প্রশ্নঃ সত্ত্বা দর্শন বলতে কী বুঝ? সত্ত্বা সম্পর্কে মতবাদগুলাে সংক্ষেপে আলােচনা কর।

অথবা, সত্ত্বা দর্শন কী? সত্ত্বা সম্পর্কে মতবাদগুলাে সংক্ষেপে আলােচনা কর।

অথবা, সত্ত্বা বিষয়ক মতবাদ হিসেবে একত্ববাদ, দ্বৈতবাদ ও বহুত্ববাদ ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ মানুষের জীবনের সাথে জগতের সম্পর্ক চিরন্তন। আর এই জগৎ এ জীবনের জড়িত মৌলিক সমস্যাগুলাের যৌক্তিক অনুসন্ধানই হলো দর্শন। জগতের আদি সত্তাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দার্শনিকগণ এক, দ্বি এবং বহু সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করেন। ফলে সত্তাকে ঘিরে সৃষ্টি হয় নানা ধরনের মতবাদ। আর এ বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে একটি প্রসিদ্ধ ও সর্বাধিক গ্রহণযােগ্য মতবাদ হলাে একত্ববাদ।

সত্ত্বার সংজ্ঞাঃ সত্তা শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে বলে এককভাবে এর সংজ্ঞা দেয়া বেশ কষ্টসাধ্য। সত্তা শব্দটি সাধারণত দু’টি অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে।

প্রথমতঃ সত্তা বলতে বস্তুর মূল উপাদানকে বােঝানাে হয়ে থাকে। উল্লেখ্য এই মূল উপাদান জড়ও হতে পারে আবার মনও হতে পারে। মূল উপাদানের সংজ্ঞায় আব্দুল মতিন বলেন, চূড়ান্ত বা পরম উপাদান বলতে এমন একটি মৌলিক দ্রব্য বা উপাদানকে বােঝায় যেটি নিজে কোনাে কিছুতে পরিণতি লাভ করে না; বরং অন্যসকল কিছু এতে পরিণতি লাভ করে।

দ্বিতীয়তঃ সত্তা কথাটি পরমসত্তাকে বােঝায়। পরম সত্তা বলতে এমন এক সত্তাকে নির্দেশ করে যিনি জগতের চূড়ান্ত কারণ; জগতের সবকিছুর অস্তিত্ব তার ওপর নির্ভরশীল। পরম সত্তার সংজ্ঞায় স্পিনােজা এবং ব্রাডলি বলেন “পরমসত্তা হলাে আমাদের পূর্ণ অভিজ্ঞতার চরম আবরি যেখানে কোনােরকম বিরােধ নেই।

একত্ববাদঃ যে মতবাদ জগত সৃষ্টির পেছনে একটিমাত্র আদিসত্তাকে স্বীকার করে, সে মতবাদকে একত্ববাদ বলা হয়। বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের সন্ধান করাই একত্ববাদের মূল উদ্দেশ্য। কোনাে কোনাে দার্শনিক জগতের আদি উপাদান হিসেবে একটি জড়বস্তুকে স্বীকার করেন। এদেরকে জড়বাদ দার্শনিক বলা হয়। দর্শনের অগ্রযাত্রা শুরু হয় এ জড়বাদ একত্ববাদ দিয়ে। যেমনঃ দর্শনের জনক থেলিস পানিকে জগতের আদিসত্তা বলে স্বীকার করেন। অপরদিকে জগতের আদিসত্তা হিসেবে অতীন্দ্রিয় এক সত্তাকে স্বীকারকারী দার্শনিকদের বলা হয় ভাববাদি দার্শনিক। যেমনঃ হেগেল, সত্তাকে বলেছে- Absolute Reality স্পিনােজা Substance; লাইবানিজ সর্বশ্রেষ্ঠ Monadকে জগতের আদিসত্তা বলে স্বীকার করেন। এরই প্রেক্ষিতে একত্ববাদকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ (১) অধ্যত্ববাদী একত্ববাদ (২) জড়বাদী একত্ববাদ (৩) সবিচার একত্ববাদ।

(১) অধ্যাত্মবাদী একত্ববাদঃ অধ্যাত্মবাদী একত্ববাদ অনুসারে সত্তা হলাে আধ্যাত্মিক। অধ্যাত্মবাদী একত্মবাদীরা জড়বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্ব স্বীকার করে না। অধ্যাত্মবাদী একত্ববাদের আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ

(ক) অমূর্ত একত্ববাদঃ অমূর্ত একত্ববাদ অনুসারে এক বা পরমসত্তাই একমাত্র সত্য। এ জগতের বহুত্ব হলাে মিথ্যা। বহুত্ব অভ্যাসমাত্র। জগত হলাে পরমসত্তা আর পরম সত্তাই জগত। পরমসত্তার বাইরে কোনাে স্ব-অস্তিত্বশীল জগত নেই। পাশ্চাত্য দ্বিবাদী দার্শনিক স্পিনােজা এ মতবাদ প্রচার করেন। এমতবাদের প্রকৃতি আলােচনা করলে কতকগুলাে বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমনঃ

(i) জগত ও পরমসত্তার কোনাে প্রভেদ নেইঃ স্পিনােজার মতে কেবল এক পরমসত্তা সত্য, জগত মিথ্যা, জগত আর পরম সত্তার কোনাে প্রভেদ নেই। জগত হলাে পরমসত্তার আর এই পরমসত্তারই আর এক নাম জগত। পরমসত্তার বাইরে কোনাে জগত নেই। স্পিনােজার এ মতকে অনেকে নিরপেক্ষ একত্ববাদ নামেও পরিচিত।

(i) ঈশ্বরই একমাত্র দ্রব্যঃ স্পিনােজার মতে সত্তা একটি উপাদান আদি বস্তু হলাে দ্রব্য। দ্রব্য হলাে স্বনির্ভর ও স্বাধীন। সত্তা দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল আর এ দ্রব্য হলাে ঈশ্বর। ঈশ্বরই সব, ঈশ্বরের বাইরে কোনাে কিছু নেই। ঈশ্বর ছাড়া কোনাে কিছু সত্য নয়। ঈশ্বরই একমাত্র দ্রব্য।

(iii) নিরপেক্ষ একত্ববাদঃ স্পিনােজার এ সম্পর্কীয় মতবাদটি নিরপেক্ষ মতবাদ নামে পরিচিত। কেননা তিনি এক নিরপেক্ষ স্বাধীন দ্রব্য বা ঈশ্বর সত্তায় বিশ্বাসী। এ সত্তা নিজরূপের মধ্যেই বিরাজমান। ঐ সত্তাকে নির্ণয় করা যায় না।

(খ) মূর্ত একত্ববাদঃ মূর্ত একত্ববাদ অনুসারে এ জগতের পশ্চাতে পরম সত্তার অস্তিত্ব আছে। আর জগত হলাে পরমসত্তারই প্রকাশ। এ সত্তা বহুর মাঝে নিজেকে উপলব্ধি করছে। সুতরাং জগত অলীক নয়। জগতেরও সত্তা আছে। জগত ও পরমসত্তা একটি ছাড়া আরেকটি অর্থহীন। প্রখ্যাত জামার্ন দার্শনিক হেগেল এ মতবাদের প্রবর্তক।

(i) পরমসত্তা হলাে বিভেদের মাঝে ঐক্যঃ হেগেল তার দার্শনিক আলােচনায় ঈশ্বরকে পরমসত্তারূপে কল্পণা করেছেন। পরমসত্তা হলাে বিভেদের মধ্যে ঐক্য। বৈচিত্রের মাঝে সামঞ্জস্য। বহুর মাঝে এক। প্রকৃতিও সসীম নয় সত্য। প্রকৃতি হলাে পরমসত্তার প্রকাশমাত্র।

(ii) পরমসত্তা জগতের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেঃ হেগলের মতে, পরমসত্তা নিজের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। নিজেকে প্রকাশ ও উলব্ধির মাধ্যমে তার প্রকৃত পরিচয় মেলে। আর এ প্রকাশ ও উপলব্ধির মাধ্যম হিসেবে সে ব্যবহার করে জগতকে।

(iii) পরমসত্তার প্রকাশের বিভিন্ন স্তরঃ হেগেলের মতে, জড় হলাে পরমসত্তা প্রকাশের সর্বনিম্ন স্তর। আর জীবন বা প্রাণ হলাে উচ্চতর স্তর। জীবাত্মা হলাে আরাে উচ্চতর স্তর। মানবাত্মা হলাে পরমসত্তার প্রকাশের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে উচ্চতম স্তর।

(২) জড়বাদী একত্ববাদঃ জড়বাদী একত্ববাদ অনুসারে বিশ্বের আদি উপাদান হলাে জড়াে বস্তু। চৈতন্য বা চিন্তন হলাে জড়ের গুণ বা ধর্ম। প্রাণ হলাে জড়ের জটিলতম রূপ। যেমনঃ থেলিস পানিকেই (জড়) জগতের আদি উপাদান মনে করেন।

(৩) সবিচার একত্ববাদঃ এই মতবাদ বাস্তব সত্তার একক বস্তুকে নির্বিঘ্নে স্বীকার করে বহুত্বকে একত্বের অন্তর্ভক্ত বলে মনে করে। এ মতবাদ অনুসারে সত্তা জড়াত্মক নয়, আধ্যাত্মিক নয়; বরং জড় ও মনের কারণ। এই মতবাদ জড় ও মনের দ্বৈত ধারণাকে অদ্বৈত ধারণায় রূপান্তর করে।

সমালােচনাঃ একত্ববাদ সামালোচনের উর্ধ্বে নয়। এর সমালোচনা নিম্নরূপ-

প্রথমতঃ একত্ববাদীরা একত্বকেই এমমাত্র সত্য বলে স্বীকার করে। তাদের মতে সত্তা হলাে এক বহু হলাে অভ্যাসমাত্র। কিন্তু বহুতের মধ্যে প্রকাশিত ঐক্যই যথার্থ ঐক্য। এ ছাড়া ঐক্য ও বহুত্ব পরস্পর সাপেক্ষ। একটি সত্য অন্যটিও সত্য হতে বাধ্য।

দ্বিতীয়তঃ অনেক একত্ববাদী দার্শনিক আমাদের অভিজ্ঞতার জগতকে মিথ্যা বলে মনে করেন, কিন্তু আমরা জানি, আমাদের অভিজ্ঞতার জগত মিথ্যা নয় বরং পরমসত্য।

তৃতীয়তঃ একত্ববাদীরা সত্তাকে জগতের কারণ ও জাগতিক দ্রব্যের সমাহার বলে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু আমাদের জীবনের পরম আদর্শ ও মূল্যের কোনাে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা একত্ববাদীদের কাছে পাওয়া যায়নি।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সত্তা বিষয়ক মতবাদের মধ্যে একত্ববাদই একমাত্র গ্রহণযােগ্য মতবাদ বলে মনে হয়। কারণ বহু সত্তার সাহায্যে জাগতিক বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করলেও এ বিভিন্ন সত্তার মধ্যে অনিবার্য ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। একাত্ববাদের মধ্যে মূর্ত একত্ববাদ সত্তা, জগত ও জীবন সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। এই মতবাদ জড় ও মনকে একই পরমসত্তারই দুটি দিক বলে মনে করে। মূর্ত অদ্বৈতবাদ থেকে একেশ্বরবাদীর উদ্ভব। আমাদের ধর্মীয় অনভতি এমতবাদকে স্বীকার করে। সুতরাং সত্তা বিষয়ক মতবাদগুলাের মধ্যে একত্ববাদই একমাত্র গ্রহণযোেগ্য মতবাদ।