প্রশ্নঃ সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি বাংলাদেশের সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে আলােচনা কর।

অথবা, সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা বাংলাদেশের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে বর্ণনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি বা পশ্চাৎপদতা ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ সংস্কৃতি সভ্যতার বাহন। সমাজজীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে গড়ে তুলে সংস্কৃতি মানবজীবনের ভিত্তি রচনা করে। আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও উৎকর্ষসাধনে সংস্কৃতির অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত জীবনপ্রণালী সংস্কৃতির গতিকে সচল রেখেছে। সংস্কৃতির পথপরিক্রমার মধ্যদিয়ে সভ্যতা বিকাশ লাভ করে।

সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি বা সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতাঃ সমাজবিজ্ঞানী অগবার্ন ১৯২২ সালে প্রকাশিত তার ‘Social change’ নামক গ্রন্থে সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি তথা সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতার তত্ত্ব প্রদান করেন। অগবার্ণ সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য না করে বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতির পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। তার মতে, মানুষের বস্তুগত সংস্কৃতি যে গতি ও হারে বৃদ্ধি পায় বা এগিয়ে চলে অবস্তুগত সংস্কৃতি সে তুলনায় অনেক ধীরে এগিয়ে চলে। উভয় ধরনের সংস্কৃতির অসম গতিকেই তিনি সাংস্কৃতিক অসম অগ্রগতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

অগবানের মতে, বস্তুগত সংস্কৃতির তুলনায় অবস্তুগত সংস্কৃতি অনেক ধীরগতিতে এগিয়ে চলে। যার ফলে বস্তুগত সংস্কৃতির চেয়ে অবস্তুগত সংস্কৃতি অনেক পেছনে পড়ে থাকে। আর এটাই হলাে সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা।

অগবার্ন সংস্কৃতির অসম অগ্রগতির উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, শিল্প-কারখানা ও শিক্ষা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তাই শিল্প কারখানার কোনাে পরিবর্তন দেখা দিলে শিক্ষাব্যবস্থা বা প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু শিল্পকারখানার পরিবর্তনের হারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্ভব হয় না। ফলে সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতার সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কৃতির অসম অগ্রগতিজনিত সমস্যাঃ বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের সমাজ শহুরে ও গ্রামীণ এ দু ভাবে বিভক্ত। ফলে উভয় ধারার সমাজের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। এ জন্য সংস্কৃতির অসম অগ্রগতির ফলে বাংলাদেশের সমাজে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। নিচে এগুলাে তুলে ধরা হলাে-

(১) সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতাঃ বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও এ দেশে শিল্পের কিছুটা প্রসার ঘটেছে। এ দেশের কৃষি ও শিল্পে বিদেশি প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অথচ ঐ প্রযুক্তিকে কাজ লাগাবার মতাে এ দেশে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। ফলে আমরা কৃষি ও শিল্প থেকে প্রযুক্তির আশানুরূপ ফল পাচ্ছি না। অর্থাৎ দেশে যে হারে প্রযুক্তি আসছে সে হারে প্রযুক্তিগত জ্ঞান না বাড়ার ফলে সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা দেখা দিচ্ছে।

(২) নগর মানসিকতার অভাবঃ বাংলাদেশে শিল্পায়ণ ও নগরায়ণ যতটুকু বিস্তার লাভ করেছে, সে অনুসারে নাগরিক সুবিধা ও নগর মানসিকতা গড়ে উঠেনি। ফলে নগর পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ঘন বসতি, ময়লা-আবর্জনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বস্তুত পরিবেশ দূষণ থেকে নগরকে রক্ষা করার তেমন কোনাে ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। যার ফলে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কেননা শিল্পায়ণ ও নগরায়ণ শুধু করলেই হবে না সেই সাথে নগর ও শিল্প জীবনের সাথে নিজেকে খাপখাইয়ে নেয়ার জন্য নিজের মানসিক ও জ্ঞানগত বিদ্যাকেও সমৃদ্ধ করতে হবে। যতদিন এটা না করা সম্ভব হবে ততদিন নগর জীবনে সাংস্কৃতিক অসমতা দেখা যাবে।

(৩) বেকার সমস্যাঃ কৃষির আধুনিকীকরণের ফলে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার জন্য অল্পসংখ্যক লােকের দরকার। অর্থাৎ অল্প লােকই অধিক জমি চাষ করতে পারে। কাজেই কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হলে পরিবারের সদস্যরা বেকার হয়ে পড়বে। এ জন্য কৃষি প্রযুক্তির সাথে চলতে গিয়ে আমাদের দেশে সংস্কৃতির অসম অগ্রগতিজনিত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার-এর সাথে সাথে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা যারা বেকার হয়ে পড়ছে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করলে সমাজে নানা সমস্যার সৃষ্টি হবে।

(৪) দক্ষ জনশক্তির অভাবঃ কৃষি ও শিল্পের পাশাপাশি অফিস-আদালত, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই আজ উন্নত প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছে। যেমনঃ কম্পিউটার, ফ্যাক্স, ই-মেইল, ফটোকপি মেশিন, ইলেকট্রিক টাইপ ইত্যাদি। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করার মতাে প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকায় এগুলাের ব্যাপক সার্ভিস থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। পাশাপাশি এসব টেকনিক্যাল কাজ-কর্মের প্রশিক্ষণ না থাকায় সমাজের একটি বিরাট বেকার জনগােষ্ঠী কর্মের সংস্থান করতে পারছে না।

(৫) শহুরে ও গ্রামীণ সমাজের মধ্যে সংস্কৃতি গত পার্থক্যঃ বাংলাদেশের সব অঞ্চলে একই হারে সমান গতিতে অগ্রগতি হচ্ছে না। দেখা যায় কোনাে কোনাে অঞ্চল বিশেষ কারণে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর কোনাে কোনাে অঞ্চল সুযোগ-সবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে পেছনে পড়ে থাকছে। আমাদের দেশে শহুরে সমাজের সাথে গ্রামীণ সমাজের পার্থক্য অত্যন্ত প্রকট। যদিও গ্রামীণ সমাজে শহুরে সমাজের ঢেউ লেগেছে। তবে তা অত্যন্ত নগণ্য। শহুরের সংস্কৃতি এখনাে আভিজাত্য ও বিদেশি ভাবধারায় পুষ্ট। গ্রামীণ সংস্কৃতি ঐতিহ্যনির্ভর এবং সনাতন। ফলে বাংলাদেশের সমাজে সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি দেখা দিয়েছে।

(৬) উৎপাদন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের পার্থক্যঃ সংস্কৃতির অসম অগ্রগতির কারণে সমাজে নানা ধরনের অপরাধ এবং বেকারত্ব, দারিদ্র্য, হতাশা ইত্যাদি দেখা দিচ্ছে। যেমনঃ বলা যায় আমাদের দেশে উৎপাদন যন্ত্র বা তার মান যতটুকু যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সাথে সঙ্গতি রেখে জনসংখ্যা না বেড়ে অধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে সমাজের মধ্যে উৎপাদন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের মধ্যে বিশাল পার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে। যার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হতাশা, বেকারত্ব, দরিদ্রতা প্রভৃতি। তাই অবশ্যই একদিকে যেমন কৃষিতে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে তেমনি উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সংগতি রেখে জনসংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। তা না হলে সমাজে নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, পৃথিবীর সব সমাজেই সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি রয়েছে। যেহেতু প্রত্যেকটি সমাজ বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত, আর প্রত্যেক স্তরের সংস্কৃতিতে রয়েছে ভিন্নতা, এ জন্য সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি দেখা যায়। বাংলাদেশের সমাজেও সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি বিদ্যমান। এ জন্য এ দেশের সমাজের ভারসাম্য ও স্বাভাবিক গতিকে ত্বরান্বিত করার জন্য সংস্কৃতির অসম-অগ্রগতি দূর করা বাঞ্ছনীয়।