সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্র উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই একটি ধারা হিসাবে পরিগণিত হয়। প্রাচীনকালে গ্রীস দেশে বর্তমান গণতান্ত্রিক চিন্তাধারার গণতান্ত্রিক প্রকৃতি প্রসঙ্গে বিতর্কের অবকাশ আছে। মধ্যযুগেও গণতান্ত্রিক ভাবনার তেমন বিকাশ ঘটেনি। ইউরোপীয় রাজনীতিক চিন্তাজগতে রাজনীতিক কর্তৃত্বের সীমানা, অধিকার, আইন, আনুগত্য প্রভৃতি বিষয়াদির আবির্ভাব ও বিকাশ ঘটেছে সামন্ততান্ত্রিক প্রভাব-প্রতিপত্তির অবক্ষয়ের পটভূমিতে। ডেভিড হেল্ডের লাভ। অনুযায়ী প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারের ধ্যান-ধারণা রাষ্ট্রচিত্তার উপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। লুথার ও ক্যালভিনের চিন্তা-ভাবনা এবং সংস্কার আন্দোলন রাষ্ট্রচিন্তার ধারার উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। সংস্কার আন্দোলনের সুবাদে ধর্মীয় নিগড়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে জাগতিক ক্রিয়াকর্ম এবং ব্যক্তি মানুষের চিন্তা-ভাবনা মুক্তি পেয়েছে, ব্যক্তিকে সার্বভৌম প্রকৃতি প্রদান করা হয়েছে।

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার পুনরুত্থান ঘটে। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীর গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা প্রাচীন গ্রীসের ধ্রুপদি গণতান্ত্রিক ধারণার থেকে পৃথক প্রকৃতির। এই সময় গণতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণায় রাজনীতিক ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণের উপর তত গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি, গণতন্ত্রকে দেখা হয়েছে সরকারী হস্তক্ষেপের হাত থেকে সুরক্ষা লাভের একটি উপায় হিসাবে। এই কারণে গণতন্ত্রের এই রূপ বা মডেলটিকে বলা হয়েছে সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্র। জনসাধারণ শাসকদের কাছ থেকে ত বটেই এমন কী সামগ্রিকভাবে সুরক্ষা পেতে চায়। তারা আশা করে যে সরকারী নীতিসমূহ জনসাধারণের সামগ্রিক স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। প্রথম দিককার উদারনীতিক চিন্তাবিদ্রা এই ধারণার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিধিকে সম্প্রসারিত করার ব্যাপারে তাঁরা বিশেষভাবে আগ্রহী ও আন্তরিক ছিলেন। বিশিষ্ট আধুনিক রাজনীতিবিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “The desire to protect the individual from over-mighty government was expressed in perhaps the earliest of all democratic senitiments, Aristotle’s response Plato: guis custodict custodes?’ (‘Who will guard the Guardians?)।

ডেভিড হেল্ডের অভিমত অনুযায়ী গণতন্ত্রের নতুন উদারনীতিক মডেল সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্র হিসাবে পরিচিত। গণতন্ত্রের এই মডেল সম্পর্কিত ধারণা পরিণতি লাভ করেছে জেমস মিল ও জেরেমি বেন্থামের চিন্তা-চেতনার সুবাদে। অবশ্য এই ধারণার বিকাশে মেকিয়াভেলি, হবস ও লকের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্রের প্রাথমিক প্রবক্তা হিসাবে মেকিয়াভেলি, হবস ও বিশেষ করে লকের নাম উল্লেখযোগ্য। ‘ধ্রুপদি উদারনীতিবাদ’ ও ‘পৌর মানবিকতাবাদী’ রাষ্ট্রচিত্তার এই দুই ধারা পঞ্চদশ, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর রাষ্ট্রচিন্তাজগতে উদীয়মান ধারা হিসাবে পরিচিত। ইতালির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নিকোলো মেকিয়াভেলি এই দুটি ধারার সূত্রপাত করেন। ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টমাস হবস ও জন লক উদারনীতিক ঐতিহ্যের প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত।

মেকিয়াভেলী এবং হবসের অবস্থান সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্রের ধারণা প্রসঙ্গে প্রথমেই আসে। এঁদের দুজনেরই মূল লক্ষ্য ছিল যে একটি সমাজে, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকই যথাযথ এবং যুক্তিসম্মতভাবে আত্ম স্বার্থ সংরক্ষণে লিপ্ত, সেখানে কি ধরনের সরকার গড়ে ওঠা উচিত। হবস এখানে স্পষ্ট করে বলছেন যে একমাত্র লেভিয়াথানের মত এক দোর্দন্ডপ্রতাপ রাষ্ট্র ক্ষমতাই নাগরিকদের বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। আবার এই অনুসঙ্গে লক মন্তব্য করছেন যে, আত্ম-স্বার্থ অনুসরণকারী নাগরিকদের স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন এক রাজনৈতিক সাম্যের পরিবেশ, যেখানে নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রাষ্ট্র বা অন্য কেউ যাতে বিঘ্নিত করতে না পারে তার বন্দোবস্ত করা। এইভাবে সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকের রাজনৈতিক লেখাপত্রে সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্রের ধারণা নির্মিত হচ্ছে।

নিকোলো মেকিয়াভেলি: ইতালির রাষ্ট্রদার্শনিক মেকিয়াভেলি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আধুনিকতার পুরোধা হিসাবে পরিচিত। ইতালিতে রেনেসাঁসের সময় নতুন করে নগর জীবন বিকশিত হয়। এই সময় আবার প্রাচীনকালের গ্রীক ও রোমান প্রজাতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার পুনরুত্থান ঘটে। পরিবর্তিত পরিমণ্ডলে নগর-রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। এই নগর-রাষ্ট্রের মধ্যে প্রজাতান্ত্রিক নাগরিকতার ধারণার আবার আবির্ভাব ঘটে। সমকালীন ইতালির নগর-রাষ্ট্রের ধারণায় এথেন্সীয় ধ্রুপদি ‘পোলিস’ (Polis) বা নগর-রাষ্ট্রীয় ধারণা এবং গণতান্ত্রিক আদর্শ গুরুত্ব লাভ করে।

মেকিয়াভেলির মতানুসারে স্থায়ী ও সুরক্ষিত রাষ্ট্রই হল ভালো রাষ্ট্র। এই ধারণার মধ্যেই নিহিত আছে মেকিয়াভেলির গণতান্ত্রিক মতবাদের মূল। তাঁর অভিমত অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই শাসিতকে শাসকের হাত থেকে সুরক্ষা দেওয়া যাবে। আবার এই পথেই পরস্পরের হাত থেকে শাসকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা যাবে। তাঁর আরও মত হল যে, সংগঠিত রাজনীতিক শক্তি ব্যতিরেকে সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সমাজের মুখ্য গঠনমূলক উপাদান হল এই রাজনীতি। রাজনীতির কাজ হল ক্ষমতা অর্জন করা, ধরে রাখা এবং প্রয়োগ করা। রাজনীতির উপর মেকিয়াভেলির অগাধ আস্থা ছিল। রাষ্ট্রীয় ধারণা এবং রাজনীতিক শৃঙ্খলার প্রতি মানুষের আনুগত্যের উপর তিনি বিশেষ জোর দিয়েছেন। উপযুক্ত নেতৃত্বের মাধ্যমে মেকিয়াভেলি রাজনীতিক স্বাধীনতা ও স্থায়িত্ব সংরক্ষণের কথা বলেছেন। তাঁর মতানুসারে রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কিত তাঁর ধারণাকে কার্যকর করার জন্য সঙ্গে সঙ্গে সংহতি ও শৃঙ্খলা সংরক্ষণের জন্য আবশ্যক যোগ্য নেতৃত্ব। সুযোগ্য নেতৃত্ব প্রসঙ্গে তিনি স্বৈরী শাসকের কথা বলছেন। এই স্বৈরী শাসককে সম্পদশালীও হতে হবে। মেকিয়াভেলি রাজনীতিক অংশগ্রহণের তত্ত্বকে স্বীকার ও সমর্থন করেছেন। তিনি সকল শ্রেণীর মানুষের রাজনীতিক অংশগ্রহণের বিষয়টিকে তুলে ধরেছেন। মেকিয়াভেলির ভাবনা সম্পূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক এমন দাবি অমূলক। তবে ডেভিড হেল্ডের বিচার-বিবেচনায়, সমকালীন বিচারে মেকিয়াভেলি অবশ্যই গণতান্ত্রিক ছিলেন। আধুনিক রাষ্ট্রের রূপরেখা তাঁর চিন্তাভাবনায় ধরা পড়েছিল। তিনি শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত।

টমাস হবস: হসব এক সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রশক্তির কথা বলেছেন। এই রাষ্ট্রশক্তিকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সামাজিক ও রাজনীতিক শৃঙ্খলা সুনিশ্চিত করার স্বার্থে; ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাকে নিরাপদ করার লক্ষ্যে। এই কারণে সামাজিক ও রাজনীতিক শৃঙ্খলার প্রবক্তা হিসাবে হবস পরিচিত। হবস যে রাষ্ট্রের কথা বলেছেন তা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক, এমন কথা বলা যায় না। এতদ্‌সত্ত্বেও হবসের কাছে এই রাষ্ট্র সার্বভৌম এবং জনগণের প্রতিনিধি। হবসের রাষ্ট্রচিন্তার কতকগুলি উল্লেখযোগ্য বিষয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। এই বিষয়গুলি হল: মানব প্রকৃতির প্রকাশের উপযুক্ত অবস্থা; মানুষের অভিপ্রেত নিয়ন্ত্রণের বৈধ ব্যবস্থা; সমাজ সম্পর্কিত মানুষের বাঞ্ছিত বিষয়; নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য চুক্তির মাধ্যমে মানুষের সম্মতি প্রভৃতি। রাষ্ট্রচিন্তায় উদারনীতিক ঐতিহ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে হবসের এই সমস্ত তাত্ত্বিক বক্তব্যের সদর্থক অবদান অনস্বীকার্য।

হবসের রাষ্ট্রচিত্তাকে সর্বাংশে উদারনীতিক আখ্যায় ভূষিত করা যায় না। ডেভিড হেল্ডের নজর তা এড়িয়ে যায় নি। হবসের রাষ্ট্রতত্ত্বে নাগরিকের স্বাধীন ইচ্ছা মূল্য পায় নি। একে গণতান্ত্রিক বলা যায় না। হবসের সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র এবং সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক সিদ্ধান্তসমূহকে সর্বাংশে উদারনীতিক বলা যায় না।

জন লক: সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক চিন্তায়, বিশেষ করে লকের রচনায়, গণতন্ত্রের যে ধারণা লক্ষ্য করা যায় তা হল সরকার বা রাষ্ট্রের আধিপত্যকে প্রতিহত করে কিভাবে ব্যক্তি নাগরিকের ব্যক্তি-স্বাধীনতা সংরক্ষণ সম্ভব। লকের মতে মানুষ কতকগুলি অবিচ্ছেদ্য, অলঙ্ঘনীয় প্রাকৃতিক অধিকার ভোগ করে যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সম্পত্তির অধিকার। রাষ্ট্র একদিকে যেমন ব্যক্তির সম্পত্তির ওপর করের মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে তেমনি এর বিরুদ্ধে ব্যক্তি নাগরিকও রাষ্ট্রের কর নির্ধারণকারী সংস্থা আইনসভার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণসম্মতির ওপরই সরকার নির্ভরশীল। ইংরেজ দার্শনিক জন লক ‘গৌরবময় বিপ্লব (১৬৮৮)’ এবং রাজতন্ত্রের পুনরুত্থানের সমর্থক হিসাবে সুবিদিত। সংরক্ষিত গণতন্ত্রের ক্ল্যাসিক্যাল প্রবক্তাদের মধ্যে লকের নামই প্রথমে উচ্চারিত হয়। লকের রাষ্ট্রচিন্তার অন্তর্ভুক্ত মূল বিষয়গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: সরকারের বৈধতা, মানুষের স্বাভাবিক অধিকার, নিরাপত্তা প্রভৃতি। লক রাজকীয় ক্ষমতার উপর সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন।

লকের মতানুসারে প্রকৃতির রাজ্য ছিল স্বাধীনতার রাজ্য। কিন্তু নৈতিকতার আদর্শ অবলম্বনের জন্য আইনের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। প্রকৃতির রাজ্যে কিছু অসুবিধার কারণে মানুষের স্বাভাবিক অধিকার সুরক্ষিত ছিল না। এই কারণে লক আইনের রাজ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। প্রকৃতির রাজ্যে সম্পত্তির সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। স্বভাবতই প্রকৃতির রাজ্যে স্বাধীন সমাজ ও রাজনীতিক সমাজ অর্থাৎ সরকার গঠনের ব্যাপারে মানুষ উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করে। স্বাধীন সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে প্রথমে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। শাসিতের বা মানুষের অধিকারের সুরক্ষাকে সুনিশ্চিত করার জন্য দ্বিতীয় একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। তার ফলে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকারের উপর বর্তায় মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব। সার্বভৌম ক্ষমতা জনসাধারণের হাতেই থাকল। শর্ত সাপেক্ষে এই ক্ষমতা ব্যবহারের অধিকার সরকারকে দেওয়া হল। সরকারের বৈধতা ও শাসন জনসাধারণের সম্মতির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। আইনত সরকারের ক্ষমতা হল বিভাজ্য এবং সীমাবদ্ধ। বস্তুত লক সাংবিধানিক রাষ্ট্রের কথা বললেন। চুক্তির শর্তাদি অমান্য করলে সরকারের বিরুদ্ধে জনসাধারণ বিদ্রোহ করতে এবং নতুন সরকার গঠন করতে পারবে।

লকের অভিমত অনুযায়ী মানুষের ভোটাধিকার স্বাভাবিক অধিকার (natural rights)-এর অস্তিত্বের উপর, বিশেষত সম্পত্তির অধিকারের অস্তিত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। সরকার যদি করের মাধ্যমে নাগরিকের সম্পত্তির অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে, তা হলে নাগরিকদেরও অধিকার আছে নিজেদের সুরক্ষার জন্য কর আরোপকারী সংস্থার গঠনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার; অর্থাৎ আইনসভার গঠন নিয়ন্ত্রণ করার। সুতরাং গণতন্ত্র বলতে সম্মতিমূলক এক সরকারী ব্যবস্থা (government by consent)-কে বোঝায়। প্রতিনিধিমূলক আইনসভার মাধ্যমে এ রকম সরকারী ব্যবস্থা সক্রিয় হয়। তবে আধুনিক রাজনীতি বিজ্ঞানী হেউড মন্তব্য করেছেন: “… Locke himself was not a democrat by modern stands as he believed that only property owners should note, on the basis that only they had natural rights that could be infringed by government.”-এর মতানুসারে লক্‌কে বিদ্যমান মানদণ্ডে গণতন্ত্রী বলা যায় না। কারণ তিনি কেবলমাত্র সম্পত্তির মালিকদেরই ভোটাধিকার প্রদানের পক্ষপাতী ছিলেন। কারণ কেবল তাদেরই স্বাভাবিক অধিকার আছে, যে অধিকারে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে।

লকের অভিমত অনুযায়ী রাজনীতিক কার্যকলাপের মধ্যেই জনসাধারণের সুরক্ষার অবস্থা অন্তর্ভুক্ত আছে। লকের রাষ্ট্রচিন্তার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী কালে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা, জনপ্রিয় সার্বভৌমত্ব, মানুষের অধিকারের সংরক্ষণ, শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্র, সরকারের ক্ষমতার বিভাজন প্রভৃতি ধারণা বিশেষভাবে বিকশিত হয়। ডেভিড হেল্ডের অভিমত অনুযায়ী লকের রাষ্ট্রতত্ত্বের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল সূত্রসমূহের সুত্রপাত ঘটেছে।

লকের গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার সীমাবদ্ধতার দিকটিও ডেভিড হেল্ডের নজর এড়িয়ে যায় নি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কিছু মৌলিক বিষয় লকের নজরে আসেনি। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল রাজনীতিক দলব্যবস্থা, দলীয় শাসন, নির্বাচন ব্যবস্থা, ভোটাধিকারের ভিত্তি, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের এক্তিয়ার বা পরিধি, প্রতিরোধের অধিকারের প্রেক্ষিত প্রভৃতি।

মন্টেস্কু: অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসী দার্শনিক মন্টেস্কুও সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্রের বিকাশে অবদান যুগিয়েছেন। সংরক্ষণূলক গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ হল ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি। এই নীতির প্রবক্তা হিসাবে মন্টেস্কু রাজনীতিক চিন্তাজগতে অমর। ডেভিড হেল্ড সংরক্ষণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আলোচনায় মন্টেস্কু এবং তাঁর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের ধারণার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মন্টেস্কু চূড়ান্ত কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর পছন্দের রাষ্ট্র ব্যবস্থা হবে ভারসাম্যযুক্ত ও কল্যাণকামী। মন্টেস্কুর অভিমত অনুযায়ী স্বাধীনতার প্রকৃত পরিবেশ পাওয়া যাবে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ ও ভারসাম্যের মধ্যে। তাই তিনি সরকারের বিভাগসমূহের মধ্যে পার্থক্য, ক্ষমতার বিভাজন এবং ভারসাম্যের কথা বলেছেন। মন্টেস্কুর মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতার সমর্থনে যুক্তিকে ক্ষুরধার করা। এ বিষয়ে তিনি স্বাধীনতার ইংরেজ ধারাকে এবং লকের অবস্থানকে অনুসরণ করেছেন। তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অভিপ্রেত রূপরেখা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সুসংগঠনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। লক কিন্তু এ বিষয়ে নীরব ছিলেন। ব্যক্তি ও সমষ্টির জীবনকে নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মতান্ত্রিক এক আইনমূলক কাঠামোর পরিকল্পনা তাঁর ভাবনার মধ্যে ছিল। তিনি‌ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখাকে বাস্তবায়িত করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন।

জেমস ম্যাডিসন: ম্যাডিসনের সাংবিধানিক ধ্যান-ধারণাকে ডেভিড হেল্ড সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্রের অন্যতম চিরায়ত ধারণা হিসাবে বিবেচনা করেছেন। এডিসনের গণতন্ত্র সম্পর্কিত চিন্তাভাবনায় হবস, লক ও মন্টেস্কুর সুস্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

ম্যাডিসনের মতানুসারে রাজনীতি আত্মস্বার্থের উপর ভিত্তিশীল। এ বিষয়ে হবসীয় ঐতিহ্যের প্রভাব অনস্বীকার্য। মানবপ্রকৃতির পর্যালোচনার ক্ষেত্রে তিনি হবসের ধারণাকেই অনুসরণ করেছেন। শুদ্ধ ও প্রাচীন প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রকে তিনি সমর্থন করেন নি। এ রকম গণতন্ত্রে ব্যক্তির ও সম্পত্তির নিরাপত্তা নেই। কারণ প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে বিরোধ-বিদ্রোহের আধিক্য অনস্বীকার্য। এখানে রাজনীতিক ক্রিয়াকর্ম বিচার ও সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হয় স্বার্থ ও আবেগের দ্বারা। স্বভাবতই এখানে ব্যক্তির ও দুর্বলের স্বার্থ নিরাপদ নয়। শুদ্ধ প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি অপরিমিতির অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। এর প্রতিকারের জন্য তিনি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের কথা বলেছেন।

ম্যাডিসনের মতানুসারে ব্যক্তি স্বাধীনতা সংরক্ষণের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সংগঠন হল সরকার। কিন্তু এই সরকারকে শাসিতদের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। এবং জনসাধারণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। ম্যাডিসনের এই বক্তব্যের ক্ষেত্রে লকের সুস্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

আবার ম্যাডিসন ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে বৈধ রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। এ ক্ষেত্রে ম্যাডিসন মন্টেস্কুর ধারণাকে অনুসরণ করেছেন। তাঁর মতানুসারে সরকারী ক্ষমতার বিভাজনের মাধ্যমে দলাদলির প্রবণতা রোধ করা যাবে।

দলাদলি সম্পর্কে ম্যাডিসন বলেছেন যে, ক্ষুদ্র বা বৃহৎ সমষ্টির যে কোন অংশ দলাদলির মধ্যে থাকতে পারে। স্বার্থ বা আবেগের ভিত্তিতে তারা পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়। তারফলে অন্য গোষ্ঠীর অধিকারের সঙ্গে বিরোধিতার সৃষ্টি হতে পারে; জনসাধারণের গড় স্বার্থের বা সমাজের স্থায়ী স্বার্থের সঙ্গে প্রতিকূলতার সৃষ্টি হতে পারে। ম্যাডিসনের মতানুসারে প্রতিযোগী ও বিপক্ষ দল, স্বার্থের বিরোধিতা, বিরোধী মতামত, বিচার-বুদ্ধির ক্ষেত্রে ভিন্নতা প্রভৃতি অনিবার্য। কারণ মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই এ সবের অভিব্যক্তি দেখা যায়। তাঁর মতানুসারে শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমেই দলাদলির প্রতিকূলতা প্রতিহত করা যাবে। এই রাষ্ট্র দলাদলিকে দমন করবে এবং স্বৈরাচার রোধ করবে। এই রাষ্ট্র প্রজাতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতে সংগঠিত হওয়া আবশ্যক।

এই দলাদলি দমন করাই হল রাজনীতির সমস্যা বিশেষ। বিভিন্ন ও পরস্পরবিরোধী স্বার্থকে নিয়ন্ত্রণ করবে রাজনীতি। তাঁর মতানুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারকে সাংবিধানিক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিহত করা সম্ভব। তিনি প্রসারিত প্রজাতন্ত্রের কথা বলেছেন। প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থার ভিত্তি হিসাবে তিনি বিশাল নির্বাচকমণ্ডলী ও রাজনীতিক প্রতিনিধিত্বের কথা বলেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী নাগরিকরা হল এক সর্বজনীন শ্রেণী বিশেষ। এ ক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ ও সম্পত্তির মালিকানাজনিত কারণে কোন রকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় না। অর্থাৎ তিনি ভোটাধিকারকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করার পক্ষপাতী ছিলেন।

ম্যাডিসনের গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও ডেভিড হেল্ড আলোচনা করেছেন। তিনি ম্যাডিসনকে দ্বিধাগ্রস্ত গণতন্ত্রী বলে মন্তব্য করেছেন। ম্যাডিসনের প্রসারিত প্রজাতন্ত্রের প্রস্তাব অতিমাত্রায় উচ্চাশাযুক্ত। গুরুত্বপূর্ণ কতকগুলি বিষয়ে ম্যাডিসন একেবারে নীরব। তিনি তাঁর জনপ্রিয় সরকারের আলোচনায় সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বেচ্ছাচার এবং দলাদলির হিংসা থেকে ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি ও প্রতিষ্ঠান-পদ্ধতির কথা বলেছেন; কিন্তু বাস্তবে এ সবের রূপায়ণের জন্য কোন কার্যকরী ব্যবস্থার কথা তিনি বলেন নি।

জেরেমি বেন্থাম ও জেমস মিল: ব্যক্তিস্বার্থের সংরক্ষণকামী গণতন্ত্রের তত্ত্ব গড়ে তোলেন বেন্থাম ও মিল। অবাধ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেই ব্যক্তি সুখ এবং আনন্দ খোঁজে। প্রত্যেক ব্যক্তির যদি সরকার পছন্দের এবং নির্বাচিত করার অধিকার থাকে, তাহলে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ব্যক্তি নাগরিকদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে। সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্র কার্যকরী হয় নির্দিষ্ট আইনী কাঠামোর মধ্যে যাতে সরকার নিয়ন্ত্রণে থাকে। এই গণতন্ত্রে প্রত্যেক ব্যক্তি নাগরিক অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে। এখানে যুক্তিবাদী নাগরিক স্ব ইচ্ছাধীন। অবাধ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ হল এর বৈশিষ্ট্য।

সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্রের দু’জন বিশিষ্ট তাত্ত্বিক প্রবক্তা হলেন জেরেমি বেন্থাম ও জেমস মিল। এঁরা দুজনেই হলেন উপযোগবাদের প্রবক্তা। তাঁরা গণতন্ত্রের যে ধরনটির কথা বলেছেন তার উদ্দেশ্য হল বিভিন্নভাবে জনসাধারণের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। বেন্থাম তাঁর Fragments of Government শীর্ষক গ্রন্থে এবং জেমস মিল তাঁর An Essay on Government শীর্ষক গ্রন্থে সংরক্ষণমূলক গণতান্ত্রিক সরকার সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। সংরক্ষণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আলোচনায় এই দুই উপযোগবাদী রাষ্ট্র দার্শনিক পছন্দ এবং দায়বদ্ধতার নীতিকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যে কোন সরকার বা গোষ্ঠীর রাজনীতিক ক্ষমতার স্বৈরাচারী প্রয়োগকে প্রতিহত করা দরকার এবং জনসাধারণের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার। তার জন্য আবশ্যক হল গণতান্ত্রিক সরকার। জনগণের এই লক্ষ্যের বাস্তবায়নের জন্য গণতান্ত্রিক শাসন অপরিহার্য। হিতবাদী রাজনীতি বিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রের সংরক্ষণমূলক ভূমিকার উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কোন সরকার এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে না। একমাত্র গণতন্ত্রে তা সম্ভব হতে পারে। কেবলমাত্র গণতন্ত্রেই নাগরিকরা তাদের পছন্দমত জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে পারে। এ প্রসঙ্গে আধুনিক কালের বিশিষ্ট লেখক অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Ultimately, protective democracy aims to give citizens the widest possible scope to live their lives as they choose. It is therefore compatible with laissez-faire capitalism……Protective democracy has therefore particularly appealed to classical liberals and, in modern politics, to supporters of the New Right.”

উপযোগবাদী রাষ্ট্রদার্শনিকরা অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে সার্বজনীন ভোটাধিকারের বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেন। গণতন্ত্রের পক্ষে উপযোগবাদীদের বক্তব্যের অন্যতম ভিত্তি হল ব্যক্তিস্বার্থসমূহের সরক্ষণ ও বিকাশ সাধন। বেন্থামের অভিমত অনুযায়ী মানুষ দুঃখ-যন্ত্রণাকে দূর করে সুখশাস্তি ভোগ করতে চায়। এক্ষেত্রে একমাত্র উপায় হল সার্বজনীন ভোটাধিকার। এই ভোট ব্যবস্থার মাধ্যমেই সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক হিতসাধন সম্ভব। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “Bentham came to believe that, since all individuals seek pleasure and avoidance of pain, a universal franchise (conceived in his day as manhood suffrage) was the only way of promoting the greatest happiness for the greatest number.” বেন্থাম ও তাঁর অনুগামী হিতবাদীদের অভিমত অনুযায়ী একমাত্র উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র এমন এক সহায়ক পরিবেশ-পরিমণ্ডল সুনিশ্চিত করে, যে অবস্থায় স্বৈরাচারী রাজনীতিক হস্তক্ষেপ থাকে না এবং মানুষ নিজের স্বার্থ সাধনে সক্ষম হয়। সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্রের সমর্থক হিসাবে বেন্থাম ও তাঁর অনুগামীরা সকল রকম স্বৈরী ক্ষমতার বিরোধিতা করেছেন। এ বিষয়ে তাঁরা ব্যাপকভাবে গণতান্ত্রিক ও মানবিক আইন প্রণয়নের উপর জোর দিয়েছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্রের সকল প্রবক্তাই আইনমূলক সংস্কারের উপর জোর দিয়েছেন। আধুনিক কালের রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংবিধানতন্ত্রের প্রভাব বৃদ্ধির পিছনে সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্রীদের অবদান অনস্বীকার্য।

মূল্যায়ন (Evaluation): গণতন্ত্রে নাগরিকদের সরকারী কর্মচারীর শোষণ-পীড়ন থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। জনসাধারণের সুরক্ষাকে সুনিশ্চিত করার জন্য যাদের নিযুক্ত করা হয়েছিল, তারা স্বৈরাচারী হয়ে না পড়ে, তা গণতন্ত্রে দেখা হয়। হিতবাদী রাষ্ট্রদার্শনিকদের কাছে কাম্য নীতি হল সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বোচ্চ পরিমাণ সুখ অর্জনকে সুনিশ্চিত করা। এই শ্রেণীর চিন্তাবিরা সুখ অর্জনের কাছে ব্যক্তি ও সম্পত্তিকে সমর্পন করেছেন। এই নীতির ব্যত্যয় প্রতিহত করার ব্যাপারে শাসক-শাসিত উভয়েরই উদ্যোগী হওয়া আবশ্যক। বেন্থামের অভিমত অনুযায়ী জনসাধারণের উপর স্বৈরতান্ত্রিক সরকার নির্বিচারে নানাভাবে শোষণ-পীড়ন কায়েম করে। এর অবসান আবশ্যক। গণতন্ত্রেই তা সম্ভব। রাজনীতিক ক্ষমতার স্বৈরতান্ত্রিক অপব্যবহার থেকে সাধারণ মানুষের সুরক্ষার জন্য গণতান্ত্রিক সরকার আবশ্যক। বেন্থামকে অনুসরণ করে ডেভিড হেল্ড বলেছেন: “Democratic government is required to protect citizens from despotic use of political power.”

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ উদারনীতিক ধারণায় রাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছে সালিসির ভূমিকা। ব্যক্তিকে নাগরিক সমাজে স্বার্থ সংরক্ষণের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে; কিন্তু আর্থনীতিক প্রতিযোগিতা ও স্বাধীন বিনিময়ের নিয়ম-নীতি ব্যক্তিকে মেনে চলতে হবে। সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক সুবিধার জন্যই রাজতন্ত্রের ক্ষমতার অবসান, নিয়মিত নির্বাচন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বণ্টন, উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতির কথা বলা হয়েছে। ব্যক্তির প্রতিযোগিতামূলক বিনিময় ও আদানপ্রদান হল জনসাধারণের সমষ্টিগত কল্যাণের শর্ত বিশেষ। ন্যূনতম রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে উপযোগিতা লাভের কথা বলা হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে সমর্থন করা হয়েছে। জেরেমি বেন্থাম ও জেমস মিলের কাছে উদারনীতিক গণতন্ত্র হল বিশেষ এক ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থাপনা। এ রকম রাজনীতিক ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে শাসিত জনসাধারণের প্রতি দায়িত্বশীল থাকতে হয়। জনগণ রাজনীতিক সিদ্ধান্ত বাছাই করার এবং ন্যস্ত ও নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পায় কেবলমাত্র গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে। বেন্থাম ও মিলের মত হিতবাদী রাষ্ট্র দার্শনিকদের মতানুসারে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যক্তি মানুষকে সরকারী হস্তক্ষেপের আশঙ্কা থেকে মুক্তি দেয় এবং স্বার্থ সংরক্ষণের সহায়ক পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি সম্পদ সংগ্রহের সুযোগ পায়; শ্রম ও দ্রব্য বিনিময়ের বাজারে স্বাধীনতা পায় এবং আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। জনস্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে জেরেমি বেন্থাম ও জেমস মিল সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রবর্তনের উপর জোর দিয়েছেন। এ বিষয়ে অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies: An Introduction শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: Utilitarian theorists such as Jeremy Bentham and Jemes Mill developed the notion for democracy as a form of protection for the individual into a case for universal suffrage.”

সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্রের মূল্যায়ন

(১) ডেভিড হেল্ডের অভিমত অনুযায়ী হিতবাদী ও আনুষঙ্গিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মতবাদের মধ্যে অল্পবিস্তর র‍্যাডিক্যাল উপাদান বর্তমান। এই মতবাদ চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে পৌর সমাজের উপর সাবেকি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে। এই মতবাদে সর্বাধিক জনকল্যাণের স্বার্থে সমর্থন করা হয়েছে নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের ধারণাকে।

(২) ডেভিড হেল্ডের মতানুসারে সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত প্রয়োজন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গণতন্ত্র সম্পর্কিত জেরেমি বেন্থাম ও জেমস মিলের মতবাদের অবদান অনস্বীকার্য। এই প্রয়োজন চরম ক্ষমতার ও ঐতিহ্যের সঙ্গে চলে আসা নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত। ব্যক্তি এখানে ভোক্তা। সে তার স্বার্থকে পরিতৃপ্তির সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত করতে পারে; অসীম বাসনাকে চরিতার্থ করতে পারে। অ্যান্ড্রু হেউড (Andrew Heywood) তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “Ultimately protective democracy aims to give citizens the widest possible scope to live their lives as they choose. It is therefore compatible with laissez-fair capitalism and the belief that individuals should be entirely responsible for the economic and social circumstances. Protective democracy has therefore particularly appealed to classical liberals and, in modern politics to supporters of the New Right.”

(৩) সাধারণভাবে বলা যায় যে, জেরেমি বেন্থাম ও জেসম মিল আধুনিক কালের শিল্পসমাজের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি প্রস্তুত করেছেন।

(৪) সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্রের ধারণা সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরকারী ক্ষেত্রের বাইরের সব কিছুকেই অরাজনীতিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সরকারী প্রতিষ্ঠান ও ক্রিয়াকর্মকে রাজনীতি হিসাবে দেখা হয়। রাজনীতিকে সমাজের অন্য সকল ক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। বৃহত্তর পটভূমিতে রাজনীতিকে বিচার বিবেচনা করা হয় না। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে কতকগুলি বিষয়ের সঙ্গে একীভূত করে রাজনীতিকে বিবেচনা করা হয়। এই বিষয়গুলি হল: রাজনীতিক দলাদলির চাপ, স্বার্থগোষ্ঠীর দাবিদাওয়া, ব্যক্তিবর্গের ক্রিয়াকর্ম, সরকারী কার্যকলাপের ক্ষেত্র প্রভৃতি। জেরেমি বেন্থাম ও জেমস মিলের উদারনীতিক ধ্যান-ধারণায় রাজনীতি, সরকার ও সরকারী ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কে এক রকমের সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়। অ্যান্ড্রু হেউড এ বিষয়ে বলেছেন: “… to justify democracy on protective grounds is to provide only a qualified endorsement of democratic rule. In short, protective democracy is but a limited and indirect form of democracy.”

(৫) সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক। গণতন্ত্রের এই মডেলে ব্যক্তিবর্গের স্বার্থপূরণের স্বাধীনতা সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। গণতন্ত্রকে দেখা হয়েছে নেতিবাচক দিক থেকে। সমকালীন রাজতন্ত্র সম্পর্কে ত’ বটেই, সাধারণভাবে রাষ্ট্র সম্পর্কে হিতবাদী বেন্থাম ও তাঁর অনুগামীদের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা-আতঙ্ক ছিল। তাঁদের ভয় ছিল যে, রাষ্ট্র স্বৈরতান্ত্রিক পথে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে বিপন্ন করে তুলবে। এ রকম এক ধরনের আশঙ্কামূলক মানসিক অবস্থান থেকে তাঁরা গণতন্ত্রের সংরক্ষণমূলক ধারণাকে বিকশিত করেছেন।

(৬) আবার সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্র হল সর্বোপরি এক রকম সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। আনুষ্ঠানিক ও অ-আনুষ্ঠানিক নিয়মকানুনের এক্তিয়ারের মধ্যে এ ধরনের গণতান্ত্রিক মডেল সক্রিয় হয়। এই সমস্ত নিয়মকানুনের মাধ্যমে সরকারী ক্ষমতা প্রযুক্ত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। ভোটাধিকারকে ব্যক্তিস্বাধীনতা সুরক্ষার অন্যতম উপায় হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। কঠোরভাবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কার্যকর করার মাধ্যমেও স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করা দরকার।