প্রশ্নঃ সত্তাবিষয়ক মতবাদ হিসেবে অদ্বৈতবাদ ও বহুত্ববাদ ব্যাখ্যা কর। এ দু’টির মধ্যে কী সমন্বয় সম্ভব?

অথবা, সত্তাবিষয়ক মতবাদ হিসেবে একত্ববাদ ও বহুত্ববাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।

অথবা, সত্তাবিষয়ক মতবাদ হিসাবে সত্তাবাদ ও বহুত্ববাদ ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ বিশ্বতত্ত্বের সৃষ্টি ও বিকাশ নিয়ে এবং এর আদি উৎস নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। যার কারণে সৃষ্টিতত্ত্বের উৎস হিসেবে ‘একাত্ববাদ’ ‘দ্বৈতবাদ’ ‘বহুত্ববাদ’সহ বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। নিম্নে এ বিষয়ে আলােকপাত করা হলাে-

অদ্বৈতবাদঃ অদ্বৈতবাদ বা একত্মবাদ অনুযায়ী বিশ্বজগতের আদিসত্তা একটি; দুই বা বহু নয়। বিশ্বের সবকিছুই একটিমাত্র মৌলিক সত্তা থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ জগৎবিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র সত্তার বিশৃঙখল স্তুপ নয়। কিংবা দুটি ভিন্নধর্মী উপাদানের সমন্বয়ও নয় বরং তা একই পরমসত্তার বিচিত্র প্রকাশ। সমগ্র বিশ্বজগৎ একটি আঙ্গিক ঐক্য, জড় ও মন একই ঐক্যের বিভিন্ন প্রকাশ। অর্থাৎ এক হচ্ছে সত্তা, আর বহুরূপী এই বিচিত্র বিশ্ব হচ্ছে এক পরম সত্তার অবসিক রূপ। এমনি করে একত্মবাদ একই সঙ্গে বহুত্ববাদ ও দ্বৈতবাদের অসারতা প্রমাণ করে এবং এক পরম সত্তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। একত্মবাদের দু’টি রূপ। যথা-

(ক) অমূর্ত একত্ববাদঃ এই মতবাদ অনুযায়ী এক পরমসত্তাই সত্য। জগতের বহুত্ববা বৈচিত্র্য মিথ্যা। স্পিনােজার মতে, শুধুমাত্র এক পরমসত্তাই সত্য, একমাত্র ঈশ্বরই পরমসত্তা। ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। অনন্ত ও অসীম। তিনিই একমাত্র দ্রব্য যা, স্বনির্ভর যার অস্তিত্ব অন্য কিছুর ওপর নির্ভরশীল নয়। এবং যাকে নির্ণয় করা যায় না। বৈচিত্র্যময় জগৎ মিথ্যা এটা ঈশ্বর বা পরমসত্তার অবভাসমাত্র। জগৎ আর পরমসত্তা অভিন্ন; জগৎই পরমসত্তা এবং পরমসত্তাই জগৎ। ঈশ্বরের অসংখ্যা গুণের মধ্যে আমরা কেবল দুটিকে জানি। গুণ দু’টো হচ্ছে বিস্ততি ও চেতনা। এরা দু’টি সমান্তরাল গুণ। বৈচিত্র্যময় জগতের সব বস্তুই বিস্তৃতি ও চেতনার প্রকাশ। একমাত্র ঈশ্বরই সব এবং সবই ঈশ্বর। তিনিই সত্য ও স্বনির্ভর। তার বাইরে কিছু নেই, তিনি ব্যতীত কিছুই সত্য নয়। এ মতবাদ সর্বেশ্বরবাদ নামেও পরিচিত। অনুরূপভাবে শংকর বলেন, ব্ৰহ্ম বা পরমসত্তাই একমাত্র সত্তা, জগৎ মায়া ও মিথ্যা। জীব ও স্রষ্টা অভিন্ন। স্রষ্টা মায়া থেকেই এই জগৎ সৃষ্টি করেছে এবং মায়াতেই তার পরিণতি।

(খ) মূর্ত একত্ববাদঃ দার্শনিক হেগেলের মতে, জগতের পেছনে এক পরমসত্তা আছে এবং এই বৈচিত্র্যপূর্ণ জগৎ তারই মূর্ত প্রকাশ। পরমসত্তা বহুর মাঝে নিজেকে প্রকাশ করে। পরমসত্তা বা ঈশ্বরই একমাত্র সত্তা এবং জগতের সবকিছুই ঈশ্বরেরই অনিবার্য অংশ। জগৎ মিথ্যা বা অলীক নয়, ঈশ্বর ও জগৎ উভয়ই সত্য। জগৎ ছাড়া পরমসত্তা এবং পরমসত্তা ছাড়া জগৎ অর্থহীন। জড় ও জীবজগৎ এক পরমসত্তা থেকেই উদ্ভূত। পরমসত্তা হচ্ছে বিভেদের মধ্যে ঐক, বৈচিত্র্যের মধ্যে সংহতি, বহুর মাঝে এক। সৃষ্টিজগতের স্তরভেদ আছে। উচ্চতম স্তরে আছে মানবাত্মা, মধ্যবর্তী স্তরে আছে জীবাত্মা এবং সর্বনিম্ন স্তরে আছে জড়বস্তু। ঈশ্বর বা পরমাত্মা জগতের ভেতরেও আছেন, বাইরেও আছেন। এই মতবাদ সর্বেশ্বরবাদ নামে পরিচিত। অনুরূপভাবে দার্শনিক রামানুজ বলেন, ব্রহ্ম এক ও আদি। কেবল ব্রহ্মই সত্য নয়, জীব ও জগৎও সত্য। জীব ও জগৎ একই ব্রহ্মের অধীন।

অদ্বৈতবাদের সমালােচনাঃ

প্রথমত, এ মতবাদ অবাস্তব, কেননা এ মতবাদ এককে বহু হতে বিছিন্ন করে অথচ বহুর মধ্য দিয়েই একের প্রকাশ ঘটে থাকে। বৈচিত্র্য ছাড়া ঐক্য অনুধাবনযােগ্য নয়। বৈচিত্র্য ও ঐক্য, এক ও বহু পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত। এ ছাড়া এ মতবাদের অনিবার্য পরিণতি সর্ববাদ বাস্তবকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয়।

বহুত্ববাদ: বহুত্ববাদের মতে, এ বিশ্বজগৎবিভিন্ন ধরনের উপাদানে পরিপূর্ণ। এসব উপাদান স্বতন্ত্র এবং এক থেকে অন্যতে বিচ্ছিন। পরিদশ্যমান জগৎ বৈচিত্র্যে ভরা, এ বৈচিত্র্যই প্রমাণ করে যে, পরিদৃশ্যমান জগতের পেছনে অসংখ্য সত্তা রয়েছে। এ বৈচিত্র্যময় বিশ্বের সন্ধান এক বা দু’য়ের মাঝে পাওয়া যায় না। এর সন্ধান মিলে একমাত্র বহুর মাঝে। বহুত্ববাদের চারটি রূপ আছে।

(ক) জড়াত্মক বহুত্ববাদঃ গ্রিক দার্শনিক এস্পিডক্লিস এ মতবাদের সূচনা করে বলেন, আগুন, পানি, মাটি ও বায়ু এ চারটি মূল উপাদানের সমন্বয়ে জগতের সবকিছু সৃষ্টি। তারপর ডেমােক্রিটাস প্রবর্তন করেন জড় পরমাণুবাদ। কোনাে দ্রব্যকে ক্রমাগত বিভক্ত করা হলে শেষ পর্যন্ত যেসব অবিভাজ্য সূক্ষ্ম কণা পাওয়া যায় তাকে পরমাণু বলে। পরমাণুগুলাে বহুলাংশে বিক্ষিপ্ত ও ঘূর্ণায়মান অবস্থায় ছিল এবং তারপর তাদের আকস্মিক সংযােগ ও বিয়ােগের ফলে এই জড় জগতের উৎপত্তি হয়। জড় পরমাণু থেকে কোনাে জীবদেহ ও প্রাণের অবির্ভাব ঘটেছে এবং জীবদেহের স্নায়ুকেন্দ্র ও মস্তিষ্ক থেকে মন বা চেতনার উৎপত্তি হয়েছে। এ মতানুযায়ী ঈশ্বরের কল্পনা ছাড়াই পরমাণুর আকস্মিক সংযােগ ও বিয়ােগের সাহায্যে জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়কে ব্যাখ্যা করা হয়।

(খ) আধ্যাত্মিক বহুত্ববাদঃ এই মতবাদের প্রবর্তক লাইবনিজ বলেন, মােনাড বা চিৎপরমাণু হচ্ছে জগতের আদিম উপাদান। মােনাড হলাে মূর্ত, বিস্তৃতিহীন, স্বতন্ত্র ও গবাক্ষহীন আধ্যাত্মিক বিন্দু, যা গাণিতিক বিন্দু ও জড়বিন্দু থেকে ভিন্ন। এটি অবিভাজ্য, স্বনির্ভর, আত্মকেন্দ্রিক, চেতনসক্রিয় এবং সংখ্যায় অগণিত। এরা পরস্পরের ওপর প্রভাব বিস্তার বা ক্রিয়া করে না।

(গ) প্রয়ােগবাদী বহুত্ববাদঃ এ মতবাদের প্রবর্তক উইলিয়াম জেমস বলেন, এ জগৎ স্বাধীনতাহীন ও বৈচিত্র্যহীন নয় বরং বহু স্বতন্ত্র বস্তুর সমষ্টি। এই বিচিত্র ও অভিনবজগৎ ঈশ্বরের প্রকাশ নয়। এর স্বাধীন অস্তিত্ব আছে এবং বস্তুসমূহের বহুরূপ স্বাতন্ত্র্য, স্বনির্ভরতা, বিচ্ছিন্নতা, বিশৃঙ্খলা, অভিনবত্ব, স্বাধীনতা ও বৈচিত্র্য এসবই সত্য। প্রকৃতপক্ষে এ জগৎ এক নয়, বহু।

(ঘ) নব্য বস্তুবাদী বহুত্ববাদঃ নব্য বস্তুবাদীদের মতে, জগতের যেমন বহুবস্তু আছে তেমনি বহু মনও আছে। এ জগৎ এক আঙ্গিক ঐক্য নয় বরং বহু বস্তুর সমষ্টি। এদের সম্পর্ক বাহ্যিক; অভ্যন্তরীণ নয়। সত্তার স্তরভেদ আছে, জড় নিম্নস্তর, প্রাণ উচ্চস্তর এবং মন উচ্চতম স্তর। জড় থেকে প্রাণ এবং প্রাণ থেকে মনের উন্মেষ ঘটে।

বহুত্ববাদের সমালােচনাঃ বহুত্ববাদের বিরুদ্ধে সমালােচকরা বিভিন্ন আপত্তি উত্থাপন করেছেন। নিচে এগুলাে আলােচনা করা হলাে-

(ক) জড়াত্মক বহুত্ববাদ অযৌক্তিকঃ জড়াত্মক বহুত্ববাদীদের মতে পরমাণুগুলাের পারস্পরিক আকর্ষণ ও বিকর্ষণ, সংযােগ ও বিয়ােগ, মিলন ও বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ আকস্মিক। কিন্তু প্রশ্ন হলাে অচেতন জড় পরমাণুগুলাে কী করে আকস্মিকভাবে সুশৃঙ্খল পরিদৃশ্যমান জগতের সৃষ্টি করতে পারে, তা বােঝা দুষ্কর।

(খ) প্রয়ােগবাদী বহুত্ববাদ আত্মবিরােধপূর্ণঃ লাইবনিজ তার চিৎপরমাণুবাদে বলেছেন, স্বরূপগতভাবে চিৎপরমাণুগুলাে এমন যে, এদের একটি কখনও অন্যটির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তাহলে চিৎপরমাণুগুলাের চিৎপরমাণু হিসেবে ঈশ্বর কীভাবে অন্য চিৎপরমাণুকে প্রভাবিত করতে পারেন তা আমাদের কাছে বােধগম্য নয়। এদিক থেকে লাইবনিজের এ মতকে আত্মবিরােধপূর্ণ মতবাদ বলা যায়।

অদ্বৈতবাদ ও বহুত্ববাদের মধ্যে সমন্বয় কি নাঃ সত্তাবিষয়ক মতবাদ হিসেবে অদ্বৈতবাদ ও বহুত্ববাদ উভয়েই উল্লেখযােগ্য মতবাদ হলেও এককভাবে কোনােটিই জগৎ ও জীবনের সুশৃঙ্খল ব্যাখ্যা দিতে পারে না। কেননা এরা পরস্পরবিরােধী মতবাদ। বহুত্ববাদও অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে একটাবলিষ্ঠ যুক্তিগ্রাহ্য পদক্ষেপ। কিন্তু এটা চরম মতবাদ। তবে এদের তত্ত্বগুলাের মধ্যে নিহিত সত্যগুলাের সার সংকলন এবং সমন্বয় করে জগজ্জীবনের একটি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দাঁড় করানাে যায়। আর এ সমন্বয় লক্ষ্য করা যায় অদ্বৈতবাদে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সত্তাবিষয়ক মতবাদ হিসেবে দার্শনিকরা একত্ববাদ, বহুত্ববাদ, দ্বৈতবাদসহ বিভিন্ন মতবাদ দিয়েছেন। এই মতবাদের মাধ্যমে দার্শনিকরা সত্তাকে ও জগতের আদি উৎসকে ব্যাখ্যা ও প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। যা সত্তাবিষয়ক ধারণাকে আরাে স্পষ্ট করে।