বাংলা সাহিত্যে সতীনাথ ভাদুড়ী তেমন ভাবে পরিচিত নাম নয়। কারণ নিছক মনভোলানোর জন্যে বা বিনোদনের জন্যে তিনি উপন্যাস বা গল্প রচনা করেননি। তাঁর রচনার মধ্যে রয়ে গেছে সমাজের এমন এক স্তরের কথা যা বিনোদনযোগ্য বলা যেতে পারে না। যা নিতান্তই চিন্তাশীল সমস্যা। সে সমস্যা কখনো সামাজিক, কখনো রাজনৈতিক। সাহিত্য সমালোচক বসুমিত্র মজুমদারের কথায়, “তিনি (সতীনাথ) বলেছেন জনসংযোগ-মানবপ্রীতি-মননশীলতা-বৈদগ্ধ্যের পথ ধরে। বস্তুত তাঁর রচনা রীতিকে বলা যেতে পারে জনজীবন সংস্পর্শযুক্ত ইন্টালেকচুয়াল রচনা রীতি। বলা বাহুল্য এই ইন্টালেকচুয়াল রীতি অবশ্যই শুষ্ক শিক্ষাভিমান থেকে জাত নয়—মানবপ্রেম অনুভূতি থেকেই উৎসারিত।”
সতীনাথের গল্প মননশীলতায় ঋদ্ধ। প্রায়শই গল্পের কাহিনির চেয়েও মননশীলতায় তা মহীয়ান হয়ে ওঠে। আলোচ্য ‘চরণদাস এম.এল.এ. গল্পের মধ্যেও কাহিনির তুলনায় বক্তব্যের বা উপজীব্য বস্তুর আকর্ষণ অধিকমাত্রায় লক্ষিত হয়। যে কাহিনি বীজ নিয়ে গল্পটি পল্লবিত, তা সংক্ষিপ্ত। চরণদাস নামে এক এম.এল.এ. বহুদিন পরে তাঁর নির্বাচন ক্ষেত্রে এসে দেখেছেন, তাঁর প্রতি ভোটারদের আগ্রহ খুব একটা নেই। সকলেই যেন তাকে এড়িয়ে চলতে চাইছেন। আর সকলেরই আস্থা জগৎগুরু সহস্রানন্দের ওপর— যিনি প্রতিটি মানুষকে মানবিক মূল্যবোধের উপদেশ দিয়ে থাকেন। চরণদাস ভেবে দেখলেন, জনসমর্থন লাভ করতে হলে তাঁকে সহস্রানন্দের সহায়তা লাভ করতে হবে। সেই অনুযায়ী সহস্রানন্দের আশ্রমে গিয়ে দেখলেন, সহস্ৰানন্দ নয়, তাঁকে লাভ করতে হবে জনগণনায় নিয়োজিত এক সরকারী কর্মচারী মৌলবী সাহেবের। ঘটনাচক্রে সেই মৌলবী সাহেবকেই তিনি সকাল বেলা অপমান করে পার্টি অফিস থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অগত্যা জন সমর্থন লাভের আকাঙ্ক্ষায় চরণদাস সেই মৌলবী সাহেবের পায়ে ধরে তাঁর কৃপা প্রার্থনা করলেন।
এইটুকু আখ্যান বস্তু নিয়ে গঠিত ছোটগল্পটি রচনা করতে লেখক তাঁর মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন। তিনি সাদামাটা ভাবে এম.এল.এ. সাহেবের কার্যকলাপ, গ্রামবাসীদের হাঁটাচলা আচার আচরণ বর্ণনা করে গেছেন। নিজে জোর করে কোথাও কোনো মত প্রকাশ করেননি। এমনকি চরণদাসের কর্ম পদ্ধতি ও তুলে ধরেছেন তারই স্বগত চিন্তা তুলে ধরে। চরণদাসের স্বগতচিত্তা থেকেই পাঠক জানতে পারে চরণদাস এম.এল.এ.-র চালাকির কথা। সবাই বুঝে গিয়েছে যে, তাঁর চিঠিতে সরকারী মহলে কোনো ফল হয় না। যাঁদের কাছে তিনি চিঠি দেন তাঁদের সকলের কাছে আগে থেকে বলা আছে যে এসব সুপারিশপত্রের ওপর কোন গুরুত্ব দেবার দরকার নেই। তাই স্বাভাবিক ভাবেই গ্রামবাসীদের কাছে চরণদাস উপেক্ষিত।
চরণদাসের পার্টি অফিসের যারা কর্মী তারা চরণদাসের থেকে টাকা নিয়ে জনসংযোগ রক্ষার কাজটি করে থাকে। তারা যে চরণদাসের প্রতি ঈর্ষু তা স্পষ্ট হয়ে তাদের চাঁচাছোলা ভাষায় চরণদাসকে আক্রমণ করার মানসিকতায়। এই রকম এক অদ্ভুত বাস্তবতায় গঠিত বচকন মাহাতো কিংবা লখনলালজীর মতো চরিত্রগুলি। এরা পথও দেখায় আবার বিদ্রুপও করে। এরা চরণদাসের কীর্তিকলাপ বা কর্মপন্থা সব জানে। আর সেই জন্যেই আঘাত না করে কথা বলতে পারে না। এরাই আবার চরণদাসকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার উপায় খুঁজে বার করে।
আলোচ্য গল্পের মধ্যে সতীনাথ তথাকথিত দেশসেবকদের কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অনেক কাছ থেকে এই সম্প্রদায়কে দেখেছেন বলেই সম্ভবত এমন নিপুণ ভাবে বিদ্রূপ করতে পেরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন চরণদাসের মতো বিধায়করা ‘মায়লে ভাই কিংবা ইয়েমিয়েলিয়ে সাহাব হিসেবেই সাধারণের চোখে প্রতিভাত হয়ে থাকেন। অর্থাৎ আদতে এরা এদের আত্মকেন্দ্রিক কাজের জন্যে জনতার কাছে ময়লার মতোই অশ্রদ্ধেয়। কাহিনির মধ্যে হাইকমাণ্ড’-কে ‘হায় কমাণ্ড’ বলেছেন। কেন না, চরণদাসের মতো জনসেবকদের লুটে পুটে খাওয়ায় তিনি যে বাধা দিয়ে থাকেন। তাই হায় হায় করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। গল্পের কেন্দ্রীয় চরণদাসের নামও বিদ্রূপাত্মক। স্বার্থসর্বস্ব মায়লেরা তারই মতো পরিস্থিতি দেখে এর ওর তার চরণের দাস হয়ে এম.এল.এ. হয়ে ওঠেন। আর যে জনতার রায়ে এঁরা এম.এল.এ হন, এঁদের চোখে সেই সমস্ত ‘পাবলিক অবুঝ, জনতা খামখেয়ালী, জনতা নিমকহারাম।’
সমগ্র গল্পটি সতীনাথ রচনা করেছেন এমন এক চমৎকার কৌশলে যেখানে তাঁর এই সমস্ত বিদ্রূপগুলি মিছরির ছুরির মতো বিধতে পারে সচেতন জনসেবকদের মনে। কিন্তু গল্প রচনার কৌশলের মধ্যে কোথাও কোনো পক্ষপাত দেখতে পাওয়া যায় না। ইচ্ছাকৃত ভাবে কোনো চরিত্রটিরই তিনি গুণকীর্তন বা দোষবর্ণন করেননি। পক্ষপাতহীন চমৎকার রচনাশৈলীটির জন্যে আলোচ্য গল্পটি পাঠক চিত্তে যে গভীর দাগ কাটতে সমর্থ হয়েছে সে কথা বলাই বাহুল্য।
Leave a comment