যে কোনো সাহিত্য কর্মের নামকরণ তখনই সার্থক হয়ে ওঠে, যখন দেখা যায়, গল্পের মর্মকথা কিংবা প্রধান চরিত্র কিংবা উদ্দেশ্য বিশেষ ভাবে প্রতীয়মান হয়, কিংবা শিরোনামে তার আভাস বা বিম্বন ঘটে। সাহিত্যস্রষ্টারাও সেই নামকরণের বিষয়ে বিশেষ যত্নবান হয়ে থাকেন। আমাদের আলোচ্য সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘চরণদাস এম.এল.এ.’ গল্পটি সম্বন্ধেও এই একই কথা বলা যায়। এখানে গল্পের নামকরণ সার্থক হয়ে উঠেছে দুটি কারণে, প্রথমত গল্পের প্রধান চরিত্রের নামানুসারে এবং তারও পরে গল্পের মধ্যে বিশেষ উদ্দেশ্য দ্যোতিত হবার কারণে।

সতীনাথ গল্পের নামকরণের অনেক সময় যেমন কাহিনির মুখ্য চরিত্রের নাম ব্যবহার করেছেন, তেমনি ক্ষেত্র বিশেষে মূল ঘটনাকেও এ বাবদে আশ্রয় করেছেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, ‘ষড়যন্ত্র মামলার রায়’, ‘বাহাত্তুরে’, ‘জোড়-কলম’ ইত্যাদি। আবার কাহিনির মুখ্য চরিত্রের নাম অবলম্বনে নামকরণ প্রবণতা দেখা যায়, ‘পত্রলেখার বাবা’, ‘মুনাফা ঠাকুরণ’, ‘ডাকাতের মা’ প্রভৃতি গল্পের শিরোনামে। কিন্তু এই সাধারণ নামকরণের সঙ্গে ‘চরণদাস এম.এল.এ.’ গল্পের নামকরণের প্রধান তফাৎ এই যে, চরণদাসের শুধু চরিত্র নয়, সেই সঙ্গে চরণদাসদের মতো সমস্ত সুবিধাবাদী মানুষদের মুখোশ টেনে ছেঁড়ার আয়োজন করেছেন।

গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র চরণদাস সাধারণ ঘরের ছেলে হিসেবে যখন ছিলেন তখন তিনি শ্রীচরণদাস নামে পরিচিত ছিলেন। নির্বাচনে জয়ী হবার পর তাঁর নাম সরকারি খাতায় লেখা হত ‘চরণদাস এম.এল.এ’। কিন্তু বিধায়কের নামের সঙ্গে যখনই ‘এম.এল.এ শব্দটা জুড়ে দেওয়া হয় তখনই শিরোনামটি বিশেষ বিবেচ্য হয়ে ওঠে।

চরণদাস বিধায়ক হবার পর গ্রামস্থ নিজের পৈতৃক বাড়িটি সরকারকে ভাড়া দিয়ে সপরিবারে শহরে অবস্থান করেন। তাতে সুবিধা এই যে যথা সময়ে ভাড়াটা পাওয়া যায়, আর বাড়িটিও আমজনতার দখল থেকে মুক্ত রাখা যায়। আর শহরে বাস করার ফলে তাঁরও কাজ চালানোয় যেমন সুবিধা হয়, তেমনি শহরের জল হাওয়ার ফলে তাঁর স্ত্রীর পুরোনো অম্বলেরও উপশম হয়। মাঝে মাঝে তাই কোনো প্রয়োজনে গ্রামে এলে তিনি থাকেন সার্কিট হাউসে। কিন্তু এবারে জনসংযোগের কাজে এসেছেন বলেই তিনি উঠেছেন পার্টি অফিসে। তিনি ভোটার ভোটারীর চরণের দাস হয়েই জয়ী হতে চান। তাঁদের চরণের দাস হয়েই এতকাল নির্বাচনে জয়ী হয়ে এসেছেন। এবারেও তাই এসেছেন চরণদাস নির্বাচন কেন্দ্রের আমজনতার চরণসেবা করতে। কিন্তু এসে দেখেছেন, জনতারা তাঁকে এড়িয়েই চলছেন। পার্টি অফিসে নিজেদের মধ্যে অনেক আলাপ আলোচনার পর জানতে পারলেন যে, সেখানে জগৎগুরু সহস্রানন্দ আশ্রম করেছেন। তিনি সিদ্ধপুরুষ। গ্রামস্থ সকলেই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে। প্রতিটি মানুষের মধ্যে যে অনন্ত সম্ভাবনা বিদ্যমান, জগৎগুরু এই কথাটাই তাঁর শিষ্য সেবকদের জানিয়ে তাদের মুখে বুলি ফুটিয়েছেন। তাদের জীবনে নতুন আশার আলো দেখিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে চরণদাস তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, সহস্রানন্দের চরণের দাস হয়েই তিনি জনসংযোগ বাড়ানোর ব্যবস্থা করবেন। সেই মতো সপারিষদ বিকেল বেলা সহস্রানন্দের আশ্রমে গিয়ে দেখলেন, গুরুদেবের ঘরের দরজা বন্ধ আর ভক্তশিষ্যরা অসীম দুঃখে মৌন হয়ে আছে।

আবার পরিস্থিতি বদল হল। চরণদাস জানতে পারলেন, সকালে তাঁদের পার্টি অফিসে যে মৌলভীকে তিনি অপমান করে মেরে তাড়াচ্ছিলেন, সেই মৌলভী জনগণনার কাজ করতে এসে মানুষের তালিকায় সহস্রানন্দের নাম লিখে নিয়ে গেছেন। অর্থাৎ, একজন বিধর্মী, ভগবান স্বরূপ গুরুদেবকে মানুষের তালিকায় গুণে অপমান করেছেন। সেই অপমানের জবাব দেবার ক্ষমতা ভক্তদের নেই বলেই তারা বিষণ্ন হয়ে বসে আছে। ফলে চরণদাসও সিদ্ধান্ত বদল করলেন, জন সংযোগ রক্ষা করতে এবার আর শ্রীগুরু-চরণ-দাস হলে চলবে না, এবার তাঁকে মৌলভী-চরণ-দাস হতে হবে। এবং গল্পের পরিণতিতে দেখা যায়, সকালে যাকে অপমান করে তাড়িয়েছিলেন, সেই মৌলভী সাহেবের দুটো পা জড়িয়ে ধরেই তাঁকে এবারের ভোটের বৈতরণী পার হতে হচ্ছে। সার্থকনামা চরণদাসরা এ ভাবেই বিভিন্ন জনের চরণের দাস হয়ে এম.এল.এ. পদে উন্নীত হন।

আসলে চরণের দাস না হয়ে যে চরণদাসরা এম.এল.এ. হতে পারেন না। সে চরণ ভোটারেরই হোক বা সহস্রানন্দেরই হোক বা কোনো বৈরীরই হোক, এম.এল.এ. হতে চরণদাসরা পরিস্থিতি অনুযায়ী যে কোনো চরণই আশ্রয় করতে পারেন। মূলত এই সত্যটি গল্পের মধ্যে দ্ব্যর্থহীন ভাবে তুলে ধরার জন্যে গল্পের ‘চরণ দাস এম.এল.এ.’ নাম যে সার্থক হয়ে উঠেছে তা বলাই বাহুল্য।