ভূমিকাঃ যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রশাসনিক সংগঠন সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ গড়ে উঠেছে। এ সকল মতবাদের মধ্যে ক্রীড়া মতবাদ (Game Theory), সিদ্ধান্ত মতবাদ (Decision Theory), তথ্য মতবাদ (Information Theory), যোগাযোগ মতবাদ (Communication Theory), কাঠামোগত মতবাদ (Structural Theory),গাণিতিক মতবাদ (Mathematical Theory), গোষ্ঠী মতবাদ (Group Theory), প্রেষণা মতবাদ (Motivational Theory), আচরণগত মতবাদ (Behavioral Theory) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এ সকল মতবাদের মধ্যে কোনটাই সম্পূর্ণরূপে সন্তোষজনক এবং সঠিক নয়৷ এদের ব্যাখ্যা হতে এ ধারণায় উপনীত হওয়া যায় যে, সংগঠনে মূলত তিনটি ভিন্ন অথচ পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ মতবাদ বিদ্যমান। যথাঃ সনাতন বা আনুষ্ঠানিক মতবাদ (Classical or Formal Theory), নয়া সনাতন বা অনানুষ্ঠানিক মতবাদ (Neo-classical or Informal Theory) এবং আধুনিক মতবাদ (Modern Theory)।
আধুনিক মতবাদ (Modern Theory): সংগঠন সম্পর্কে সনাতন মতবাদকে আনুষ্ঠানিক এবং নয়া সনাতন মতবাদকে অনানুষ্ঠানিক মতবাদ হিসেবে গণ্য করা হয়। সংগঠন সম্পর্কিত আধুনিক মতবাদ অনুযায়ী এ দু’টির কোনটিই স্বয়ংসম্পূর্ণ বা পর্যাপ্ত নয়। সংগঠনের আধুনিক মতবাদ সনাতন ও নয়া সনাতন মতবাদের বিকল্প হিসেবে এসেছে।
সংগঠন সম্পর্কিত সনাতন বা আনুষ্ঠানিক মতবাদ অনুসারে সংগঠন হলো কাঠামোভিত্তিক এবং কার্যভিত্তিক (Structure Oriented and Task Oriented)। অপরপক্ষে নয়া সনাতন বা অনানুষ্ঠানিক সংগঠন হলো কর্মচারীকেন্দ্রিক (Employee Centered)। সংগঠন সম্পর্কিত এ উভয় মতবাদই কোন একটি বিশেষ দিকের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। মূলত এ মতবাদ দু’টি একটি অন্যটির উপর নির্ভরশীল। সংগঠন সম্পর্কিত আধুনিক মতবাদে এ দু’টি পৃথক অথচ মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় সাধন করা হয়েছে।
সংগঠনের আধুনিক মতবাদ মূলত ধারণা ও বিশ্লেষণমূলক। আধুনিক তত্ত্ব বাস্তব বা প্রায়োগিক গবেষণামূলক তথ্য ও উপাত্তের উপর নির্ভরশীল। এ তত্ত্বের লেখকগণ মনে করেন সংগঠন হলো এক প্রকার সামাজিক ব্যবস্থা এবং সংগঠন সম্পর্কিত আধুনিক তত্ত্বের লেখকদের মতবাদ ব্যবস্থা মতবাদ (System Theory) হিসেবে পরিচিত। ব্যবস্থা মতবাদ অনুযায়ী সংগঠন হলো পারস্পরিক সম্পর্ক ও ক্রিয়াকলাপের এক ব্যবস্থা, যা সর্বদাই স্থিতিশীল থেকে যায় অথচ এতে সংশ্লিষ্ট বস্তু ও কর্মশক্তি পরিবর্তনশীল থাকে। এরূপ সংগঠন এর পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয় ও তাকে প্রভাবিত করে এবং এ পরিবেশের ভিতর এক গতিশীল সাম্যাবস্থায় উপনীত হয়।
সংগঠনের আধুনিক মতবাদের অনুসারীগণ কর্মচারী এবং সংগঠনকে একত্রে সুসংহত করার প্রয়াস গ্রহণ করে। তারা কর্মচারীদের প্রয়োজনের সাথে সংগঠনের প্রয়োজনকে সুসংহত করার উদ্দেশ্য অধিকতর সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে চান। কর্মচারীগণ অবশ্যই তাদের উপরস্থ কর্তৃপক্ষের আদেশ-নির্দেশ পালনে বাধ্য থাকবে-অথবা উপরস্থ কর্মকর্তা সংগঠনের স্বার্থ বা উৎপাদন সম্পর্কিত কোন প্রকার চিন্তাভাবনা না করেই প্রতিনিয়ত কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া মেনে নেবে-এরূপ কোন ধারণাই বর্তমানকালে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করা হয় না। ব্যক্তি তার কর্মশক্তি, দক্ষতা ও আনুগত্য প্রদানের মাধ্যমে সংগঠনকে যা প্রদান করে, এর প্রতিদানস্বরূপ সে যে স্বীকৃতি পারিশ্রমিক ও নিরাপত্তা লাভ করে তার ফলে এ দুই-এর মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। সংগঠনের কর্মচারীদের এ দান- প্রতিদানের বিষয়টিকে বলা হয় সাংগঠনিক সাম্যাবস্থা (Organizational Equlibrium)। যখন ব্যক্তি কর্মচারী তার নিজের ও সংগঠনের মধ্যে বিদ্যমান ভারসাম্যকে মেনে নেয়, তখন আরো ভালো পরিবেশ সৃষ্টি হয়। উত্তম পরিবেশে কর্মচারীগণ আরও গঠনমূলক উপায়ে কাজ করতে সক্ষম হয়।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অসন্তোষজনক পরিবেশে কাজ করার ফলে কর্মচারীর মনে দরকষাকষির মনোভাব সৃষ্টি হয়। এরূপ মানসিকতা সুষ্ঠু কর্মপরিবেশে বিঘ্ন ঘটায়। সাম্প্রতিককালে মানবিক আচরণ সম্পর্কিত গবেষণায় এরূপ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সংগঠনের এসব মতবাদ কর্মচারী প্রশাসনের ক্ষেত্রে এক উন্নয়নমূলক ধারণার সৃষ্টি করেছে। সংগঠনের আধুনিক মতবাদ ‘ব্যবস্থা মতবাদ’.অনুযায়ী প্রাথমিক সামাজিক গোষ্ঠীই হচ্ছে সংগঠনের মূল ইউনিট। এ মৌলিক গোষ্ঠীভুক্ত ব্যক্তিবর্গের আচরণগত একই প্রকারের কতকগুলো আদর্শ ও মূল্যবোধ রয়েছে, যেগুলো পরস্পরের প্রতি ও গোষ্ঠীবহির্ভূতদের প্রতি তাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।
সংগঠন যেহেতু বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমবায়ে গঠিত, সেহেতু এর মধ্যে কর্মরত কর্মচারীদের আনুগত্য লাভের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের শক্তি তৎপর ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত থাকে। গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে ক্ষমতা ও পদমর্যাদা কঠোরভাবে সিনিয়রিটি, শক্তি, বিশেষ দক্ষতা ও জ্ঞান, সম্পদ ইত্যাদির ভিত্তিতে বণ্টন করা যেতে পারে। অথবা সেখানে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা অনিয়মমাফিক উপায়েও বণ্টিত হতে পারে। সংগঠনের কার্যাবলি দক্ষতার সাথে পালনের জন্য এ সকল গোষ্ঠীর কার্যকলাপ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকা এবং সংগঠনের লক্ষ সাধনের পথ সুগম করার স্বার্থে গোষ্ঠীর কর্মতৎপরতাকে কাজে লাগানোর সামর্থ্য থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। গোষ্ঠীর কর্মতৎপরতাকে সংগঠনের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব একান্ত আবশ্যক।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক সংগঠন তত্ত্ব অনুযায়ী সংগঠন হলো পরস্পর নির্ভরশীল উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত একটি ব্যবস্থা। আধুনিক সংগঠন তত্ত্ব কোনভাবেই একক চিন্তার খাতে প্রবাহিত নয়। প্রত্যেক লেখক এবং গবেষক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যবস্থা পদ্ধতি আলোচনা করেছেন। আধুনিক ‘ব্যবস্থা পদ্ধতি’র আলোচনার মধ্যে সকলেই সংগঠনকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন’ অর্থাৎ সংগঠনের আধুনিক তত্ত্বে বিভিন্ন ধরনের চিন্তাধারার লিখিত সুরের প্রাধান্য সুস্পষ্ট সংগঠন সম্পর্কিত আধুনিক তত্ত্ব অর্থাৎ ‘ব্যবস্থা মতবাদ’ অনুযায়ী আধুনিক কালের সংগঠনকে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা উচিত। কারণ আধুনিক সংগঠনগুলো বড় বড় গোষ্ঠী বা ‘হায়ারার্কী’কে নিয়ে গঠিত। এ সকল গোষ্ঠী বা হায়ারার্কীসমূহ আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় ধরনের অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত হয়। পরস্পর বিরোধী প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোর অনানুষ্ঠানিক ক্রিয়াকলাপ সংগঠনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অংশ বিশেষ। সংগঠনের অভ্যন্তরে থেকে এর সদস্যগণ অন্যান্য প্রত্যেকের কার্যকলাপের উপর মনোভাব, অনুভূতি ও মূল্যবোধগত প্রভাব বিস্তার করে থাকে। অর্থাৎ প্রতিটি সংগঠনের তার নিজস্ব কৃষ্টিগত পরিবেশও রয়েছে।
Leave a comment