প্রশ্নঃ সত্যতা সম্পর্কিত মতবাদ হিসেবে অনুরূপবাদ এবং প্রয়ােগবাদের ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।

অথবা, সত্যতা সম্পর্কিত মতবাদ হিসেবে অনুরূপবাদ ও প্রয়ােগবাদ মতবাদ সমালােচনাসহ ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ কোনাে বিষয় বা ঘটনার ক্ষেত্রে সত্য বা মিথ্যা বিষয়টি প্রযােজ্য নয়। সত্য বা মিথ্যা বাক্য অবধারণের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। অবধারণ সত্য বা মিথ্যা হতে পারে। সুতরাং অবধারণের সত্যতা যাচাই করা দার্শনিক আলােচনায় অপরিহার্য। অবধারণের সত্যতা যাচাই করতে হলে সত্যের স্বরূপ ও মানদণ্ডকে জানা আবশ্যক। সত্যের মানদণ্ড ও স্বরূপ সম্পকে দর্শনে চারটি মতবাদ প্রচলিত আছে। যথা-(ক) স্বতঃপ্রতীতিবাদ, (খ) অনুরূপতাবাদ, (গ) সঙ্গতিবাদ এবং (ঘ) প্রয়ােগবাদ। নিম্নে অনুরূপতাবাদ ও প্রয়ােগবাদ মূল্যায়নসহ ব্যাখ্যা করা হলাে-

অনুরূপবাদঃ অনুরূপতাবাদ সত্যতা যাচাইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। অনুরূপতাবাদ সত্যতা নিরূপণের অন্যতম মানদণ্ড। এ মতবাদ অনুসারে অনুরূপতাবাদ সত্যতার লক্ষণ বা প্রকৃতি কোন অবধারণের সত্যতা নির্ভর করে তার সঙ্গে ঘটনা বা বাস্তব অবস্থানের ওপর। প্রত্যেক অবধারণে কোনাে না কোনাে বিষয়ের নির্দেশ থাকে। কোনাে অবধারণে যে বিষয়ের নির্দেশ থাকে বিষয়টি বাস্তবে যদি তার অনুরূপ হয় তবেই অবধারণটি সত্য হবে। অন্যথায় অবধারণটি মিথ্যা হবে। উদাহরণস্বরূপ ‘ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী’ অবধারণটি সত্য। কারণ, অবধারণটি বাস্তব অবস্থার অনুরূপ। কিন্তু কুমিল্লা বাংলাদেশের রাজধানী’ অবধারণটি মিথ্যা। কারণ, অবধারণটি বাস্তব অবস্থার অনুরূপ নয়। কাজেই অনুরূপতাবাদ অনুসারে ঘটনার বিবরণ ও ঘটনার বাস্তব অবস্থার মধ্যে মিলের ভিত্তিতে সত্যতা নিরূপিত হয়। সাধারণ মানুষ এ পদ্ধতিতে সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করে বলে এটাকে লৌকিক মতবাদও বলা হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোন উক্তি বা ধারণাকে বাস্তব অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ করে থাকে। বিজ্ঞানেও এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। বিজ্ঞানী তার উদ্ভাবিত মতবাদকে বাস্তব অবস্থার সাথে মিলিয়ে সিদ্ধান্তে উপনিত হন।

সমালােচনাঃ অনুরূপতাবাদের অনেক সমালােচনা হয়েছে। এসব সমালােচনা নিম্নে উল্লেখ করা হলাে-

প্রথমত, অনুরূপতাবাদীদের মতে, বাহ্যবস্তুর সাথে ধারণার মিল হলে অবধারণটি সত্য হয়। কিন্তু বাহ্যবস্তুকে সরাসরি জানা যায় না। কাজেই বাহ্যবস্তুর সাথে ধারণার অনুরূপতা যাচাই করার সুযােগ নেই।

দ্বিতীয়ত, ধারণার অবস্থান হচ্ছে মনের মধ্যে, আর বিষয় ও তার সম্পর্কের অবস্থান হচ্ছে মনের বাইরে বাহ্যবস্তুতে। সুতরাং এ দুটি ভিন্নধর্মী বিষয়ের মধ্যে মিল বা গরমিল পরীক্ষা করার উপায় নেই।

তৃতীয়ত, অনুরূপতাবাদী দার্শনিকের কাছে ‘অনুরূপতা’ শব্দটির অর্থ বিভিন্ন রকমের। সুতরাং অনুরূপতাবাদ শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রমাণ করে যে এর দ্বারা সত্যের স্বরূপ নির্ণয় করা সম্ভব নয়।

চতুর্থত, অনুরূপতাবাদ একটি বাস্তবাবাদী মতবাদ। সুতরাং বাস্তববাদের সমস্ত দোষ এ মতবাদেও বিদ্যমান।

পঞ্চমত, প্রয়ােগবাদীরা সত্যতাকে বচনের আভ্যন্তরীণ গুণ বলে মনে করেন না। তাদের মতে সত্যতা হচ্ছে বচনের আগন্তুক গুণ, বচনের অজির্ত ধর্ম। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে সত্যতা বচনের একটি নিজস্ব গুণ এবং বচনের মধ্যেই তা নিহিত থাকে। সত্যতা যদি বচনের মধ্যে নিহিত না থাকতাে তাহলে কোনাে কিছুই বচনকে সত্য করতে পারতাে না।

ষষ্ঠত, কারাে কারাে মতে, প্রয়ােগবাদ স্বরূপতই একটি বিভ্রান্তিকর মতবাদ। তাই সত্যতার স্বরূপ ও সত্যতা নির্ণয় প্রসঙ্গে প্রয়ােগবাদীদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। যেমন- পার্স জেমসের মতকে আত্মঘাতী এবং ডিউঙ্গ অপ্রায়ােগিক বলে অভিহিত করেছেন। পার্সের মতে, জেমসের মতকে মেনে নিলে আধিবিদ্যক ধ্যান-ধারণাকেও স্বীকার করে নিতে হয়, যা প্রয়ােগবাদী বক্তব্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আর ডিউঈ-এর মতে জেমস বিশ্বাসের বৈধতা ও বিশ্বাসের মূল্যের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেননি।

প্রয়ােগবাদঃ মানবিক প্রয়ােজনই হলাে সত্য নির্ণয়ের একমাত্র চাবিকাঠি। এটাই প্রয়ােগবাদের মূল কথা। প্রখ্যাত দার্শনিক উইলিয়াম জেমস, সীলার এবং ডিউঙ্গ সত্যের প্রকৃতি ও পরীক্ষা হিসেবে এ প্রয়ােগবাদের প্রচার করেন। তারা সবাই বচনের বা বিধানের ব্যবহারের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে এর সত্যতা স্বীকার করেন। এরা সত্যের প্রকৃতি ও সত্যের জ্ঞানের ব্যাপারে জীবনের উপযােগিতার প্রাধন্যকেও স্বীকার করেন। উপযােগিতা বা প্রয়ােজনই হচ্ছে সত্যতা নিরূপণের একমাত্র উপায়।

উইলিয়াম জেমসের মতেঃ ধারণার কোনাে স্বতঃপ্রামাণ্য নেই। সত্যতা হলাে ধারণার কোনাে আগন্তুক গুণবিশেষ। ধারণার সত্যতা পরীক্ষা সাফল্যের মাধ্যমে সৃষ্ট গুণবিশেষ। কোনাে ধারণার সত্যতা পরীক্ষা করতে গিয়ে যদি দেখা যায় যে, সে ধারণা আমাদের জীবনের কাজের সহায়ক, তবে তখন আমরা ধারণাটিকে সত্য বলে গ্রহণ করতে পারি। এ হিসেবে ধারণার ব্যবহারিক উপযােগিতা অথবা প্রয়ােজন অথবা মূল্যই হচ্ছে এর সত্যতা।

প্রয়ােগবাদী দার্শনিক জন ডিউঙ্গ বলেনঃ সত্যতা স্বতঃপ্রতীতির বিষয় নয়, সত্যতা সুনির্দিষ্ট ও সুনিয়ন্ত্রিত অনুসন্ধানেরই ফল। অনুসন্ধানপ্রক্রিয়ার ফলকেই সত্যতা বলা হয়। কোনাে ধারণা সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিলেই আমরা ধারণার বস্তুর স্বরূপ সম্পর্কে সন্দেহ করি এবং সন্দেহের অবসান হলে ধারণাটিকে সত্য বলে গ্রহণ করি। সতরাং ধারণার সত্যতা এর পরীক্ষার সাফল্যের ওপরই নির্ভর করে। এভাবেই ডিউঙ্গ প্রয়ােগবাদী সত্যতত্তের ব্যাখ্যা দেন।

সমালােচনাঃ নিম্নে সত্য সম্পর্কিত মতবাদ হিসেবে প্রয়ােগবাদের সমালােচনা ব্যাখ্যা করা হলাে।

প্রথমত, প্রয়ােগবাদীরা সত্যের সব রকমের পরম মানদণ্ডকে নাকচ করে দেওয়ার ফলে সত্যকে এক আপেক্ষিক ও আত্মগত পর্যায়ে নিক্ষেপ করেছেন। এই মতবাদে কোনাে সাধারণ সমান্যনীতি বা সত্য, ন্যায়, সৌন্দর্য- কোন আদর্শের স্থান নেই।

দ্বিতীয়ত, প্রয়ােজনসিদ্ধি সত্যের মানদণ্ড হতে পারে না। প্রয়ােজনসিদ্ধিকে সত্যের মানদণ্ড মনে করলে সত্যের স্বরূপ বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন রূপ ধারণ করবে।

তৃতীয়ত, প্রায়ােগিক মতবাদ সত্যের স্বরূপ উদঘাটন করতে পারে না। কারণ, এ মতবাদ সত্যের স্বরূপ ও সত্যের পরীক্ষাকে অভিন্ন বলে মনে করে।

চতুর্থত, কারাে কারাে মতে, প্রয়ােগবাদ স্বরূপত একটা বিভ্রান্তিকর মতবাদ, তাই সত্যতার স্বরূপ ও সত্যতা নির্ণয় প্রসঙ্গে প্রয়ােগবাদীদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়।

পঞ্চমত, রাসেল জেমসের সমালােচনা করে বলেন যে, অপ্রয়ােজন আছে বা কার্যকর ফলপ্রসূ ইত্যাদি শব্দ দ্ব্যর্থক। বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে রাসেল বলেন যে, বিজ্ঞানের কোনাে প্রকল্পের কার্যকারিতা বলতে বুঝায় যে, এ প্রকল্প থেকে যাচাই যােগ্য বাক্য নিঃসৃত হয়ে থাকে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দর্শনে কোনাে মতবাদই সমালােচনার উর্ধ্বে নয়। সেই হিসেবে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, অনুরূপতাবাদ ও প্রয়ােগবাদের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। সুতরাং সার্বিক আলােচনায় সত্যতার মানদণ্ডে উভয় মতবাদই দর্শনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।