ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়—সংসদীয় বা মন্ত্রীসভা-চালিত শাসনব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা। শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভিত্তিতে যে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়, তাই হল সংসদীয় শাসনব্যবস্থা। সংসদীয় বা মন্ত্রীসভা-চালিত শাসনব্যবস্থা কতকগুলি শর্তের ওপর নির্ভর করে। এগুলি হল—
[1] শক্তিশালী দলীয় ব্যবস্থা: সংসদীয় শাসনব্যবস্থার সাফল্য সুগঠিত দলীয় ব্যবস্থার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সুগঠিত দলীয় ব্যবস্থা বলতে অনেকে দ্বিদলীয় ব্যবস্থার কথা বলেন। সংসদীয় ব্যবস্থায় শাসন বিভাগের স্থায়িত্ব আইনসভার ওপর নির্ভর করে। তাই যদি বহুদলীয় ব্যবস্থা থাকে তাহলে অনেক সময় দেখা যায় যে কোনো দলই নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায় না। ফলে জোট সরকার গড়ে ওঠে, যার স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। যদি দুটি দল থাকে, তাহলে একটি দল সরকার গঠন করে এবং অন্য দল বিরােধী দলের ভূমিকা পালন করে। এরূপ ক্ষেত্রে সরকার স্থায়ী হয়।
[2] শক্তিশালী বিরােধী দল: সংসদীয় শাসনব্যবস্থার সাফল্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল শক্তিশালী বিরােধী দলের উপস্থিতি। বিরােধী দল শক্তিশালী হলে, শাসকদলের কাজকর্মে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা থাকে। বিরােধী দল দুর্বল হলে শাসিত দলও বিরোধী দলকে অগ্রাহ্য করে। এ ছাড়াও অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে সরকারের পতন হলে বিরােধী দলকে সরকার গঠন করার মতাে অবস্থায় থাকতে হয়।
[3] দায়িত্বশীল দলীয় ব্যবস্থা: সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকার গঠনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলির গভীর সম্পর্ক থাকে। সেকারণে রাজনৈতিক দলগুলিকে দায়িত্বশীল হতে হয়। সরকার গঠন করাই যদি দলগুলির উদ্দেশ্য হয়, তাহলে জাতীয় স্বার্থের পরিবর্তে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ প্রাধান্য পায়। রাজনৈতিক দলগুলির কর্মসূচির মধ্যে পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে ঐক্যমত্য প্রয়ােজন। অন্যথায় সংসদীয় শাসনব্যবস্থা দলীয় শাসনব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়।
[4] সর্বজনীন শিক্ষা: সংসদীয় শাসনব্যবস্থার সাফল্যের জন্য শিক্ষার প্রসার একান্ত আবশ্যক। জনসাধারণের একটা বিরাট অংশ যদি অশিক্ষিত ও অজ্ঞ হয় তাহলে সুস্থ জনমত গড়ে উঠতে পারে না। সুস্থ ও সবল জনমত ছাড়া সংসদীয় শাসনব্যবস্থা সফল হতে পারে না। জনগণ অশিক্ষিত হলে রাজনৈতিক নেতাদের বাক্চাত্নর্যে তারা সহজেই প্রভাবিত হয়ে পড়ে। ফলে ভালােমন্দ বিচার করার ক্ষমতা জনগণের থাকে না। এজন্য প্রয়ােজন উপযুক্ত রাজনৈতিক শিক্ষার, যাতে নাগরিকগণ সচেতনভাবে তাদের ভােটাধিকার প্রয়ােগ করতে পারে।
[5] নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম: গণতন্ত্রে সুস্থ জনমত গ্রহণের জন্য নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমেরও প্রয়ােজন। সংবাদমাধ্যমও যদি নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনের পরিবর্তে সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে সংবাদ পরিবেশন করে, তাহলে তা সংসদীয় ব্যবস্থাকে দুর্বল করে। কারণ, উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ জনগণকে বিভ্রান্ত করে। বর্তমানে সংবাদপত্র, দূরদর্শন, বেতার ইত্যাদি গণমাধ্যম জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশকে প্রভাবিত করে। সেকারণেই সমস্তরকম নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করা একান্ত প্রয়ােজন।
[6] দারিদ্র্যদূরীকরণ: ব্যাপক দারিদ্র্য যে-কোনাে ব্যবস্থাকেই দুর্বল করে তােলে। একারণে বলা হয় যে, সংসদীয় ব্যবস্থার সাফল্যের জন্য দারিদ্র্যদূরীকরণ অত্যন্ত আবশ্যক। দারিদ্র্যদূরীকরণ ছাড়া গণতন্ত্র সফল হতে পারে না। দারিদ্র্য মানুষকে লােভী ও দুর্নীতিগ্রস্ত করে তােলে। ফলে জনসাধারণ নিরপেক্ষ ও নির্ভীকভাবে ভােটাধিকারও প্রয়ােগ করতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলি দারিদ্র্যের সুযােগ নিয়ে নাগরিকদের প্রতারিত করে।
উপসংহার: উপযুক্ত শর্তগুলি পূরণ হলেই যে সংসদীয় ব্যবস্থা সফল হবে তার কোনাে নিশ্চয়তা নেই। কারণ সংসদীয় ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করে সচেতন জনমতের ওপর। জনগণ সচেতন হলে সরকার সহজেই সুপথে চালিত হয়।
Leave a comment