুলি রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যে আবেগ, উত্তাপ, প্রাণসত্তার স্পর্শসহ ব্যবহৃত হয়েছে সত্যেন্দ্রনাথের কবিতায় তার অভাব। রবীন্দ্রনাথের দিব্যদৃষ্টি, বিশ্বসত্তার অনুভূতি ইত্যাদি সত্যেন্দ্রনাথের কবিতায় চপল চটুলতায় পর্যবসিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ছন্দোগত মাধুর্য, মদিরতা, অন্তলীনতা, শিক্ষা, সংযম রুচির পরিবর্তে সত্যেন্দ্রনাথের কবিতায় মিহি সুর, ধুনকো তাল আর চটপটে তাল যে-কোনো পাঠককে মোহিত করে। এইজন্যই সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর সময়ে জনপ্রিয় হয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের কাব্য জগতের বন্ধন থেকে নজরুল বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন কেন?

প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু নজরুল ইসলামকে ঐতিহাসিক অর্থে স্বভাবকবি বলেছেন। প্রাবন্ধিকের মতে নজরুলের কবিতায় অসংযম, প্রগল্ভতা, পরিণতির অভাব সবই ছিল, এমনকি নজরুলের দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে তিনি একই রকম লিখে গেছেন। তাঁর কাব্যে প্রকরণ বা কৌশলগত কোনো পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়নি। কিন্তু নজরুলের সব দোষ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তাঁর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে। নজরুলের কবিতার নানা দোষ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষায় প্রথম মৌলিক কবি বলতে হয়। রবীন্দ্র প্রতিভা যখন মধ্যগগনে নজরুল তখন রবীন্দ্র-বন্ধন ছিড়ে বার হলেন, অসাধ্য সাধন করলেন। প্রাবন্ধিকের মতে নজরুলের অসম্ভব কারণের ফলশ্রুতি স্বরূপ নজরুলের এই আত্মপ্রকাশ সম্ভব হয়েছিল। নজরুল তাঁর জীবনের পটভূমিকায় ভিন্নতার জন্য কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিলেন। তিনি মুসলমান হয়েও হিন্দু সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছিলেন। কোনোরকম সাহিত্যিক প্রস্তুতি ছাড়াই নিজের স্বভাবের শক্তিকে এবং জীবনের নানাবৃত্তি সঞ্জাত অভিজ্ঞতার বলে রবীন্দ্র প্রভাব থেকে সরে গিয়ে বাংলা কবিতায় নতুন প্রাণপ্রবাহ আনতে পেরেছিলেন। প্রাবন্ধিকের ভাষায়—“কোনোরকম সাহিত্যিক প্রস্তুতি না নিয়েও শুধু আপন স্বভাবের জোরেই রবীন্দ্রনাথের মুঠো থেকে পালাতে পারলেন তিনি।”

“তাদের পক্ষে অনিবার্য ছিল রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ এবং অসম্ভব ছিল রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ।”— এখানে কাদের কথা বলা হয়েছে? কেন এদের পক্ষে অনিবার্য ও অসম্ভব ছিল রবীন্দ্রানুকরণ? তাঁদের কবিতার ভিতরে কীভাবে এই রবীন্দ্রানুকরণের সমস্যা দেখা দিয়েছে?

এখানে বিশ শতকের প্রথম দুই দশকের বাঙালি কবিদের কথা বলা হয়েছে। এই কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগ্‌চি, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, কিরণধন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ কবিরা।

বিশ শতকের প্রথম দুই দশকের এই বাঙালি কবিদের বলা হত রবীন্দ্রানুসারী কবি সমাজ। এঁরা সকলেই সচেতন বা অবচেতন ভাবে রবীন্দ্র-বৃত্তে লালিত ও পরিবর্ধিত। এঁদের মতো কেউ কেউ যে ভালো কবিতা লেখেন নি এমন নয়। কিন্তু তাদের পক্ষে রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ অসম্ভব ছিল ; যদিও এটাই ছিল অনিবার্য। রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত কাছাকাছি থেকেও এই কবিরা রবীন্দ্রকাব্যের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শনের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেননি। তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেননি যে, রবীন্দ্রনাথের ‘কাব্যকলা মারাত্মক প্রতারক’ আর ‘সেই মোহিনী মায়ার প্রকৃতি না বুঝে শুধু বাঁশি শুনে ঘর ছাড়লে ডুবতে হবে চোরাবালিতে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থের মায়ায় না মজে তাদের উপায় ছিল না এবং সেই কাব্যের সুর মাধুর্যে তাঁদের আত্মচেতনা স্বপ্নের তৃপ্তিতে বিলীন হল। তাঁরা কবিগুরুকে ধ্যান না করে ব্রতরূপে গ্রহণ করলেন। ফলত এঁরা রবীন্দ্রনাথের সীমাহীন বিস্তৃতি ও গভীরতাকে উপলব্ধি করতে পারেননি। তাই তাদের কবিতায় ফেনিলতা, অলংকৃত উচ্ছ্বাস, পুনরাবৃত্তি, শিথিলতা, তন্দ্রালুতা—স্বভাব কবিত্বের সমস্ত লক্ষণ দেখা দিতে লাগল।

“রবীন্দ্রনাথের ব্রত নিলেন তাঁরা কিন্তু তাঁকে ধ্যান করলেন না।”—এখানে ব্রত ও ধ্যানের প্রভেদ কী? তাঁরা স্বরূপ চিন্তার সময় পেলেন না কেন? কী কারণে তাঁরা উত্তরসাধকদের পক্ষে শ্রদ্ধেয়?

রবীন্দ্রানুসারী কবিসমাজ রবীন্দ্রসাহিত্যের ব্যাপক বিস্তৃতি ও সীমাহীন গভীরতা অনুধাবন করতে পারেননি কারণ তারা রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করতে পারেননি। কেবল তাঁকে অনুকরণ করার অক্ষম প্রয়াস চালিয়েছেন। এখানে রবীন্দ্রানুসারী কবিদের অনুকরণ করার প্রবণতাকেই ‘ব্রত’ বলা হয়েছে আর রবীন্দ্রনাথকে তাঁরা আত্মস্থ করতে পারেননি কারণ তাঁরা সাহিত্যের গভীরতার ধ্যানে নিমগ্ন হননি। আনুষ্ঠানিকতায় ডুবে থাকার জন্য, কাব্যকলার বাইরের রূপে মুগ্ধ থাকার জন্য তাঁরা রবীন্দ্রসাহিত্যের স্বরূপ চিন্তার সময় পাননি। অবশ্য রবীন্দ্রানুসারী কবিদের কবিকর্ম এবং কারণে শ্রদ্ধেয় যে তারা রবিতাপে আত্মাহুতি দিয়ে পরবর্তী কবি প্রজন্মকে সাবধান করে গেছেন— আর এখানেই তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকাটি স্মরণ।

নজরুলকে বুদ্ধদেব ঐতিহাসিক অর্থে স্বভাবকবি বলেছেন—এর কারণ কী? নজরুল কীভাবে বাংলা কাব্যে নূতন যুগ আনেন?

প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু নজরুল ইসলামকে ঐতিহাসিক অর্থে স্বভাবকবি বলেছেন। কারণ স্বভাবকবি সুলভ প্রকারণগত ছেলেমানুষি নজরুলের কবিতায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। এমনকি নজরুলের কবিতার মধ্যে রবীন্দ্রকাব্যের আক্ষরিক প্রতিধ্বনিও শোনা যায়। প্রাবন্ধিকের মতে নজরুলের কবিতায় অসংযম, প্রগল্ভতা, পরিণতির অভাব সবই ছিল এমনকি নজরুলের দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে তিনি একই রকম লিখে গেছেন। তাঁর কাব্যে প্রাকরণিক কৌশলের কোনো পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়নি। কিন্তু নজরুলের সব দোষ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে তাঁর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে। নজরুলের কবিতার নানা দোষ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে রবীন্দ্রনাথের পর বাংলাভাষার প্রথম মৌলিক কবি বলতে হয়। রবীন্দ্র প্রতিভা যখন মধ্যগগনে নজরুল তখন রবীন্দ্র-বন্ধন ছিঁড়ে আত্মপ্রকাশ করেন। প্রাবন্ধিকের মতে এই অসাধ্য সাধনের পিছনে সাধনার কোনো ইতিহাস ছিল না। কতকগুলি অসম্ভব কারণের ফলশ্রুতি স্বরূপ নজরুলের এই আত্মপ্রকাশ সম্ভব হয়েছিল। নজরুল তাঁর জীবনের পটভূমিগত ভিন্নতার জন্য কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিলেন। তিনি মুসলমান হয়েও হিন্দু সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছিলেন। কোনোরকম সাহিত্যিক প্রস্তুতি ছাড়াই নিজের স্বভাবের শক্তিতে এবং জীবনের নানাবৃত্তি সঞ্জাত অভিজ্ঞতার বলে রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে সরে গিয়ে বাংলাকাব্যে নতুন যুগ এগিয়ে আনেন।

রবীন্দ্রনাথের উত্তরসাধকদের বুদ্ধদেব কয়টি স্তরে সাজিয়েছেন?

বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের উত্তরসাধকদের প্রাবন্ধিক নিম্নলিখিত পর্যায়ে বিন্যস্ত করেছেন—

  • (ক) বিশ শতকের সূচনাকালীন রবীন্দ্রানুসারী কবিসমাজ।

  • (খ) সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও সত্যেন্দ্রগোষ্ঠীর কবি।

  • (গ) বাংলাভাষার রবীন্দ্র পরবর্তী প্রথম মৌলিক কবি নজরুল ইসলাম।

  • (ঘ) কল্লোল গোষ্ঠীভুক্ত কবিদল। 

  • (ঙ) পরিচয়, কবিতা পত্রিকা কেন্দ্রিক কবিদল।