পত্রকাব্য বা লিপিকাব্যে (Epistle) পত্ৰলেখার অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কোনও প্রিয়জন বা পৃষ্ঠপোষক ব্যক্তির উদ্দেশ্যে কবিতা রচিত হয়। পত্রকাব্যের দুটি রূপ দেখা যায়, একটির উপজীব্য নৈতিক ও দার্শনিক বিষয়, এই ধারার উৎস প্রাচীন কবি Horace-এর Epistles; অন্যটির উপজীব্য রোমান্টিক ও উচ্ছ্বাসময় ভাবুকতার বিষয়, এই ধারার উৎস Ovid এর Heroides। হোরেস সহজ সরল বাক্-ছন্দ, ব্যক্তিগত অনুপুংখ (personal details), প্রশ্ন ইত্যাদির সাহায্যে তাঁর বিষয়কে অন্তরঙ্গ রূপদান করেছেন। ওভিদের Heroides নারীদের তাদের প্রেমিকদের কাছে লিখিত পত্রকাব্য। ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশে অনেক কবিই এই প্রাচীন কবিদের অনুসরণে পত্রকাব্য রচনা করেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ কবি Donne Heroides অনুসরণ করেছিলেন, Pope-এর Eloisa to Abelard ও তাই। অবশ্য রেনেসাঁসের যুগে হোরেসের দার্শনিক ও নৈতিক পত্রকাব্যই বিপুলভাবে অনুসৃত হয়েছিল। Vaughn, Dryden, Congreve প্রমুখ কবিরা পত্রকাব্যের এই ধারা অনুসরণ করেছিলেন। Pope-এর Moral Essays ও Epistle to Dr. Arbuthnot ইংরেজি ভাষায় এই ধারার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। রোমান্টিক কবিরা কবিতার এই রূপ বিশেষ ব্যবহার করেননি। অবশ্য শেলী, কীট্স ও ল্যান্ডর এই জাতীয় কিছু কবিতা লিখেছেন। সাম্প্রতিক কালের এই জাতীয় কবিতার উদাহরণ W. H. Auden-এর New Year Letter Louis MacNeice-4 Letters From Island।
Ovid-এর Heroides-এর আদর্শে রচিত মধুসুদনের ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ বাঙলা ভাষায় প্রথম পত্রকাব্য এবং এই ধারার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। একুশটি পত্র লেখার ইচ্ছা মধুসূদনের ছিল, কিন্তু তিনি এগারোটির বেশী সম্পূর্ণ করে উঠতে পারেন নি। নারী-হৃদয়ের কোমল মধুর অনুভূতি যেমন, তেমনি ক্ষোভজ্বালার বহ্নিময় প্রকাশে, চরিত্রানুযায়ী ভাষাভঙ্গিতে, ছন্দের সাবলীল প্রবাহে ও নাটকীয়তায় ‘বীরাঙ্গনা’ অতুলনীয় পত্রকাব্য। ‘সোমের প্রতি তারা’, ‘দশরথের প্রতি কৈকেয়ী’ ও ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’—নাট্যরস সমৃদ্ধ এই তিনটি কবিতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
‘বীরাঙ্গনা’ সম্পর্কে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মন্তব্য স্মরণীয় : “ইহার নায়িকারা প্রকৃতি ও অবস্থাভেদে প্রত্যেকে এক স্বতন্ত্র সুরে মনোভাব ব্যক্ত করিয়াছে-চরিত্রের সঙ্গে প্রকাশভঙ্গীর এক সূক্ষ্ম সঙ্গতি এই অন্তরহস্যের দর্পণরূপে রচনাগুলিকে নাটকীয়-গুণসমৃদ্ধ করিয়াছে। এই নায়িকা-গোষ্ঠীর মধ্যে অনেকেই পদমর্যাদায় রানী রাজকুলোদ্ভব, কিন্তু নারীত্বই ইহাদের প্রধান পরিচয়। ইহারা মহাকাব্যের আভিজাত্যের অন্তরাল হইতে বাহির হইয়া আসিয়া স্ব স্ব নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য, নারীপ্রকৃতির বিচিত্র আবেগ-চিহ্নিত, পরিপূর্ণ আত্মপরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।” রবীন্দ্রনাথের ‘পত্র’ ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘পুরীর চিঠি’ পত্রকাব্যের উদাহরণ।
Leave a comment