অথবা, সংস্কৃতি বলতে কী বােঝ? সংস্কৃতির সাথে সভ্যতার পার্থক্য আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ সংস্কৃতি সভ্যতার বাহন। সমাজজীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে গড়ে তুলে সংস্কৃতি মানবজীবনের ভিত্তি রচনা করে। আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে সংস্কৃতির অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত জীবনপ্রণালি সংস্কৃতির গতিকে সচল রেখেছে। সংস্কৃতির পথপরিক্রমার মধ্য দিয়ে সভ্যতা বিকাশ লাভ করে।
সংস্কৃতির সংজ্ঞাঃ ইংরাজি Culture শব্দের প্রতিশব্দ হলাে সংস্কৃতি। সংস্কৃতি হলাে মানুষের জীবন পদ্ধতি (Culture is the way of life.)। ক্ষুদ্রতর অর্থে সংস্কৃতি বলতে বুঝায় মার্জিত রুচি বা অভ্যাস জনিত উৎকর্ষ। কোনাে সমাজের সংস্কৃতি বলতে ঐ সমাজের প্রচলিত জীবনপ্রণালিকে বুঝানাে হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী সংস্কৃতিকে বিভিন্ন ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তা নিম্নে আলােচনা করা হলাে-
সমাজবিজ্ঞানী জোনস বলেন সমাজবিজ্ঞানী জোনস্ বলেন, ‘Culture is the sum of mans creations.’
ম্যালিনােস্কির মতে, মানুষের এমন সব কর্মই সংস্কৃতি, যার মাধ্যমে সে তার উদ্দেশ্য অর্জন করে।’
ম্যালিনস্কির তার ‘A Scientific Theory of Culture’ (P-67) গ্রন্থে বলেন, ‘As the handiwork of man and is the medium through which he achieves his end.’ অর্থাৎ মানুষের তৈরি বস্তুও একটি উপায় যার মাধ্যমে সে তার উদ্দেশ্যসাধন করে।
মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সংস্কৃতি হলাে Super structure, যেটা Basic structure-এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
সমাজবিজ্ঞানী টেইলর তার Primitive culture গ্রন্থে সংস্কৃতির উল্লেখযােগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেন। তার মতে, ‘সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত আচার-আচরণ, ব্যবহার, জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি-প্রথা, আইন ইত্যাদির সমাবেশই হলাে সংস্কৃতি।
সমাজবিজ্ঞানী Koening এর মতে, “Culture may be defined as the sum total of man’s efforts to adjust himself to this environment and to improve his modes of livings.”
সমাজবিজ্ঞানী আর, টি, শেয়ার তার Sociology (198) গ্রন্থে বলেন, ‘Culture is the totality of learned and socially transmitted behavior.’ অর্থাৎ সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজ থেকে অর্জিত এবং সামাজিকভাবে উত্তরসূরীদের মধ্যে বর্তায় এমন আচরণসমূহের সামগ্রিক রূপ।
ম্যাকেঞ্জি সংস্কৃতি অর্থে শিক্ষার কথা বলেছেন, তবে তা ব্যাপক অর্থে। ব্যাপক অর্থে শিক্ষা সংস্কৃতির সাধারণ পরিচয় বহন করে। শিক্ষা বলতে তিনি মানুষের আধ্যাত্মিক পরিবেশের বিকাশকে বুঝিয়েছেন।
সমাজবিজ্ঞানী পি.এ সরােকিন তার Social and Cultural Dynamics গ্রন্থে বলেন, ‘দুটি ব্যক্তির চেতন ও অচেতন ব্যবহারের যে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া তার ফলে সৃষ্ট ও পরিবর্তিত যা কিছু তার সমগ্রকতাই সংস্কৃতি। তার মতে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, কলা সবই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত।
সমন্বিত সংজ্ঞাঃ সংস্কৃতির উপযুক্ত সংজ্ঞা পর্যালােচনা করলে দেখা যা যে, সংস্কৃতি বলতে কেবলমাত্র মার্জিত রুচি, ব্যবহার বা অভ্যাসের উৎকর্ষতাকে বুঝায় না বরং সংস্কৃতি তা থেকে অনেক বেশি কিছু নির্দেশ করে। কেননা সংস্কৃতি হলাে মানুষের সামগ্রিক আচরণের সমষ্টি। মানুষের জাগতিক চিন্তাচেতনা, সৃষ্টি শৈলী, নৈপুণ্য, কর্মকুশলতা, আশা-আকাঙক্ষা, ভাষা, শিল্পকলা এবং সাহিত্যসহ সকল কিছুই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত।
সংস্কৃতি ও সভ্যতার পার্থক্যঃ সভ্যতা বলতে বুঝায় অগ্রসরমান-জটিল সংস্কৃতির একটা স্তর বা পর্যায়। এ অর্থে সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে তেমন পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। এ প্রসঙ্গে ম্যাকাইভার বলেন, “Our culture is that we are our civilization is that we use.” তবে সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান । নিম্নে পার্থক্যসমূহ তুলে ধরা হলাে-
পরিশেষঃ উপযুক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে নানা পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা ওতপ্রােতভাবে জড়িত। যেকোনাে দেশের সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ওপরই নির্ভর করে সভ্যতার বিকাশ অবস্তুগত সংস্কৃতির বস্তুগত রূপায়ণই সভ্যতা।
Leave a comment