[1] বিভিন্ন সম্মেলনের দাবি মেনে: ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের এক সম্মেলনে গণপরিষদ গঠনের পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর তিন বছর পরে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে রামগড় কংগ্রেস সম্মেলনে কংগ্রেস কার্যকরী সমিতি গণপরিষদ গঠনের পক্ষে জোরালাে অভিমত ব্যক্ত করে। অবশেষে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে ভারতের সংবিধান রচনার বিষয়টি নীতিগতভাবে মেনে নেয়।

[2] কূপল্যান্ড পরিকল্পনার বিকল্প হিসেবে: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন চার্চিল মন্ত্রীসভার সদস্য স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ভারতে আসেন (১৯৪২ খ্রি., ২৩ মার্চ)। ক্রিপস ভারতবাসীর কাছে তার বিভিন্ন প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবে বলা হয় ব্রিটিশ সরকার ও গণপরিষদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু মুসলিম লিগ পৃথক গণপরিষদ গঠনের দাবি জানায়। পাশাপাশি জাতীয় কংগ্রেসও ক্লিপস প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করে। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ কূপল্যান্ডকে ভারতে পাঠায়। কূপল্যান্ড ঐকমত্যের ভিত্তিতে কংগ্রেস ও লিগের কাছে ক্ষুদ্র আকারের গণপরিষদ গঠনের প্রস্তাব রাখেন। এই প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরিবর্তে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গণপরিষদ গঠনের উল্লেখ থাকায় কুপল্যান্ড পরিকল্পনাও শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়।

[3] মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাব মেনে: 

  • [i] ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলি তাদের মােট জনসংখ্যার নির্দিষ্ট অনুপাত অনুযায়ী গণপরিষদে আসন লাভ করবে। প্রতিটি প্রদেশ ১০ লক্ষ জন পিছু একজন করে প্রতিনিধি গণপরিষদে পাঠাতে পারবে।

  • [ii] গণপরিষদের সকল আসন সাধারণ শ্রেণি (অ-শিখ, অ-মুসলমান), শিখ ও মুসলমান—এই তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে আনুপাতিক হারে ভাগ করে দেওয়া হবে।

  • [iii] প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতে প্রত্যেকটি সম্প্রদায়ের সদস্যবৃন্দ একক হস্তান্তরযােগ্য সমানুপাতিক ভােটাধিকার প্রয়ােগ করে নিজ নিজ প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবে।

[4] নির্বাচনের মাধ্যমে: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে গণপরিষদ গঠন করার জন্য এক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। চিফ কমিশনার শাসিত ৪টি আসন সমেত ব্রিটিশ-ভারত থেকে মােট ২৯৬ জন প্রতিনিধি নির্ধারণের জন্য এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে দলগত বিচারে কংগ্রেস শতকরা ৬৯ ভাগ আসন লাভের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। অর্থাৎ ২৯২টি প্রাদেশিক আসনের মধ্যে কংগ্রেস পায় ২০৮টি এবং মুসলিম লিগ পায় ৭৩টি আসন। সংবিধান রচনার লক্ষ্যে গঠিত খসড়া কমিটি (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট) গণপরিষদের কাছে খসড়া সংবিধান পেশ করে। দীর্ঘ আলাপ-আলােচনার পর রচিত হয় ভারতীয় সংবিধান।

সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে গণপরিষদের মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ভারতের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক রূপরেখা তৈরি। এর পাশাপাশি ভারতের সংবিধান ন্যায়বিচার, স্বাধীন চিন্তা ও মতপ্রকাশ, স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ ইত্যাদির অধিকার দিতে চেয়েছিল ভারতীয় নাগরিকদের। সকল নাগরিক যাতে সমান সুযােগ পায় এবং সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, গণপরিষদের সদস্যগণ তাও উদ্দেশ্যরূপে গ্রহণ করেছিলেন। ভারতীয় সংবিধানের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যগুলি হলㅡ

[1] আর্থসামাজিক উন্নতি: গণপরিষদের সর্বপ্রধান লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ভারতের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানাে। জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ভারতের নবগঠিত সংবিধান ভারতবাসীর স্বাধীনতা রক্ষা করবে, ক্ষুধার্তের অন্ন জোগাবে, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেবে এবং প্রত্যেকের আত্মবিকাশের ব্যবস্থা করবে। ড. সর্বপল্লি রাধাকৃষাণ বলেন, গণপরিষদের মূল লক্ষ্য হবে ভারতের আর্থসামাজিক বিপ্লব সাধন।

[2] গণতান্ত্রিক, সার্বভৌম রাষ্ট্রগঠন: ভারতের সংবিধান প্রণেতাগণ গণপরিষদের রাজনৈতিক লক্ষ্য বর্ণনা করে বলেন যে, ভারত আত্মপ্রকাশ করবে এক স্বাধীন, সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রজাতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র হিসেবে। যেখানে থাকবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও সংসদীয় গণতন্ত্রের অস্তিত্ব।

[3] সামাজিক লক্ষ্য: সামাজিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তফশিলি জাতি, উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য বিশেষ সংরক্ষণ ব্যবস্থা, শিশু ও নারীকল্যাণ, অস্পৃশ্যতা বিলােপ ইত্যাদি বিষয়গুলি গণপরিষদে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।