অথবা, সংবিধান কত প্রকার ও কী কী আলােচনা কর।
অথবা, সংবিধানের প্রকারভেদ আলােচনা কর।
অথবা, সংবিধানের শ্রেণিবিন্যাস উল্লেখ কর।
ভূমিকাঃ “Constitution is that body of rules which regulates the ends for which the. powers of the government is exercised.”. [K. C. Wheare, The Statute of Westminister, P. 12]
সংবিধান হলাে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতি এবং একটি দেশের মেরুদণ্ডস্বরূপ। সংবিধান হলাে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি। সংবিধানের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। সংবিধান ছাড়া কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সংবিধান হচ্ছে যে কোন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন যা অন্যান্য আইন এবং সরকারকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। প্রতিটি স্বাধীন দেশের জন্য সংবিধান অত্যাবশ্যক। আর উত্তম সংবিধানের মাধ্যমেই জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক নির্ণীত হয়।
সংবিধানের শ্রেণিবিভাগ (Classification of constitution): বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সংবিধানের প্রকৃতি ও যথার্থ স্বরূপ জানার সুবিধার্থে সংবিধানের শ্রেণিবিভাগ করা হয়ে থাকে। সংবিধান বা শাসনতন্ত্রের প্রকারভেদ বা শ্রেণিবিভাগ নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতভেদ দেখা যায়। যেমন-
ক. আইনসভার মাধ্যমে প্রণীত এবং বিভিন্ন সময় থেকে প্রচলিত বিভিন্ন প্রকার প্রথার সমন্বয়ে গঠিত এ দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে সংবিধানকে মূলত দুইভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
i. লিখিত সংবিধান এবং
ii. অলিখিত সংবিধান।
খ. সংশােধনের পদ্ধতি অনুযায়ী সংবিধানকে দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা-
i. সুপরিবর্তনীয় সংবিধান এবং
ii. দুম্পরিবর্তনীয় সংবিধান।
গ. ক্ষমতা বণ্টনের পদ্ধতি অনুযায়ী সংবিধানকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
i. এককেন্দ্রিক সংবিধান,
ii যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান
iii রাষ্ট্রশাসিত সংবিধান এবং
iv. সংসদীয় সংবিধান।
ঘ. সরকার পরিচালনায় জনসাধারণের অংশগ্রহণের নীতি অনুযায়ী সংবিধানকে দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যথা-
i. গণতান্ত্রিক বা প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান, ও
ii. অভিজাততান্ত্রিক বা রাজতান্ত্রিক সংবিধান।
ঙ. রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে সংবিধানকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
i. নীতি সংবদ্ধ সংবিধান এবং
ii. নিরপেক্ষ সংবিধান।
চ. মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শাসনতন্ত্রকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
i. বুর্জোয়া শাসনতন্ত্র বা সংবিধান এবং
ii. শ্রমিক শ্রেণির সংবিধান।
লিখিত সংবিধান (Written constitution): একটি রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনার মৌলিক নিয়মকানুনগুলাে যখন এক বা একাধিক দলিলে লিপিবদ্ধ থাকে, তখন তাকে লিখিত সংবিধান বলে। লিখিত সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার অত্যাবশ্যক মূলনীতিগুলাে সুস্পষ্টভাবে লিখিত থাকে। অধ্যাপক গেটেল বলেছেন, “যখন কোন দলিলে সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থার সকল মৌলিক নীতিগুলাে অন্তর্ভুক্ত থাকে, তখন তাকে লিখিত সংবিধান বলে। এ সংবিধান সাধারণত একটি গণপরিষদ কনভেনশন কর্তৃক প্রণীত ও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘােষিত হয়।
অলিখিত সংবিধান (Unwritten constitution): অলিখিত সংবিধান বলতে প্রচলিত প্রথা, দেশাচার ও রীতিনীতির সমষ্টিকেই বুঝায়। এরূপ সংবিধান নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও উদ্যোগের মাধ্যমে রচিত ও গৃহীত হয় না। ‘গণপরিষদ’ বা ‘আইনসভা’ এরূপ সংবিধান নির্দিষ্ট সময়ে রচিত করে না। যুক্তরাজ্য (UK) অলিখিত সংবিধানের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। এগুলাে কোন দলিলে সন্নিবেশিত না থাকলেও লিখিত সংবিধানের মতােই এগুলাে সরকার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
সুপরিবর্তনীয় সংবিধান (Flexible constitution): “If a constitution may be easily amended by the ordinary law-making body and procedure it may be classed as flexible.” [R. G. Gettell, Political Science, P-246]
আইনসভা যে সংবিধানকে সাধারণ আইন প্রণয়ন পদ্ধতির ন্যায় সংশােধন বা পরিবর্তন করতে পারে তাকে, সুপরিবর্তনীয় সংবিধান বলে। এরূপ সংবিধান পরিবর্তনের জন্য বিশেষ কোন পদ্ধতি অনুসরণের প্রয়ােজন হয় না। সাধারণভাবে আইনসভায় উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটদানকারীর সমর্থনে এ সংবিধান সংশােধন করা যায়। ইংল্যান্ডের অলিখিত সংবিধান এবং নিউজিল্যান্ডের লিখিত সংবিধান সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের উদাহরণ।
দুস্পরিবর্তনীয় সংবিধান (Rigid constitution): যে সংবিধান সংশােধন, পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের জন্য দেশের প্রচলিত সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতি ব্যতিরেকে ভিন্নতর কোন বিশেষ বা জটিল পদ্ধতি অবলম্বনের প্রয়ােজন হয়, তাকে দুস্পরিবর্তনীয় সংবিধান বলে। আমেরিকার সংবিধান দুস্পরিবর্তনীয়। কেননা আমেরিকার কংগ্রেস সাধারণ আইনের ন্যায়। সংবিধানের সংশােধন করতে পারে না। এক্ষেত্রে বিশেষ বা জটিল পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। Gettell বলেছেন, “If a constitution requires a special organ or a more difficult procedure of amendment than that required for the creation of ordinary law, it may be classes as rigid.”
যুক্তরাষ্ট্রীয় ও এককেন্দ্রিক সংবিধান (Federal and unitary constitution): যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানে কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক সরকারগুলাের মধ্যে সমমর্যাদার ভিত্তিতে ক্ষমতা বণ্টন করে দেয়া হয়। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর দৃষ্টান্ত দেখা যায়। এককেন্দ্রিক সংবিধানে কেন্দ্রীয় সরকারকে সমগ্র দেশের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়। যেমন- বাংলাদেশ।
রাষ্ট্রপতি শাসিত ও সংসদীয় সংবিধান (Presidential and parliamentary constitution): রাষ্ট্রপতি সংসদীয় সংবিধান মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠা করে। যেমন- বাংলাদেশের সংবিধান।
প্রজাতান্ত্রিক ও রাজতান্ত্রিক সংবিধান (Republican and monarchic constitution): যেদেশের রাষ্ট্র প্রধান একজন রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্ট সেদেশের সংবিধান প্রজাতান্ত্রিক। আবার একটি দেশের রাষ্ট্র প্রধান একজন রাজা হলে, সেদেশের সংবিধানকে রাজতান্ত্রিক সংবিধান বলে। যেমন- ভুটান ও নেপালের সংবিধান।
নীতিসংবদ্ধ ও নিরপেক্ষ সংবিধান (Ideologically programmatic and neutral constitution): নির্দিষ্ট কিছু আদর্শ বা নীতিকে কেন্দ্র করে প্রণীত সংবিধানকে নীতিসংবদ্ধ সংবিধান বলে। যেমন- সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সংবিধান রচিত হয়েছে। অনেক শাসনতন্ত্রে বিশেষ কোন নীতি বা আদর্শের আনুগত্য থাকে। দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি অবস্থার বিচারে এ শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়। এ ধরনের সংবিধানকে নিরপেক্ষ সংবিধান বলে। উদাহরণ হিসেবে জার্মানির কথা বলা যায়।
বুর্জোয়া ও শ্রমিক শ্রেণির সংবিধান (Bourgeois and workingclass constitution): মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে যে সংবিধান সমাজে ধনীকে বা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সর্বপ্রকার সুখস্বাচ্ছন্দ ও ক্ষমতার সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাকল্পে যে সংবিধান প্রণীত হয় তা হচ্ছে বুর্জোয়া সংবিধান। পশ্চিমা বিশ্বের সকল দেশের শাসনতন্ত্রকেই মার্কস মূলত বুর্জোয়া শাসনতন্ত্র বলেছেন। আর সমাজে খেটে খাওয়া শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী শাসনতন্ত্রকে শ্রমিক শ্রেণির সংবিধান বলে। বস্তুত সাবেক সােভিয়েত রাশিয়ায় এ ধরনের সংবিধান প্রয়ােগের চেষ্টা করা হয়েছিল।
উপসংহারঃ আলােচনার শেষপ্রান্তে এসে আমরা বলতে পারি, সংবিধান সম্পর্কে যতই মতপার্থক্য থাকুক না কেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা উপযুক্ত প্রশ্নে সংবিধানের যেসব শ্রেণিবিন্যাস দেখিয়েছেন তার সবগুলােই একটি রাষ্ট্রের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।
Leave a comment