সংবিধিবদ্ধ আইন কি? মূল আইন ও পদ্ধতিগত আইনের পার্থক্য কি? ফৌজদারী কার্যবিধি সম্পূর্ণরূপে পদ্ধতিগত আইন? |
প্রশ্নঃ সংবিধিবদ্ধ আইন কি? মূল আইন ও পদ্ধতিগত আইনের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর। ইহা বলা কি সঠিক হবে যে, ফৌজদারী কার্যবিধি সম্পূর্ণরূপে পদ্ধতিগত আইন? বিচারিক পদ্ধতির সাধারণ উপাদানসমূহ ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ সংবিধিবদ্ধ আইনঃ আধুনিক জগতে আইন প্রণয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আইনগত বিধিবিধান জারী করাকে আইন প্রণয়ন বলে। ব্যাপক অর্থে আইন সৃষ্টির সকল পদ্ধতিই আইন প্রণয়নের অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু সুক্ষ্ম অর্থে বা প্রকৃত অর্থে আইন সভা কর্তৃক সৃষ্ট আইনকে আইন প্রণয়ন বলা হয়। এরূপে প্রণীত আইনকে বিধিবদ্ধ আইন (enacted law) বা সংবিধিবদ্ধ আইন (Statutory law) বলে।
মূল আইন ও পদ্ধতিগত আইনের মধ্যে পার্থক্যঃ যদিও বলা হয় যে, মূল আইন মানুষের অধিকার নির্ণয় করে আর পদ্ধতিগত আইন সে অধিকার প্রয়োগ করে তবুও এ দু’আইনের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট নয়। কারণ অনেক অধিকার যেমন মূল আইনের আওতাভূক্ত, তেমনি পদ্ধতিগত আইনের আওতাভূক্ত অনেক অধিকারও রয়েছে। যেমন, আপীল করার অধিকার, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য সাক্ষ্যদানের অধিকার ইত্যাদি। মূল আইনের ন্যায় পদ্ধতিগত আইনও এ সকল ক্ষেত্রে অধিকার নির্ধারণ করে থাকে। এছাড়া প্রতিকার সংক্রান্ত সকল আইনই পদ্ধতির আওতাভূক্ত নয়। প্রতিকার নির্ধারণকারী বিধি-বিধান মূল আইনের অংশ হতে পারে।
আইন বিজ্ঞানী স্যামন্ডের মতে, আইনের যে শাখা মামলার প্রণাল। নির্ধারণ করে, তা হচ্ছে পদ্ধতিগত আইন। ইহা দেওয়ানী ও ফৌজদারী সকল মামলার ক্ষেত্রে হতে পারে। পদ্ধতিগত আইন ব্যতীত অন্য সকল আইনই মূল আইন। মূল আইন ন্যায়পরিচালনার অভীষ্ট লক্ষ্যের সহিত, সংশ্লিষ্ট, আর পদ্ধতিগত আইন এ লক্ষ্য অর্জনের উপায় ও প্রতিদানগুলোর সহিত সংশ্লিষ্ট। যেমন, কোন নির্দিষ্ট সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করার অধিকার আছে কিনা তা মূল আইনগত প্রশ্ন। সে লক্ষ্যে পৌছতে কোন আদালতে এবং কোন্ সময়ের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে তা পদ্ধতিগত আইনের প্রশ্ন। কোন্ কাজটি অন্যায় বা অবৈধ হবে তা নির্ধারণ করে মূল আইন; কিন্তু কিভাবে সে অন্যায়টি প্রমাণিত হবে তা পদ্ধতির ব্যাপার। প্রথমটি মামলার বিষয় বস্তু এবং পরেরটি এর প্রক্রিয়া সংক্রান্ত। কোন নির্দিষ্ট অপরাধ আর্থিক দন্ডে দণ্ডনীয় না কারাদন্ডে দন্ডনীয় তা মূল আইন সংক্রান্ত প্রশ্ন। কিন্তু তা সংক্ষিপ্ত বিচারে বা অভিযোগ এনে নিয়মিত বিচারে দন্ড দেয়া হবে তা পদ্ধতিগত আইনের প্রশ্ন। মৃত্যুদন্ডের বিলোপ করা হলে তা মূল আইনের পরিবর্তন, কিন্তু ঋণের জন্য কারদন্ডের বিলোপ পদ্ধতিগত আইনের পরিবর্তন। কেননা বিচার প্রশাসনের অন্যতম লক্ষ্য শাস্তি প্রদান, কিন্তু ঋণের জন্য কারাদন্ড দেয়ার উদ্দেশ্য তার ঋণ পরিশোধে বাধ্য করা। তাই দেখা যায় যে, মূল আইন ও পদ্ধতিগত আইনের মধ্যে প্রকৃত পার্থক্য হচ্ছে এই যে, প্রথমটি অধিকার নির্ধারণ ও প্রতিকার এবং অপরটি মামলার প্রক্রিয়ার সাথে সংযুক্ত। তবে স্যামন্ডের মতে এ পার্থক্য শুধু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র; বাস্তব ক্ষেত্রে এর তেমন গুরুত্ব নেই।
অনেক পদ্ধতিগত বিধিবিধান তাদের বাস্তব কার্যকারিতার দিক দিয়ে সম্পূর্ণভাবে না হলেও উল্লেখযোগ্যভাবে মূল আইনের বিধি বিধানের সমতুল্য।
ফৌজদারী কার্যবিধি সম্পূর্ণরূপে পদ্ধতিগত আইন কিনাঃ ১৮৬০ সালের প্রণীত দণ্ডবিধি আইনের সম্পূরক হিসেবে ১৮৯৮ সালে ফৌজদারী কার্যবিধি আইনটি প্ৰণীত হয়।
একটি ফৌজদারী মামলা কিভাবে এবং কোন্ আদালতে দায়ের করতে হবে, কোন্ আদালতের কতখানি এখতিয়ার বা ক্ষমতা রয়েছে এবং এরূপ আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে. কোন্ আদালতে আপীল করতে হবে তার বিধান এতে রয়েছে।
এছাড়া অপরাধীদের গেপ্তার, তদন্ত আদালতে উপস্থাপন, আদালত গঠন মামলা পরিচালনা, নিষ্পত্তি ও রায় প্রদান, ইত্যাদি সবই ফৌজদারী কার্যবিধি অনুসারে সম্পন্ন হয়ে থাকে। মূল আইনের চেয়ে পদ্ধতিগত আইনের গুরুত্ব কম নয়। পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে একটি জঘন্য অপরাধীও শাস্তি হতে এড়ায়ে যেতে পারে। তাই শুধু অপরাধের সংজ্ঞায়ন ও এর শাস্তির বিধান যথেষ্ট নয় । এগুলি বাস্তবায়ন বা কার্যকরী করার জন্য ফৌজদারী কার্যবিধির প্রয়োজন। তাই ফৌজদারী কার্যবিধির উদ্দেশ্য মোটামুটি নিম্নরূপঃ
প্রথমতঃ ফৌজদারী আদালত গঠন ও পরিচালনা।
দ্বিতীয়তঃ অপরাধ তদন্ত, অপরাধীর গ্রেপ্তার ও বিচারের ব্যবস্থা।
তৃতীয়তঃ ফৌজদারী বিচার প্রশাসনকে ন্যায় নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত করা।
ফৌজদারী কার্যবিধির কতটুকু মূল আইনঃ ফৌজদারী কার্যবিধি মূলতঃ একটি পদ্ধতিগত আইন এবং মূল আইন দণ্ড বিধির সম্পূরক। এতদসত্ত্বেও ফৌজদারী কার্যবিধির নিম্নলিখিত বিষয়গুলি মূল আইনের পর্যায়ভূক্ত-
(১) চতুর্থ অধ্যায়ে বর্ণিত ম্যাজিষ্ট্রেট, পুলিশ এবং গ্রেফতারকারী ব্যক্তিগণকে সাহায্য ও তথ্য প্রদান সম্পর্কে বিধানাবলী।
(২) অষ্টম হতে ত্রয়োদশ পর্যন্ত অধ্যায়ে বর্ণিত অপরাধ প্রতিরোধ সম্পর্কিত বিধানাবলী।
(৩) উনচল্লিশতম অধ্যায়ে জামিন সম্পর্কে বিধানবলী।
(৪) চল্লিশতম অধ্যায়ে সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণের জন্য কমিশন।
(৫) বিয়াল্লিশতম অধ্যায়ে মুচলেকা সংক্রান্ত বিধানাবলী।
(৬) তেতাল্লিশতম অধ্যায়ে সম্পত্তির বিলি ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিধানাবলী।
বিচারিক পদ্ধতির সাধারণ উপাদানঃ বিচার বিভাগীয় কার্যপদ্ধতির সাধারণত ৫টি উপাদান লক্ষ্য করা যায় যথা- (১) সমন, (২) প্লিডিংস, (৩) প্রমাণ, (৪) রায় ও (৫) রায় কার্যকরীকরণ। প্রথম পদক্ষেপ সমন জারীর উদ্দেশ্য হলো মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট ও আগ্রহী পক্ষকে আদালতে উপস্থিত হয়ে তাদের বক্তব্য পেশ করা ও শুনানীর সুযোগ প্রদান।
আরজি ও জবাবের মাধ্যমে সৃষ্ট প্লিডিংস এর উদ্দেশ্য হচ্ছে- প্রথমতঃ যথাসম্ভব অপ্রাসংগিক বিষয়কে বাদ দেয়া এবং বিরোধীয় বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করা; দ্বিতীয়তঃ মামলার অপর পক্ষকে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত দাবী সম্পর্কে অবহিত করা যেনো সে এর জবাব প্রস্তুত করতে পারে।
প্লিডিংস হতেই তথ্যগত বা আইনগত প্রশ্ন নির্ধারণ করা হয়, যা বিচার্য বিষয়ের জন্য প্রাসংগিত। যে পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো বিবেচ্য প্রশ্নসমূহের সিদ্ধান্তের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য, পরিসংখ্যান বা উপাত্ত আদালত সমক্ষে উপস্থাপিত করে, তাকে প্রমাণ পদ্ধতি বলা হয়। আদালতে সাক্ষী, দলিল, বস্তু, তথ্য ইত্যাদি সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করে কোন ঘটনা প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা হয়। আদালত বিবেচ্য প্রশ্নাদির উপর যে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন, তাই রায়। এটা ডিক্রী আকারে বা আদেশ আকারে দেয়া হয়। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আদালতে রায় কার্যকরী করা হয় তাকে একজিকিউশন বা রায়-কার্যকরীকরণ বলা হয়। এটা হচ্ছে মামলার শেষ স্তর এবং এ স্তরে রায় বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন বোধে সম্পত্তি ক্রোক করা হয় বা বিক্রি করা হয়, রিসিভার নিয়োগ করে বিরোধীয় সম্পত্তির দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয় ইত্যাদি।
Leave a comment