প্রশ্নঃ সংগঠনের সংজ্ঞা দাও। সংগঠনের গুরুত্ব বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ সংগঠন প্রশাসন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। রাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য সংগঠনের প্রয়োজন অপরিহার্য। কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য কতকগুলো ব্যক্তির সহযোগিতামূলক ও সমবায়িক প্রচেষ্টা হচ্ছে প্রশাসন। এ কথা সুস্পষ্ট যে, আকাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ সকল ব্যক্তিদের অবশ্যই সংগঠিত হতে হবে। তারা একে অপরকে সাহায্য করবে এবং সহযোগিতার মাধ্যমে তারা কাজ করবে— তাহলেই তাদের এ সমবায়িক প্রচেষ্টা একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের দিকে ধাবিত হবে। এসব কিছু তখনই সম্ভবপর বলে বোধগম্য হবে, যখন একটা সাংগঠনিক কাঠামো থাকবে, যার মাধ্যমে তাদের প্রচেষ্টা ও শক্তি একটা সাধারণ লক্ষ্যে পরিচালিত হবে। সুতরাং সকল প্রশাসনিক কার্যক্রমের আগে সংগঠনের প্রয়োজন। কেননা, সংগঠন ব্যতীত কোন প্রশাসনিক কার্যক্রমই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ডিমোক (Dimock)-এর ভাষায়, “প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে কার্যরত রাখার হাতিয়ার হচ্ছে সংগঠন।”
সংগঠনের সংজ্ঞা (Definition of Organization):
(ক) আভিধানিক অর্থঃ সংগঠন কথাটির আভিধানিক অর্থ হলো ‘আন্তনির্ভরশীল অঙ্গগুলোর কাজের মধ্যে সংযোগ বিধান করা’; যাতে প্রতিটি অংশ যেন সমগ্র সত্তার কাঠামোধীনে বিশেষ কার্যক্রম, দায়িত্ব ও ক্রিয়াসম্পাদন করতে পারে।
(খ) মূল সংজ্ঞাঃ সর্বাধিক সুবিধা লাভ করার উদ্দেশ্যে প্রশাসনিক কার্যবলির বিভাগীকরণ কর্মচারী এবং বিভাগগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থিরীকরণ এবং ঊর্ধতন এবং অধস্তন কর্মচারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ এবং পরিশেষে প্রশাসনিক অখণ্ডতা ও শৃঙ্খলা বিধান করাকেই প্রশাসনিক সংগঠন বা সংক্ষেপে সংগঠন বলা হয়। সংগঠন হচ্ছে জটিল কার্যাবলির সমষ্টি, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে কোন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট সংযোজন আনয়ন করা। প্রতিষ্ঠান মাত্রই জটিল কার্যাবলির সমষ্টি, আর এ কার্যাবলির মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য সংগঠনের প্রতিষ্ঠা।
(গ) প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন লেখক ও চিন্তাবিদ সংগঠনের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। সংজ্ঞাসমূহ নিম্নরূপ-
→ জন এম. গউস (John M. Gaus) বলেছেন, “Organization is the arrangement of personnel for facilitating the accomplishment of some agreed purpose through the allocation of functions and responsibilities. It is the relating of the efforts and capacities of individuals and groups engaged upon a common task in such a way as to secure the desired objective with the least friction and the most satisfaction to those for whom the task is done and those engaged in the enterprise.” অর্থাৎ সংগঠন হচ্ছে কার্যাবলি ও দায়িত্ব বণ্টনের মাধ্যমে কতকগুলো স্বীকৃত উদ্দেশ্য সাধনকল্পে কর্মচারীবর্গের সুবিন্যস্তকরণ। কোন অভিন্ন কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি ও সমষ্টির প্রয়াস এবং ক্ষমতাকে সম্পর্কযুক্ত করাই এর কাজ যাতে যারা সংগঠনের সাথে জড়িত আছে এবং যাদের উদ্দেশ্যে কাজটি সম্পাদিত হবে তাদের সন্তুষ্টি বিধান করা যায় এবং যাতে কোন প্রকার বিঘ্ন না ঘটে।
সংগঠনের গুরুত্ব (Importance of Organization): প্রশাসনিক সংস্থা মানুষের মৌলিক উদ্দেশ্য হাসিলের একমাত্র উপায় বলে পরিগণিত। কাজেই সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থার সাথে জনগণের ভাগ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিজ্ঞানসম্মত প্রশাসনিক সংগঠন এবং ব্যবস্থাপনার অভাবে সমাজে নানারূপ বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং মানুষের অধিকার সংরক্ষণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই বলা যায়, সংগঠন ব্যতীত মানুষের কোন উদ্দেশ্যই সুষ্ঠুভাবে সাধিত হতে পারে না । আমরা সংগঠন মানবের যুগে বসবাস করছি— এ কথা বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। ‘সংগঠন মানব’ (The Organization Man) তাকেই বলা হয়, যে স্বীয় সিদ্ধান্ত ও মূল্যবোধের মূল্যায়ন হিসেবে সংগঠনের লক্ষ্যকেই গ্রহণ করে থাকে। চেস্টার বার্নার্ড (Chester Barnard) বলেছেন, “আজকাল কোন ব্যক্তিকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কোন মূল সংগঠনের সদস্য তা খুঁজে বের করি।” সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সংগঠনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। নিচে সংগঠনের গুরুত্বের বিভিন্ন দিক উল্লেখ করা হলোঃ
১। সমতা বিধানঃ সংগঠনের মাধ্যমে মানুষের অধিকারের ক্ষেত্রে সমতা বিধান করা যায়৷ প্রশাসনিক সংস্থা শৃঙ্খলার সাথে সকলের জন্য সমান সুযোগের সৃষ্টি করে।
২। উদ্ভাবনে প্রেরণাঃ সংগঠন মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে নতুন কিছু উদ্ভাবনে প্রেরণা যোগায়। প্রত্যেক কর্মচারী নির্দিষ্ট কর্তব্যে নিয়োজিত থেকে উক্ত কার্যের উন্নতিতে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে।
৩। মনুষ্য শক্তির ব্যবহারঃ সংগঠন মনুষ্য শক্তিকে যথোপযুক্ত ব্যবহারে লাগায়। উপযুক্ততা বিচার করে সংগঠন নির্দিষ্ট কার্য এবং পদ বণ্টনের দ্বারা প্রত্যেক কর্মচারীকে নিয়োগ করে কর্মচারীদের সংগঠনের প্রতি অনুরক্ত করে তোলে।
৪। পরিচালনায় সহায়তাঃ সংগঠনের মাধ্যমে পরিচালনা সহজ হয়ে উঠে। সংগঠনে শ্রমবিভাগ প্রবর্তনের ফলে ব্যবস্থাপনা সুচারুরূপে সংগঠিত হয়।
৫। প্রযুক্তিবিদ্যার ব্যবহারঃ সংগঠনের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি, কলাকৌশল প্রভৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবহার সম্ভব হয়। কলাকৌশলের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির বাস্তবায়নে সংগঠন অপচয় যথাসম্ভব হ্রাস করে এবং শ্রমশক্তি বাঁচিয়ে দেয়।
৬। বিশেষীকরণঃ সংগঠনে ক্রমাগত একটি কার্যের সাথে জড়িত থাকার ফলে কর্মচারীরা সহজে বিশেষজ্ঞ হবার সুযোগ লাভ করে।
৭। দক্ষতা বৃদ্ধিঃ সংগঠন কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। কারণ কর্মগুলো বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়। ফলে সে কাজ সম্পর্কে সে দক্ষ হয়ে উঠে।
৮। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণঃ প্রত্যেক সংগঠনের জন্য প্রয়োজন সিদ্ধান্ত গ্রহণ। কারণ সিদ্ধান্ত ছাড়া কোন সংগঠন চলতে পারে না। আর একাধিক ব্যক্তিবর্গের সংগঠন সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৯। সহযোগিতার মনোভাব সৃষ্টিঃ যে কোন সংগঠনের কর্মীদের সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হয়। কারণ সহযোগিতার মনোভাব না থাকলে সংগঠন টিকে থাকবে না। এ জন্য সংগঠন কর্মীদের সহযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করে।
১০। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলঃ সংগঠনের স্বার্থে কর্মচারীদের অবশ্যই সংগঠন কর্তৃক নির্ধারিত আইন মেনে চলতে হয়। আইন কিভাবে মেনে চলতে হয় তা সংগঠন বলে দেয়। সুতরাং সংগঠন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিক্ষা দেয়৷
১১। জাতীয় এবং সরকারি উদ্দেশ্য বাস্তবায়নঃ প্রশাসনিক সংগঠন জাতীয় এবং সরকারি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য উত্তম হাতিয়ার। সরকারের অবশ্যই উদ্দেশ্য থাকে। সে উদ্দেশ্য কিভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে সে ব্যাপারে সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১২। সমন্বয় সাধনঃ যে কোন কাজ করতে গেলে দরকার বিভিন্ন উপাদান। বিভিন্ন উপাদান ছাড়া কোন কাজ করা সম্ভব হয় না। বিভিন্ন কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে সংগঠন বিশেষভাবে প্রয়োজন।
১৩। রাজনৈতিক সচেতনতাঃ জনগণ রাজনৈতিকভাবে সচেতন না হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। আর সঠিক গণতন্ত্র যদি রাষ্ট্রে না আসে তাহলে জনকল্যাণ সাধিত হবে না। সংগঠন জনগণকে রাজনৈতিক সচেতনতার শিক্ষা দেয়৷
১৪। জনকল্যাণঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের কল্যাণ সাধন করা। যদি জনগণের কল্যাণ না আসে তাহলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। কিভাবে জনগণের কল্যাণ সাধন করা যায় সে জন্য সংগঠনের প্রয়োজন।
১৫। দ্বন্দ্ব-বিরোধ নিরসনঃ মানুষে মানুষে অবশ্যই দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এটা সৃষ্টির আদি অবস্থা থেকেই বিদ্যমান। সংগঠন দ্বন্দ্ব নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সমাপনীঃ উপরের আলোচনা হতে বলা যায় যে, সংগঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। সংগঠন একদিকে যেমন বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সাহায্য করে, অন্যদিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
Leave a comment