চণ্ডীদাসের আলোচ্য পদটি একটি সুখ্যাত ও সার্থক ‘পূর্বরাগ’ বিষয়ক পর্যায়ের পদ। চণ্ডীদাসকে ‘পূর্বরাগ’ পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ পদকর্তা হিসাবে চিহ্নিত করা চলে। ‘পূর্বরাগ’ পর্যায়ের পদগুলি আলোচনা করে দেখা যাক-
বৈষ্ণব কবিগণ রাধাকৃষ্ণের লীলাকে যে ভাবে দেখেছেন তাতে প্রত্যেকের দর্শনের মধ্যে নিজস্বতা লক্ষণীয়। বিদ্যাপতির সঙ্গে যেমন চণ্ডীদাসের দৃষ্টিভঙ্গির সাদৃশ্য নেই, তেমনি চণ্ডীদাসের সঙ্গে গোবিন্দদাসের ঘটেছে পার্থক্য। চণ্ডীদাস রাধিকাকে দেখেছেন উন্মাদিনী বেশে—
“এলইয়া বেণী ফুলের গাঁথনি
দেখয়ে খসায়ে চুলি।
হসিত বয়ানে চাহে মেঘপানে
কি কহে দুহাত তুলি।”
পূর্ব রাগময়ী রাধিকার গভীর হৃদয়টি তাঁর মতো আর কেউ ফোটাতেও পারেননি। ‘রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা’, অস্তর ধনে ধনী রাধিকা কৃষ্ণসমর্পিতা প্রাণা এবং হৃদয়ার্তির প্রকাশ চণ্ডীদাসের পদেই সর্বোত্তম। বলা যায় মানব হৃদয়ের চিরন্তন প্রেম তাঁর পদে বাণীমূর্তি লাভ করেছে। এখানে রাধিকা তাঁর তনু-মন সমস্তই কৃষ্ণের প্রতি উৎসর্গ করেছেন। তাই আপনার সর্বস্ব উৎসর্গ করে তিনি ধ্যাননিমগ্ন আপনি অন্তরের গহন প্রদেশে সহনশীলা, তিনি ধ্যানযোগিনী—
“সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘপানে
না চলে নয়ানতারা।
বিরতি আহারে রাঙা বাস পরে
যেমতি যোগিনী পারা।।”
চণ্ডীদাসের পূর্বরাগের একটি উল্লেখযোগ্য পদ—‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম’। কবি চণ্ডীদাস সহজে কবি সর্বার্থেই। তিনি সহজভাবেই মনের কথা প্রকাশ করেন। তাই রাধা ভাবে তন্ময় চণ্ডীদাস যখন আকুল কণ্ঠে বলে ওঠেন—‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম’—তখন সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমনও সাড়া দিয়ে ওঠে। এই শ্যাম নাম বিরহ-ব্যাকুল পাঠকেরও ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে’ প্রবেশ করে। কৃষ্ণের সঙ্গে তখনও রাধার সাক্ষাৎ হয়নি শুধু শ্যামনাম শুনেই তাঁর চিত্তে পূর্বরাগের ভাব সৃষ্টি হয়েছে, এবং রাধা সেই সুন্দর কাস্তি পরম পুরুষ কৃষ্ণকে প্রাপ্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন গভীর প্রত্যাশায়। চণ্ডীদাসের বর্ণনা গুণ ও কাব্য গুণের অনবদ্য মেলবন্ধনে রাধা হৃদয়ের সেই গোপন গহন প্রেমবাসনা কাব্য পংক্তিতে শুধুমাত্র আবদ্ধ না থেকে পাঠক হৃদয়ে অভিঘাত হানে ও পাঠক চিত্তকে আলোড়িত করে। তাই তো কৃষ্ণপ্রেমে অবগাহন করার তৃষ্মা বুকে নিয়ে চণ্ডীদাসের রাধা বলতে পারেন—
“কাহারে কহিব মনের মরম
কেবা যাবে পরতীত
মনের মাঝারে মরম বেদনা
সদাই চমকে চিত।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদা বলেছেন—“চণ্ডীদাস গভীর এবং ব্যাকুল। (তিনি) আসিয়া চিরপুরাতন প্রেমের গান আরম্ভ করিয়া দিলেন। এপ্রেম অসহ্য মর্মস্পর্শী হৃদয়গ্রাহী।” চন্ডীদাসের নিম্নোক্ত পদে রবীন্দ্রনাথ কথিত এই উক্তির সার্থকতা লক্ষণীয়—
“অকথন বেয়াধি কহন নাহি যায়।
যে ধরে কানুর নাম ধরি তার পায়।।
পায়ে ধরি কাঁদে সে চিকুর গড়িযায়।
সোনার পুত্তলি যেন ভূমেতে লুটায়।।”
কৃষ্ণ বিরহে কাতর রাধা বসে আছেন চরম উদাসীন হয়ে। এক কৃষ্ণধ্যানেই আত্মবিস্মৃতা। তাঁর মনে কোনও সুখ নেই। কোনও কাজে মন দিতে পারছেন না। কৃষ্ণরূপ দর্শনের জন্য তাঁর মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। মরমীয়া কবি চণ্ডীদাসের কলমে তাই যে পংক্তি উঠে আসে তার মধ্যে ভেসে ওঠে শৈল্পিক কাব্যময়তা—
“সদাই চঞ্চল বসন অঞ্চল
সম্বরণ নাহি করে।
বসি থাকি থাকি উঠয়ে চমকি
ভূষণ খসিয়া পড়ে।।”
পূর্বরাগ পদে রাধার আপন স্বাতন্ত্র্যবোধের পরিচয় নেই। তিনি শুধু নাম জপ করতে করতেই অবাক হয়ে পড়েছেন। এই কৃষ্ণ-তন্ময়তাই রাধার জীবন। তাই মনে হয় বৃথাই তিনি ভাবছেন—
‘নাম-পরতাপে যার ঐছন করল গো
অঙ্গের পরশে কিবা হয়।”
এই দেহে সচেতনতা রাধিকার একান্তই সাময়িক। কারণ তাঁর প্রেম দেহের অনেক ঊর্ধ্বেই অবস্থিত।
বস্তুত চণ্ডীদাসের রাধার প্রেম বৃহত্তর জীবন উপলব্ধির সাধনা। সেখানে ‘কামগন্ধ নাহি তায়’। তাই ধ্যান-নিমগ্ন যোগিনী তিনি। চণ্ডীদাসের পদের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য হল ব্যঞ্জনা। ব্যঞ্জনাই যদি শ্রেষ্ঠ কবিত্বের লক্ষণ হয় তবে, পূর্বরাগময়ী রাধা চরিত্রের কল্পনায় চণ্ডীদাস নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। তাঁর এক একটি শব্দ-সংযোজনা অনুভূতি মিশ্রণ আমাদের হৃদয়-তারে যে সুরমূর্ছনা সৃষ্টি করে তা যেন ভাষাহীন। চণ্ডীদাসের কাব্যে অলংকারে প্রাধান্য ততটা পাওয়া যায় নি। আপাত নিরলংকার ভাষায় চণ্ডীদাস তাঁর পদগুলিতে কাব্য-নৈপুণ্যের যে পরিচয় দিয়েছেন তা অনবদ্য। পূর্বরাগের পদে চণ্ডীদাসের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন—“বস্তুত বেনুবীণার সঙ্গীত মুখর রসালাপের বিচিত্র অপার্থিব কাহিনির চিত্র চণ্ডীদাসের পূর্বরাগে বেশি পাওয়া যায় না। এখানে অনুরাগের নামে ঘোর বিরাগ, সংযমের নামে পার্থিব সুখের সম্পূর্ণ বিয়োগ।” চণ্ডীদাস সেই ঘোর বিরাগ ও রহস্যময়তার নিপুণ চিত্রকরের। অতএব চণ্ডীদাস পূর্বরাগের পদ-রচনায় সর্বার্থেই শ্রেষ্ঠ।
Leave a comment