পৃথিবীর যে কোনো ভাষার ও সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনায় দেখা যায়, সেই জগতে প্রথমেই পদ্যের সমুদ্র দেখা দেয়, পরে দেখা দেয় গদ্যের ভূভাগ। সংস্কৃত সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আদি সৃষ্টি ঋগবেদ পদ্যশ্লোকবিশিষ্ট; পরে যজুর্বেদ ও অথর্ববেদে গদ্য দেখা দিয়েছিল। আরও পরবর্তী ব্রাহ্মণসাহিত্য এবং সুত্রসাহিত্য তথা বেদাঙ্গসাহিত্যেও গদ্যের ব্যবহার ছিল অবাধ। কাত্যায়ন পাণিনি ব্যাকরণের যে বার্তিক রচনা করেছিলেন, তাতে ‘আখ্যায়িকা’র কথা উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, সংস্কৃত আলঙ্কারিকগণ গদ্যকাব্যের যে দুটি শ্রেণীবিভাগ কল্পনা করেছেন, তার একটি ঐতিহাসিক তথা বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে ‘আখ্যায়িকা’ এবং অপরটি কাল্পনিক কাহিনী অবলম্বনে ‘কথা’। পাণিনির অপর ভাষ্যকার পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্যে ও সাবলীল গদ্যের প্রয়োগ পাওয়া যায়। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী কালে রচিত তিনটি আখ্যায়িকা কাব্যের উল্লেখ করেছেন – ‘বাসবদত্তা’, ‘সুমনোত্তরা’ এবং ‘ভৈমরথী’। গ্রন্থগুলি বর্তমানে অপ্রাপ্য বলে এদের বিষয়বস্তু এবং রচনারীতি বিষয়ে আমরা অনবহিত হলেও এগুলি যে গদ্যরচনা ছিল, এ বিষয়ে সংশয়ের কোনো কারণ নেই। গুণাঢ্য-রচিত গ্রন্থের নাম ছিল ‘বৃহৎকথা’—অতএব এটিও কথ্যজাতীয় গদ্য; পঞ্চতন্ত্রের নামান্তর ‘তন্ত্রাখ্যায়িকা’—অতএব আখ্যায়িকা জাতীয় গদ্যকাব্য। কালিদাস-পূর্বযুগে সৌমিল ও রামিল-রচিত ‘শূদ্রককথা’ নামক একখানি গ্রন্থের কথা জানা যায়। গ্রন্থটি বিলুপ্ত-বিধায় এর বিষয়বস্তু অজ্ঞাত হলেও এটি যে কথাজাতীয় গদ্যকাব্য, তার প্রমাণ নামের মধ্যেই রয়েছে। বররুচি-রচিত ‘মনোবতী’, ‘চারুমতী’ ও ‘শাতকর্ণীহরণ’ নামক গদ্যকাব্যের প্রশংসা করেছেন দণ্ডী, গ্রন্থটি অবশ্য এখন আর পাওয়া যায় না। সংস্কৃত গদাকাব্যের রাজাধিরাজ বাণভট্ট ও জনৈক ভট্টার হরিচন্দ্রের গদ্যরচনার প্রশংসা করে বলেছেন : ‘ভট্টার হরিচন্দ্রস্য গদ্যবন্ধে। নৃপায়তে। অতএব ভট্টার হরিচন্দ্রও একজন অত্যুত্তম গদ্যকাব্য রচয়িতা ছিলেন বলে জানা যায়। এ সমস্ত ছাড়াও শ্রীপালিতের ‘তরঙ্গবতী, ধনপালের ‘তিলকমঞ্জরী’তে উল্লেখিত রুদ্র-রচিত ‘ত্রৈলোক্যসুন্দরী’ এবং কল্হণ কথিত শীলা ভট্টারিকা-রচিত গদ্যকাব্যের কথাও পূর্ববর্তী সাহিত্যিকগণ উল্লেখ করে গেছেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যবশত ধারাবাহিকক্রমে আগত সুমহান্ গদ্যকাব্যের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হয়েও আমরা বঞ্চিত রয়ে গেলাম। এক্ষণে সংস্কৃত রসসাহিত্যের ক্ষেত্রে দণ্ডী-সুবন্ধু-বাণ—এই তিন গদ্যকাব্যস্রষ্টাই সেই ঐতিহ্যের দায় বহন করবার জন্য বর্তমান রয়েছেন। অবশ্য এর বাইরে হিতোপদেশ পঞ্চতন্ত্র আদি গল্পসাহিত্য এবং ধর্ম-দর্শন-ব্যাকরণ-আদি জ্ঞানের বিষয় অবলম্বনে রচিত গদ্যসাহিত্যের প্রসঙ্গ এখানে আনা হয়নি।
সংস্কৃত গদ্যকাব্যকে (রসসাহিত্য) আলঙ্কারিকগণ দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করে থাকেন – ‘কথা’ এবং ‘আখ্যায়িকা। কোনো কোনো আলঙ্কারিক এতদুভয়ের মধ্যে একটা ভেদরেখা টানতে চাইলেও অনেকে আবার এই ভেদকে কৃত্রিম বলে অভিহিত করে থাকেন। দুয়ের মধ্যে পার্থক্যবিধানের প্রধান সূত্র এই—‘আখ্যায়িকা’ রচিত হয় ঐতিহাসিক ঘটনা তথা বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে, পক্ষান্তরে ‘কথা’ রচিত হয় কোনো কাল্পনিক কাহিনীকে অবলম্বন করে। দ্বিবিধ শ্রেণীভেদের প্রধান সমর্থক ভামহ। তিনি কাব্যালঙ্কারে বলেছেন যে ‘আখ্যায়িকা’ রচিত হবে সরল গদ্যে এবং ‘বৃত্তম্ আখ্যায়তে তস্যাং নায়কেন স্বচেষ্টিতম্’ এবং আখ্যায়িকার নায়ক নিজের অভিজ্ঞতার কাহিনীই এতে বর্ণনা করবেন। গদ্যের মাঝে মাঝে বক্র ও অপরবক্র ছন্দে রচিত শ্লোক থাকবে, এবং কাহিনীটি কতিপয় ‘উচ্ছ্বাসে’ বিভক্ত হবে। কন্যাহরণ, সংগ্রাম, বিরহের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত নায়ক জয়ী হবেন। আখ্যায়িকার ভাষা হবে সংস্কৃত। পক্ষান্তরে ‘কথা’ গদ্যকাব্য সংস্কৃত কিংবা অপভ্রংশেও রচিত হতে পারে। এতে বক্র বা তাপরবক্র ছন্দে কোনো শ্লোক থাকবে না, কিংবা ‘উচ্ছ্বাস’ ভাগও থাকবে না। নায়ক এর কাহিনী বর্ণনা করবেন না এবং এর কাহিনীটি হবে কল্পিত। দণ্ডী কিন্তু ‘কথা’ এবং ‘আখ্যায়িকা’র এই কল্পিত ভেদকে স্বীকার করেন না। তিনি এই দুটিকে পৃথক, সংজ্ঞাযুক্ত এক জাতীয় কাব্য বলেই মনে করেন।
দণ্ডী-রচিত দু’খানি গদ্যগ্রন্থের পরিচয় পাওয়া যায় ‘দশকুমারচরিত’ এবং ‘অবন্তীসুন্দরীকথা’য়। তবে শেষোক্ত গ্রন্থটির গ্রন্থকর্তৃত্ব নিয়ে মতদ্বৈধতা বর্তমান রয়েছে। আবার এই দণ্ডীই ‘কাব্যাদর্শ’ প্রণেতা দণ্ডী কিনা, সে-বিষয়েও পণ্ডিতগণ দ্বিমত পোষণ করেন। ‘দশকুমারচরিত’ তিন খণ্ডে বিভক্ত, এতে দশজন রাজকুমারের কাহিনী বিবৃত হয়েছে। অনেকেই অনুমান করেন, এর তিনটি খণ্ড পৃথক্ কালে পৃথক্ ব্যক্তিদের দ্বারা রচিত হয়েছিল। ‘অবন্তীসুন্দরীকথা’য় আত্মপরিচয় এবং পূর্ববর্তী কবিদের উল্লেখ রয়েছে। গ্রন্থটি ‘হর্ষচরিতে’র আদর্শে রচিত এবং ‘কাদম্বরী’র রচনারীতির সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত। আকস্মিকভাবে গ্রন্থটির সমাপ্তি ঘটেছে। দণ্ডী সম্ভবত সপ্তম শতকে বর্তমান ছিলেন।
প্রধান তিন গদ্যকাব্য-রচয়িতার অপরজন সুবন্ধু। তিনি বাণভট্ট এবং দণ্ডীর পূর্বে বর্তমান ছিলেন। তাঁর কাব্যের নাম ‘বাসবদত্তা’—এটি ‘কথা’ জাতীয় রচনা। শ্লেষ, বক্রোক্তি প্রভৃতি অলঙ্কার ব্যবহারে সুবন্ধু অতিশয় কুশলতার পরিচয় দিলেও এদের আতিশয্য মাঝে মাঝে পীড়াদায়ক বলে মনে হয়। পরবর্তী কবিদের ওপর তাঁর যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
আলঙ্কারিকগণ সাধারণভাবে বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত’ গদ্যকাব্যকে আখ্যায়িকার এবং ‘কাদম্বরী’ গদ্যকাব্যকে কথার নিদর্শনরূপে গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু ভামহের সংজ্ঞা মেনে নিলে উপরোক্ত গ্রন্থদ্বয়ের এম্ববিধ (অথবা এরম্বিধ) অভিধা সুপ্রযুক্ত মনে হয় না। তবে রুদ্রট আখ্যায়িকা ও কথার যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতে ‘হর্ষচরিত’ ও ‘কাদম্বরী’র ক্ষেত্রে এই আখ্যা যথাযথ। বাণভট্ট নিজেও কাদম্বরীকে ‘কথা’-রূপেই আখ্যায়িত করেছেন। অনুমান হয়, ভামহের সমকালে তাঁর নির্দেশিত লক্ষণাক্রান্ত আখ্যায়িত ও কথাকাব্য বর্তমান ছিল, পরে কোনো কারণে তাদের বিলোপ ঘটে থাকতে পারে। কেউ কেউ অবশ্য জৈনসম্প্রদায়ভুক্ত সোমপ্রুভসূরি রচিত ‘যশস্তিলকচম্পু কাব্যকে যথার্থ কথাকাব্য বলে স্বীকার করে থাকেন। যাহোক আলঙ্কারিকদের এই সূক্ষ্ম বাদ-বিতণ্ডায় প্রবেশ না করে আমরা অমরকোষের নির্দেশানুযায়ী আখ্যায়িকাকে বাস্তবভিত্তিক এবং কথাকে কাল্পনিক কাহিনী প্রধান বলে স্বীকার করে নিতে পারি—’আখ্যায়িকোপলধ্বার্যা’ এবং ‘প্রবন্ধকল্পনা কথা।
সংস্কৃত গদ্যসাহিত্যে বাণভট্ট অবিসংবাদিতভাবেই রাজাধিরাজের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। তিনি ‘হর্ষচরিত’ গ্রন্থে তাঁর পরিচয়ও জানিয়ে দিয়েছেন। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে বাণ সম্রাট হর্ষবর্ধনের রাজসভা অলঙ্কৃত করেছেন। তাঁর রচিত গদ্যকাব্য দুটি – ‘হর্ষচরিত’ এবং ‘কাদম্বরী’। আটটি উচ্ছ্বাসে রচিত আখ্যায়িকা কাব্য ‘হর্ষচরিত’ স্বীয় আত্মচরিত ছাড়াও কবি পুষ্যভৃতি থেকে হর্ষবর্ধন পর্যন্ত নৃপতিদের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। যে কোনো কারণেই হোক গ্রন্থটি অসমাপ্ত। ‘কাদম্বরী’ বাণভট্ট রচিত কথাকাব্য এবং গুণমানে সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যে এটিই শ্রেষ্ঠ গদ্যকাব্যের মর্যাদা লাভ করেছে। ‘কাদম্বরী’তে একটি গল্পের মধ্যে আরেকটি গল্প, তার মধ্যে আর একটি গল্প, এইভাবে যেন গল্পের লহরী চলেছে। এই গ্রন্থটিও বাণ শেষ করেন নি, তৎপুত্র ভূষণ গ্রন্থটি শেষ করেছেন বলে জানা যায়। রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরী সম্বন্ধে বলেন – ‘সমস্ত কাদম্বরী কাব্য একটি চিত্রশালা। বাণভট্ট পর পর চিত্র সজ্জিত করিয়া গল্প বলিয়াছেন—এজন্য তাহার গল্প গতিশীল নহে, তাহা বর্ণচ্ছটায় অঙ্কিত।”
Leave a comment