সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদ হল সমাজতন্ত্রবাদের আর একটি রূপ। ইংল্যান্ডে সমাজতন্ত্রবাদের এই প্রকারটির প্রকাশ ঘটে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে সমাজতন্ত্রবাদের উদ্ভব হয়েছে। তবে এ ধরনের সমাজতন্ত্রবাদের মৌলিক ধারণাসমূহের প্রথম প্রকাশ পরিলক্ষিত হয় আরও আগে। বস্তুত ১৯০৬ সাল থেকেই এই ধরনের সমাজতন্ত্রবাদ প্রসঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। সমাজবিজ্ঞানী পেন্টি [A. J. Penty (1875-1935)] প্রণীত The Restoration of the Giuld System শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯০৬ সালে। এই গ্রন্থে পেন্টি শিল্পক্ষেত্রে মধ্যযুগের স্বশাসন ব্যবস্থার পুনপ্রবর্তনের পক্ষে সওয়াল করেন। মধ্যযুগের কারিগররা এক একটি স্বশাসিত সংঘ বা গিল্ডের সদস্য ছিল। এই সুবাদে কারিগররাই ছিল শিল্পকর্মের হাতিয়ারসমূহের মালিক। তারাই নিজেদের উৎপাদনের প্রকৃতি ও পরিমাণ নির্ধারণ করত। ১৯১৫ সালে সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদীরা ব্রিটেনে ‘National Guilds League’ গঠন করেন। এই সংগঠনের মধ্যে বহু বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হবসন (S. G. Hobson), ওরেজ (A. R. Orage), কোল প্রমুখ। এই শ্রেণীর সমকালীন সমাজতন্ত্রীদের লেখালেখির প্রভাব-প্রতিক্রিয়া ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। তাঁরা শিল্পসমূহে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের স্বশাসনের পক্ষে দাবি জানান। গিল্ডসমূহের জাতীয় লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় শ্রমিক আন্দোলনে গীল্ডের ধারণা জনপ্রিয়তা লাভ করে। গাউবা তাঁর An Introduction to Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “In fact Guild Socialism originated as a trend in the British labour movement which enjoyed great ideological success in the period from 1916 to 1926. It tried to combine the good points of socialism with those of the ancient guild system.”

প্রকৃত প্রস্তাবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে সংঘমূলক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। এই সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদ ছিল যৌথ ব্যবস্থামূলক সমাজতন্ত্রবাদ (syndicalism) এবং আগেকার সমাজতন্ত্রবাদ (Older socialism)-এর মধ্যে সামাজিক মধ্যবর্তী অবস্থানযুক্ত। উৎপাদকদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় দায়-দায়িত্বের উপর জোর দেওয়া হয়। শ্রমিকরা যে পরিস্থিতি পরিমন্ডলের মধ্যে কাজ করে এত দিন তা নির্ধারণ করেছে মূলধনের মালিকরা। শ্রমিকদের মেহনতের ফসল স্বরূপ উৎপাদন থেকে মুনাফা আত্মসাৎ করেছে মূলধনের মালিকশ্রেণী। গিল্ড সমাজতন্ত্রীরা মূলধন মালিকদের এই ক্ষমতা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পক্ষপাতী। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীরা শিল্পক্ষেত্রে স্বশাসন প্রবর্তনের পক্ষপাতী। সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদী আন্দোলনের উদ্দেশ্য হল আধুনিকভাবে মধ্যযুগের গিল্ড ব্যবস্থাকে পুনরায় প্রবর্তন করা। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীরা বিশ্বাস করেন যে, মূল্য এককভাবে ব্যক্তি মানুষ সৃষ্টি করে না; সৃষ্টি করে সমষ্টিগতভাবে সমাজ। সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই উৎপাদকদের গণতন্ত্র এবং ভোক্তাদের গণতন্ত্রের হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত করার কথা বলা হয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদূদ্রা সম্পদের অর্জন ও কেন্দ্রীভবনকে সমর্থন করেন, কিন্তু জনসাধারণের প্রতি পরিষেবা প্রদানের দায়দায়িত্বের ব্যাপারে পুঁজিবাদী চিন্তাবিদ্রা উদাসীন। সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদীদের বক্তব্য অনুযায়ী শ্রমিক সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে সংগঠিত হতে হবে এবং জাতীয়করণের পর নিজেদের শিল্পসংস্থাসমূহকে অধিগ্রহণ ও পরিচালনা করতে হবে।

সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদীদের অভিমত অনুযায়ী প্রকৃত ও কার্যকর ক্ষমতা শ্রমিকদের হাতেই থাকা উচিত। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীরা রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রবাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও কেন্দ্রীভবনের বিরোধী। রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রবাদের এই সীমাবদ্ধতার সমালোচনা করতে গিয়ে একে বলেছেন: “bureaucracy masques ading as democracy'”। সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদীর মতানুসারে শিল্পে নিযুক্ত সকল শ্রমিক সংগঠন বা গিল্ড গড়ে তুলবে। শিল্পের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ এই গিল্ডের হাতেই থাকবে। শিল্পে কর্মচারী নিয়োগ, দ্রব্য সামগ্রির উৎপাদন, উৎপাদিত সামগ্রির মূল্য নির্ধারণ, নিজেদের মধ্যে মুনাফার বণ্টন প্রভৃতি বিষয়াদির উপর শিল্পের শ্রমিকদেরই কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। যৌথ ব্যবস্থামূলক সমাজতন্ত্রীদের মত সমাজতন্ত্রবাদীরাও শ্রমজীবীদের কল্যাণ সাধনের উপর বিশেষ জোর দেন। যৌথ ব্যবস্থামূলক সমাজতন্ত্রীরা শ্রমিক সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়নের কথা বলেন; সংঘমূলক সমাজতন্ত্রীরা আর একটু অগ্রবর্তী অবস্থান গ্রহণ করে সংঘ বা গিল্ডের কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে জোড় তাঁর Introduction to Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন : “The Guild Socialists may, then, best be described as a small body of intellectual theorists working within the labour movement with the object of converting the influential men of the movement to their veiws, but not as a general rule making any direct appeal for the support of the masses.”

গিল্ডসমূহের জাতীয় লীগ (National Guilds League) সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদীদের লক্ষ্য ব্যাখ্যা করেছে। তদনুসারে এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীদের উদ্দেশ্য হল মজুরী ব্যবস্থার অবসান এবং শিল্পে শ্রমিকদের দ্বারা স্বশাসনের ব্যবস্থা। জাতীয় গিল্ডসমূহের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক ক্রিয়ামূলক সংগঠনসমূহের সঙ্গে সংযুক্তভাবে এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়া সম্ভব। সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদ মার্কসবাদ বিরোধী। কারণ মার্কসবাদের সকল গুরুত্বপূর্ণ নীতিসমূহকে সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। কোকার (F. W. Coker) তাঁর Recent Political Thongt শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Guild socialism is like the earlier French Syndicalism in its oversion to all doctrines that make productive activity dependent upon political authority. It would protect the worker not only against exploitation by capitalists but also against any bureaucratic suppression of craftsmanship. Its object is to make work more interesting and the whole economic structure of society more democratic.”

যৌথ ব্যবস্থামূলক সমাজতন্ত্রবাদের চূড়ান্ত রূপ এবং রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রবাদ বা সামগ্রিকতাবাদের মধ্যবর্তী অবস্থায় সংঘমূলক সমাজতন্ত্রের অবস্থান। সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদকে ইংলিশ ফেবিয়ানিসম ও ফরাসী সিন্‌ডিকেলিসম-এর বৌদ্ধিক সন্তান হিসাবে মন্তব্য করা হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ক্ষতিকারক দিকসমূহ বা সীমাবদ্ধতাসমূহের অপসারণের ব্যাপারে ফেবিয়ানিসম অতিমাত্রায় দুর্বল প্রতিপন্ন হয়। অপরদিকে সিনডিকেলিসম ছিল অতিমাত্রায় বিপ্লববাদী এবং এই কারণে ব্রিটিশ মানসিকতার সঙ্গে সম্পর্করহিত। সমাজবিজ্ঞানী কোল তাঁর Guild Socialism Restated শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Guild socialism is based on the idea of partnership between the producers and the state in the control of industry. Guild socialism recognises that the state is necessary and that a purified parliament is necessary. At the same time, Guild socialists hold that the first need of is the placing of industrial power in the hands of the workers and that without such industrial freedom every change in the structure of society must be a bureaucratic sham.”

সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য

সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদের স্বরূপ সম্পর্কে বিচা বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের সমাজতন্ত্রের কতকগুলি মৌলিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এক: ক্রিয়ামূলক গণতন্ত্র: সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদীরা ক্রিয়ামূলক গণতন্ত্রের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁদের অভিমত অনুসারে শিল্পক্ষেত্রে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব ব্যতিরেকে রাজনীতিক গণতন্ত্র অর্থহীন। আর্থনীতিক ক্ষমতা রাজনীতিক ক্ষমতার অগ্রবর্তী বিষয়। সংঘমূলক সমাজতন্ত্রীরা শ্রমিকশ্রেণীকে পুঁজিপতিদের স্বৈরাচার থেকে রক্ষা করতে চান। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থাকে শ্রমজীবীদের নিয়ন্ত্রণাধীনে নিয়ে আসার কথা বলেন। শিল্পক্ষেত্রে পুঁজিপতিদের কর্তৃত্ব কায়েম থাকলে রাজনীতিক গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। কারণ সে ক্ষেত্রে পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষার্থেই রাষ্ট্রযন্ত্র সক্রিয় হবে। রাষ্ট্রদার্শনিক জোেড তাঁর Introduction to Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: ‘A democratic society will, therefore, be one which is coordinated network of functional representative bodies, each of which represents a particular set of wills or purposes which its mem bers have in common.”

দুই : শান্তিপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক উপায়-পদ্ধতি: সংঘমূলক সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীরা শান্তিপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক উপায়-পদ্ধতি অনুসরণের পক্ষপাতী। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার ক্ষতিকারক দিকগুলির অবসান এবং মেহনতী মানুষের দুঃখ-দুর্দশার নিরসনের জন্য তাঁরা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সদর্থক, সহায়ক ও উপযোগী আইন প্রণয়নের পথে অগ্রসর হতে চান। শ্রমিকশ্রেণীর কল্যাণ সাধনে উদ্যোগী সকল দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁরা সংযোগ সম্পর্ক ও সাহায্য-সহযোগিতার পক্ষপাতী।

তিন: রাষ্ট্রের ভূমিকা— 

  • কোল: সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদীরা প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেন নি। তবে রাষ্ট্রের অভিপ্রেত ভূমিকা প্রসঙ্গে এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কোল রাষ্ট্রের হাতে অধিকতর কর্তৃত্ব আরোপের পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি রাষ্ট্র ও বিভিন্ন গিল্ডকে সম পর্যায়ভুক্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী অন্যান্য সংস্থার মত রাষ্ট্রও একটি সংস্থা মাত্র। রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব ও কার্যাবলী সমানুপাতিক হওয়া দরকার। সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থা তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করবে গিল্ডগুলি। রাষ্ট্র ভোক্তাদের স্বার্থের রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এই উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র মূল্য নিয়ন্ত্রণ করবে এবং আয় বণ্টনের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করবে। রাষ্ট্রের অন্যান্য কার্যাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল শিশুশিক্ষা, বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ, অপরাধ প্রতিরোধ ও অপরাধের শাস্তি দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রভৃতি। রাষ্ট্র এবং গিল্ডসমূহের মধ্যে যদি সংঘাতের সৃষ্টি হয়, তা হলে ক্রিয়ামূলক সাম্যের সুপ্রীমকোর্ট চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

  • হবসন: হবসনের অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্র সমগ্র-সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসাবে ভূমিকা পালন করে যাবে। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্যমূলক অবস্থান অব্যাহত থাকবে। তবে রাষ্ট্র তার কিছু ক্ষমতা ও কার্যাবলী অন্যান্য সংঘ-সংগঠনের হাতে অর্পণ করবে। রাষ্ট্র আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দিক থেকে জনসাধারণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। এই উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র পুলিশ বাহিনী, সৈন্যবাহিনী ও নৌবাহিনী গড়ে তুলবে ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। রাষ্ট্র দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালত স্থাপন করবে এবং দেশে আইনের শাসন কায়েম করবে। রাজনীতিক ও আর্থনীতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করবে। রাষ্ট্রই হবে সকল কারখানা ও যন্ত্রপাতির মালিক। বিভিন্ন গিল্ডকে রাষ্ট্র এগুলি লিজ দেবে। বিভিন্ন গিল্ডের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র চূড়ান্ত আপীল আদালত হিসাবে কাজ করবে। বিভিন্ন গিল্ডের কাছে রাষ্ট্র কর আদায় করবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা প্রদানকারী গিল্ডগুলিকে রাষ্ট্র আর্থনীতিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা দেবে। সামাজিক পরিষেবার পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ গিল্ডগুলির নিয়ম-নীতি নির্ধারণে রাষ্ট্রের অল্পবিস্তর হাত থাকবে।

চার: নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা শ্রমজীবীদের হাতে আসা: সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদীদের অভিমত অনুসারে গিল্ডগুলি সকল কাজকর্মের দায়দায়িত্ব নিজেদের হাতে নেবে এবং নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন কাজকর্ম বণ্টন করে নেবে। এটা ধরে নেওয়া হয়েছে যে, শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের দায়িত্ববোধের সৃষ্টি হবে এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটবে। নিজেদের ফোরম্যান ও ওভারসিয়ারদের নির্বাচনের ব্যাপারে শ্রমিকদের অধিকার থাকবে। শ্রমিকরা তাদের কাজের পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সমষ্টিগত চুক্তির নীতি তারা অনুসরণ করবে। শ্রমজীবিদের ব্যাপারে বাইরে থেকে কোন হস্তক্ষেপ থাকবে না। পুঁজিপতিদের হাত থেকে নিয়ন্ত্রণমূলক যতগুলি কাজকর্ম নিয়ে নেওয়া সম্ভব তা নিয়ে যেতে হবে এবং প্রয়োগ করতে হবে। তবে এ বিষয়ে ধীরে ধীরে এগোতে হবে। সংঘমূলক সমাজতন্ত্রীরা নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতার সীমানার মধ্যে ক্রমান্বয়ে পদার্পণ করার নীতিকে সমর্থন করেছেন।

পাঁচ : সংঘমূলক সমাজতন্ত্রীরা উৎপাদকদের বিভিন্ন গিল্ড এবং ভোক্তাদের পরিষদসমূহের মধ্যে যৌথ আলোচনার উপর জোর দিয়েছেন। এই আলোচনার মাধ্যমে উৎপাদনব্যয়, মূল্য এবং উভয় পক্ষের দিক থেকে প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নির্ধারিত হবে।

ছয়: গিল্ডগুলির সংগঠন: গিল্ডগুলির সংগঠনের ব্যাপারে সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। তবে এই শ্রেণীর অধিকাংশ সমাজতন্ত্রীদের অভিমত অনুযায়ী জাতীয় ভিত্তিতে গিল্ডগুলি সংগঠিত হওয়া দরকার। এঁদের মতানুসারে গিল্ড ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে সক্রিয় করার জন্য এবং সক্রিয় রাখার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গিল্ডগুলির কাজকর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা দরকার। এই কারণে একটি অঞ্চলের প্রত্যেক গিল্ডকে পরিপূর্ণ স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা দেওয়া যায় না। একটি অঞ্চলের গিল্ডসমূহের সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের গিল্ডগুলি কোন রকম সংযোগ সম্পর্ক থাকবে না, তা অভিপ্রেত নয়। তবে প্রতিটি গিল্ডের পর্যাপ্ত আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টিকে এঁরা সমর্থন করেন। শিল্পের প্রকৃতি এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পের পরিষেবার প্রকৃতির উপর কেন্দ্রীকরণের পরিমাণ ও স্থানীয় স্বাতন্ত্র্যের পরিমাণ নির্ভরশীল। সংঘমূলক সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে একটি অংশ জাতীয় ভিত্তিতে গিল্ডসমূহকে সংগঠিত করার বিরোধিতা করেন। এঁদের মতানুসারে সে ক্ষেত্রে সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদের মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে। এই কারণে এঁরা কেবলমাত্র স্থানীয়ভাবে গিল্ডসমূহকে সংগঠিত করার পক্ষপাতী।

সাত: পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থার বিরোধিতা ॥ সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদীরা পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা ও বিরোধিতা করেছেন। কারণ পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য অংশ পুরোপুরি পায় না, বঞ্চিত হয়। আবার এ ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থায় পুঁজিপতিরা তাদের প্রাপ্য অংশের থেকে অধিক পরিমাণ আত্মসাৎ করে। তা ছাড়া পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা অতিমাত্রায় যান্ত্রিক প্রকৃতির। এ ধরনের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমিক যন্ত্রের অংশে পরিণত হয়, তার ব্যক্তিসত্তার বিনাশ ঘটে।

আট: গণতান্ত্রিক সরকারী ব্যবস্থার বিরোধিতা: সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদীরা বিদ্যমান গণতান্ত্রিক সরকারী ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। তাঁরা আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থার বিরূপ সমালোচনা করেন। উৎপাদক ও ভোক্তাদের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের সীমাবদ্ধতা বা অসামর্থ্য অনস্বীকার্য। বস্তুত সংঘমূলক সমাজতন্ত্রীরা ক্রিয়ামূলক বিচারে সমাজের পুনর্গঠনের পক্ষপাতী। তাঁদের মতানুসারে সমাজে বিভিন্ন স্বতন্ত্র ও অপরিহার্য কাজকর্ম আছে। এ সবের ভিত্তিতেই পৃথকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গোষ্ঠী থাকা দরকার।

নয়: জাতীয় শিল্প গিল্ড কংগ্রেস: কোল বলেছেন যে, সকল জাতীয় গিল্ডের প্রতিনিধিত্ব করবে ‘জাতীয় শিল্প গিল্ড কংগ্রেস’ (National Industrial Guild Congress- NIGC)। এই কংগ্রেসই হবে সমগ্র গিল্ড ব্যবস্থার প্রতিনিধি। কার্যক্ষেত্রে গিল্ড সংগঠনের অপরিহার্য নিয়ম-নীতি নির্ধারণ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সম্পাদন করবে। এই কংগ্রেস গিল্ড-আইনসভা হিসাবে ভূমিকা পালন করবে এবং গিল্ডসমূহ সম্পর্কিত বিবাদ-বিসংবাদের মীমাংসার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত আপীল আদালত হিসাবে কাজ করবে। ভোক্তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে গিল্ড কংগ্রেস উৎপাদকদের প্রতিনিধি হিসাবে ভূমিকা পালন করবে। জাতীয় পর্যায়ে গিল্ডগুলির উৎপাদনমূলক ক্রিয়াকর্মের মধ্যে সমন্বয় থাকবে।

দশ: শিল্পে স্বশাসন: সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবিদদের অভিমত অনুযায়ী প্রতিটি শিল্প পরিচালিত হবে সংশ্লিষ্ট শিল্পের শ্রমিকদের সমবায় সংগঠনের দ্বারা। এই কাজের দায়িত্ব ন্যস্ত হবে একটি গিল্ডের হাতে। প্রতিটি গিল্ডের অন্তর্ভুক্ত হবে সকল শ্রমিক যারা সংশ্লিষ্ট গিল্ডের নির্দিষ্ট কাজের সঙ্গে সংযুক্ত। সংশ্লিষ্ট গিল্ডের নির্দিষ্ট কাজটির প্রকৃতি যে ধরনেরই হোক না কেন, তার সকল শ্রমিকই গিল্ডের সদস্য। নিজের কাজকর্মে প্রত্যেক গিল্ডের স্বশাসনের অধিকার থাকবে। কিন্তু কোন গিল্ডের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে না। জোহারী বলেছেন: “All industry must be in the hands of the guilds. A guild is a body of all persons engaged in that industry from the manager at the top to a person at the bottom.” এ দিক থেকে বিচার করলে গিল্ড এবং শ্রমিক সংঘ এক নয়, আলাদা। গাউবা তাঁর An Introduction to Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদের চারটি বৈশিষ্ট্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

  • সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদে মার্কসবাদের মত শ্রেণী সংগ্রামের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

  • মজুরী ব্যবস্থার বিলোপ সাধন এবং শিল্প-সংগঠনের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বের দাবি করা হয়েছে।

  • শ্রমিকদের সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তাদের গুরুত্বের বিষয়টিকে তুলে ধরে সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদ সিণ্ডিকেলিসমের সংস্কার সাধনের চেষ্টা করেছে।

  • শোষণের যন্ত্রস্বরূপ পুরাতন রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসানের কথা সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদে বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে যে, জনজীবনের প্রয়োজনীয় পৌর পরিষেবাসমূহ সম্পাদনের জন্য নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।

সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদের সমালোচনা ও মূল্যায়ন

সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদ বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। সমালোচকরা এ ধরনের সমাজতন্ত্রবাদের বিবিধ সীমাবদ্ধতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

এক : অযৌক্তিক: সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদ অযৌক্তিক। আধুনিককালের সমাজব্যবস্থা অতি বৃহৎ ও ব্যাপক। আধুনিক সমাজের কাজকর্ম বহু ও বিভিন্ন এবং স্বভাবতই অতিমাত্রায় সম্প্রসারিত। আধুনিক সমাজের এই সমস্ত কাজকর্মের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কথা অনস্বীকার্য। এই কারণে এই ধরনের সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হতে বাধ্য। সংঘমূলক সমাজতন্ত্রে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দায়িত্ব দেওয়া হয় রাষ্ট্রকে এবং আর্থনীতিক উৎপাদনের বিষয়টি থাকে গিল্ডের হাতে। এই ব্যবস্থা অসঙ্গত ও অযৌক্তিক, কারণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আর্থনীতিক উৎপাদন পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সম্পর্ক রহিত নয়।

দুই : সার্বভৌমিকতার অবসানের ধারণা অবাস্তব: সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনেকাংশে নিছক তত্ত্বমূলক, বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক-রহিত। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীরা সার্বভৌমিকতার ধারণা থেকে সরে আসার কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয়। সংঘমূলক সমাজতন্ত্রী কোল সার্বভৌমিকতার ধারণার বিলোপ সাধনের কথা বলেছেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রবাদীরা স্বতন্ত্র একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই নবসৃষ্ট সংগঠনটিকে রাষ্ট্রের ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হতে হয় এবং সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহার করতে হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে এক ধরনের সার্বভৌমিকতার জায়গায় আর এক ধরনের সার্বভৌমিকতার আবির্ভাব ঘটে। এ বিষয়ে হার্নস মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন: “The constitution of the state contemplated by Cole is a complecated nightmare of committees and joint committes which reminds one of the machinery made by boy out is Meccano.”

তিন: আর্থনীতিক ও রাজনীতিক বিষয়াদির স্বতন্ত্রীকরণ অসম্ভব: সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদে আর্থনীতিক ও রাজনীতিক বিষয়াদিকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করার কথা বলা হয়। কিন্তু এভাবে রাজনীতিক ও আর্থনীতিক বিষয়াদির সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ বাস্তবে সম্ভব নয়। এ ধরনের সমাজতন্ত্রবাদে আর্থনীতিক বিষয়াদিকে পুরোপুরি গিল্ডগুলিকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং রাজনীতিক বিষয়াদিকে রাষ্ট্রকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এটা কি করে সম্ভব হবে তা অনুধাবন করা দুরূহ ব্যাপার। সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদে গিল্ডসমূহের ভিড ও বাড়াবাড়ির মধ্যে রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলা হয়েছে। জোহারী তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “Another difficulty about guild socialism is that it plays fast and loose with the existence of the state on the other hand, it talks of an abridged state and makes itself different from the anarchists; on the other hand, it submerges the state into the whirlpool of numerous guilds and communes.”

চার: ক্ষমতা বিভাজনের পরিকল্পনা অবাস্তব: সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদ অবাস্তব। এই অবাস্তবতার কারণে এ রকম সমাজতন্ত্রবাদ বাস্তবে ব্যর্থ হতে বাধ্য। সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদে রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন গিল্ডের মধ্যে ক্ষমতা বিভাজনের ব্যবস্থা করা হয়। কার্যাবলী সম্পাদনের ব্যাপারে রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি। যথেষ্ট সদিচ্ছা ও বৌদ্ধিক বিচার-বিবেচনা সত্ত্বেও ক্ষমতা বিভাজনের এই পরিকল্পনার সাফল্যের সম্ভাবনা দেখা যায় না। কারণ আর্থনীতিক ও রাজনীতিক কার্যাবলীর স্বতন্ত্রীকরণ বাস্তবে এক অর্থহীন ও অবাস্তব পরিকল্পনা।

পাঁচ: রাষ্ট্রের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য: সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদে দুটি পার্লামেন্টের কথা বলা হয়েছে: একটি হল রাজনীতিক পার্লামেন্ট এবং আর একটি হল আর্থনীতিক পার্লামেন্ট। আর্থনীতিক পার্লামেন্ট সংগঠিত হবে ক্রিয়ামূলক ভিত্তিতে এবং রাজনীতিক পার্লামেন্ট সংগঠিত হবে আঞ্চলিক ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। এই দুই পার্লামেন্টের মধ্যে বিরোধের আশঙ্কাকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। যদি এরকম বিরোধ বাধে তাহলে তার সম্যক সমাধান কিভাবে সম্ভব? উভয় পার্লামেন্টের সদস্যদের নিয়ে সর্বক্ষমতাসম্পন্ন একটি যৌথ কমিটি এই সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে খুব বেশি সহায়ক বা সফল হবে বলে মনে হয় না। সুতরাং সবসময়ই একটি চূড়ান্ত ক্ষমতাসম্পন্ন কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। এই কর্তৃপক্ষ যে নামই দেওয়া হোক্ তা রাষ্ট্র ছাড়া আর কিছু হবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। ম্যাকাইভার তাঁর The Modern State শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “The scheme of guild socialism is an attempt to get away from the insignificance of locality, but it is also in effect an attempt to get away from the insignificance of the state. A parliament chosen in terms of occupation would inevitably either cease to be a state parliament or else, which is far from likely, would exercise general control in virtue of whatever specific group of interests was dominant within it. …. The state is retained in name but disappears in fact.”

ছয়: ক্রিয়ামূলক প্রতিনিধিত্বের সীমাবদ্ধতা: সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদে ক্রিয়ামূলক প্রতিনিধিত্বের উপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ক্রিয়ামূলক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থায় সমাজকে দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত বলে ধরে নিতে হয়। এই দুটি গোষ্ঠী হল পুঁজিপতি ও সর্বহারা। ক্রিয়ামূলক প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে শ্রম এবং পুঁজির প্রতিনিধিত্বের অনুপাত কি হবে তা নির্ধারণ করা সহজ হবে না। আবার মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কিত সমস্যাও আছে। সংখ্যার হিসাবে মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের কথা ভাবা হলে বিবাহিত গৃহবধূ ও অবিবাহিত মহিলাদের মধ্যে আবার পার্থক্য করতে হবে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে এই দুই গোষ্ঠীর মহিলাকে তাদের সংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব দিতে হবে। কারণ এই দুটি গোষ্ঠীর মহিলাদের মধ্যে সমস্যাগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আবার আইনসভার উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ক্রিয়ামূলক প্রতিনিধিত্ব প্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হয় না। যেমন চিকিৎসকদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া ক্রিয়ামূলক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে গঠিত সরকার হবে অতিমাত্রায় জটিল প্রকৃতির। সর্বসাধারণের পক্ষে তা অনুধাবন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এই অবস্থায় ক্রিয়ামূলক গোষ্ঠীগুলি রাজনীতিক দলের কর্তাব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়বে। এই দলীয় নেতারই রাষ্ট্রীয় নিয়ম-নীতির নির্ধারক হয়ে দাঁড়াবেন। গণতান্ত্রিক আদর্শগত বিচারে এই অবস্থাকে সমর্থন করা যায় না।

সাত: উৎপাদন হ্রাস পাবে: সমালোচকদের অভিমত অনুসারে উৎপাদন ব্যবস্থা গিল্ডসমূহের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলে শিল্পের উপর তার প্রতিকূল প্রভাব পড়বে। শুধুমাত্র সমাজসেবার মানসিকতার দ্বারা কঠোর পরিশ্রমের জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করা যাবে না। উৎপাদনের পদ্ধতি বা আনুষঙ্গিক ক্ষেত্রে উন্নততর উদ্ভাবনের ব্যাপারে উদ্যোগ-আয়োজনের অভাব ঘটবে। কাজেকর্মে বিশৃঙ্খলা ও নির্লিপ্ততার সৃষ্টি হবে। তার দক্ষতার হানি ঘটবে এবং শিল্পে নৈরাজ্য ও স্থবিরতার সৃষ্টি হবে। এই অবস্থায় দেশের মোট উৎপাদন হ্রাস পাবে। সামগ্রিক বিচারে শ্রমজীবী মানুষ ও ভোক্তাদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। জোহারী বলেছেন: “…the guild commune (virtually) state would organise people on the basis of their different and divergent interests, would give them an opportunity to thwart each other, and would give nobody, not even the population as a whole-a chance to make them compose their differences.”

আট: মধ্যযুগের গিল্ডব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা অর্থহীন: সমালোচকদের অভিমত অনুসারে মধ্যযুগের গিল্ড ব্যবস্থার কাঠামোকে আধুনিক শিল্পব্যবস্থার উপর চাপিয়ে দিলে সমস্যা দেখা দেবে। পেন্টি (A. J. Penty) আধুনিককালের যন্ত্রশিল্পের মাধ্যমে উৎপাদন এবং তাদের সংগঠনের আঞ্চলিক ইউনিটগুলির জায়গায় আগেকার হস্তশিল্প ও কারিগরদের প্রাচীন গিল্ডগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলেছেন। কিন্তু আধুনিককালের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা, শ্রমবিভাজন ব্যবস্থা প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যযুগীয় গিল্ড ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা অসার ও অর্থহীন। মধ্যযুগের গিল্ড ব্যবস্থাকে আদর্শ ব্যবস্থা হিসাবে তুলে ধরার উদ্যোগকে সমর্থন করা যায় না। নিজেদের বিবিধ সীমাবদ্ধতা, ব্যর্থতা এবং সমাজবিরোধী প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিকূলতার পরিণামে সমকালীন গিল্ড ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে।

নয়: রাষ্ট্রের পরিবর্তে কমিউনের ধারণা অসঙ্গত: কোল প্রমুখ সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদী রাষ্ট্রকে অপসারিত করে বৃহৎশিল্প ও আর্থনীতিক ক্ষমতার আধার হিসাবে কমিউন গড়ে তোলার কথা বলেছেন। সমালোচকদের মধ্যে অনেকে এই ব্যবস্থা কতটা অভিপ্রেত সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীরা সম্ভাব্য কমিউনগুলিতে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি অনুসরণের কথা বলেছেন। কিন্তু সমালোচকদের মধ্যে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এই নীতি অনুসরণ করে কমিউনগুলি সম্ভাব্য সকল প্রশ্নের মীমাংসা করার ব্যাপারে সমর্থ হবে না। ম্যাকাইভার তাঁর The Modern State শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The danger is not that particular interests will not be focussed and asserted, but rather that the general interest may suffer domination through their urgency. Against this danger the general bulwork is the state, because its organisation presupposes and in some degree realizes the activity of the general will.”

দশ: গিল্ডের পীড়নমূলক ভূমিকা: সমালোচকদের আশংকা অনুযায়ী একচেটিয়া প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে গিল্ডগুলির ভূমিকা পীড়নমূলক হয়ে পড়বে। তারফলে দেশ দেউলিয়া অবস্থাপ্রাপ্ত হয়ে পড়তে পারে। বিভিন্ন গিল্ডের সংকীর্ণ স্বার্থের কাছে দেশের সামগ্রিক ও বৃহত্তর স্বার্থের বলিদানের ঘটনা ঘটতে পারে। দেশের গিল্ডদের মধ্যে পারস্পরিক বিবাদ-বিসংবাদের ঘটনা ঘটতে পারে। এবং সেক্ষেত্রে দেশে এক অবাঞ্ছিত ও অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হবে।

এগার: কাল্পনিক প্রকৃতি: সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদীরা গিল্ডগুলির উপর যাবতীয় ক্ষমতা ন্যস্ত করে এক ভবিষ্যৎ সমাজব্যবস্থার রূপরেখা রচনা করেছেন। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীরা বিশ্বাস করেন যে, ভবিষ্যতের এই সমাজ থেকে পুঁজিপতি শ্রেণী ধীরে ধীরে অপসারিত হয়ে যাবে। কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের বিবেচনায় এই ধারণা চূড়ান্ত বিচারে কাল্পনিক প্রতিপন্ন হবে। গ্রে তাঁর The Socialist Tradition শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Indeed, one of the reasons why Guild Socialism as a movement, foundered so promptly was that it suffered from too many ideas. It demanded from its devotees a level of mental eqiupment rarely to be used outside the lonelier attitudes of the more ancient seats of learning.”

বার: অস্পষ্টতা দোষে দুষ্ট: সমালোচকদের অভিমত অনুসারে সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদ অস্পষ্টতা দোষে দুষ্ট। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রবাদীদের মতামত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে কোন সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ ধারণা লাভ করা যায় না। এ ধরনের সমাজতন্ত্রবাদী বক্তব্যের মধ্যে রাজনীতিক ক্ষেত্রে সক্রিয় ইংরেজ ও ফরাসীদের মতামতের জগাখিচুড়ি ঘটেছে। তার ফলে সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদের বক্তব্য অসচ্ছ হয়ে পড়েছে। এই মতবাদের মধ্যে ইংরেজ ফেবিয়ানদের ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সঙ্গে ফরাসী সিন্ডিকেলিস্টদের মতামতের সমাবেশ ঘটেছে। এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে ক্রিয়ামূলক গণতন্ত্র এবং সংঘমূলক সমবায়িক কমনওয়েলথের ধারণা। এ প্রসঙ্গে গে তাঁর The Socialist Tradition শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Socialism today is rather like a lost child at the cross-roads, not quite sure where it has come from, and not knowing where exactly it wants to go. For this the Guild Socialists are to a consid erable extent responsible….having destroyed the old faith of socialism, they have provided no new abiding faith to take its place.”

তের: প্রতিক্রিয়াশীল: সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদীরা হল প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক চিন্তাবিদ্। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীরা মধ্যযুগের গিল্ড ব্যবস্থার দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। কিন্তু মধ্যযুগীয় গিল্ডব্যবস্থার বহু ও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা ছিল। সমকালীন গিল্ডব্যবস্থার কারণে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা সংকটের সৃষ্টি করেছিল। তার মোকাবিলার জন্য শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। মধ্যযুগীয় সেই গিল্ড ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনলে নৈরাজ্যবাদ পরিস্থিতি-পরিমন্ডলের সৃষ্টি হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্কার তাঁর Political Thought in England শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “….the guilds too may have their diseases; in the middle ages they certainly had; and today also a socialism based on guilds might mean a spirit of exclusive monopoly, a spirit of jealousy between guild and guild, a spirit of pettiness which preferred the small association to the great society in which it lives.”

সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদের মূল্যায়ন:

সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদের সীমাবদ্ধতাসমূহকে অস্বীকার করা যায় না। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এই সমস্ত সীমাবদ্ধতা প্রকট হয়ে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডে সংঘমূলক সমাজতন্ত্রীরা আবাসনের বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধরেন। তাঁরা উৎসাহের সঙ্গে অট্টালিকা নির্মাণে উদ্যোগী হন। এই সময় বিভিন্ন গিল্ডকে ‘জাতীয় গৃহনির্মাণ লীগ’ (National Building League)-এর মধ্যে সমন্বিত করা হয়। কিন্তু এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯২৫ সালে গিল্ডসমূহের জাতীয় লীগ (National Guilds League) অবলুপ্ত হয়। সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদের শিক্ষামূলক ও তাত্ত্বিক গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। আধুনিককালে শিল্প পরিচালনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণের কথা বলা হয়। সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদে এই ধারণাকে পরিপুষ্ট করা হয়েছে। মালিক-শ্রমিকের এই যৌথ পরিচালন ব্যবস্থার আবেদন সর্বসাধারণের কাছে বিশেষভাবে তাৎপর্যযুক্ত। পরিচালন ব্যবস্থায় শ্রমজীবীদের অংশগ্রহণের ধারণা সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদীদের সুবাদে আধুনিককালে বিশেষ তাত্ত্বিক গুরুত্ব অর্জন করেছে। বর্তমানে উৎপাদকদের মধ্যে বহুত্ববাদী চিন্তাভাবনার বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। আবার রাষ্ট্রের চূড়ান্ত সার্বভৌমত্বের ধারণাও বর্তমানে প্রবল প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে। এই উভয় ক্ষেত্রেই সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। আবার আধুনিককালে শিল্পক্ষেত্রে সদর্থক আন্দোলনের বিষয়টিকে সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদই সমৃদ্ধ করেছে। গ্রে তাঁর Socialist Tradition শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “(Though it) has passed away, it has been a fertilising influence in the sphere of industrial move ment.” গাউবা তাঁর An Introduction to Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Guild Socialism was strongly opposed not only to communism but also to all forms of collective socialism. It was inspired by that branch of French Syndicalism which sought to restrict and counterbalance the power of the political state by independent economic organizations of workers and consumers.”