ওয়ার্ডওয়ার্থের প্রকৃতি বর্ণনাতেও এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পাওয়া যায়। পূর্ববর্তী কবিগণ প্রকৃতি বর্ণনা করেছেন, কিন্তু সেই বর্ণনা ছিল প্রধানত পরিবেশ বর্ণনা। সেখানে প্রকৃতি এসেছে মানুষের সহায়করূপে এবং প্রেক্ষাপট সৃষ্টিতে। কিন্তু ওয়ার্ডসওয়ার্থের ক্ষেত্রে প্রকৃতি জীবন্ত। শুধু জীবন্তই নয়, প্রকৃতি মানুষের শেষ আশ্রয়। কবির মতে প্রকৃতিই হচ্ছে friend. philosopher and guide।
কবির বয়স যখন চৌদ্দও পেরোয়নি, সেই বয়সেই প্রকৃতির মধ্যে অনন্ত বৈচিত্র্য সম্বন্ধে তিনি সজাগ হয়ে উঠলেন। ওই বয়সে অন্যান্য কবিরা যেখানে প্রকৃতির বুকে লালিত হন, সেখানে ওয়ার্ডওয়ার্থ পড়েন প্রকৃতির প্রেমে। প্রকৃতি সম্বন্ধে এই বোধ প্রণয় ও পরিণয় কবি বিস্তৃতভাবে প্রকাশ করেছেন তাঁর আত্মকাহিনীমূলক The Prelude of Growth of a Poets Mind আখ্যানকাব্যে এবং তাঁর আরও অনেক কবিতায়। এই আখ্যানকাব্যটি কবির এক মহাগ্রন্থ, ‘দ্য রিক্রুজ’ (The Recluse) লিখতে চেয়েছিলেন তিন খণ্ডে যাতে প্রকৃতি, মানব ও সমাজ সম্বন্ধে কবির ভাবনা ও দর্শন চিন্তা প্রকাশিত হবে। এর প্রথম দুটি হল ‘দ্য প্রিলুড’ (The Prelude) এবং ‘দ্য এক্সকারসন’ (The Excursion)। তৃতীয়টি প্রকৃতি চেতনার মহাভাষ্য। ওয়ার্ডওয়ার্থের প্রকৃতি চেতনার বিবর্তন ধারা লক্ষ্য করলে দেখা যায় অতি সাধারণ ব্যক্তি চেতনায় যে প্রকৃতি-প্রেমের সূত্রপাত, নির্বিশেষ ধ্যান তন্ময়তা তার উপসংহার।
‘দ্য প্রিলুড’ কাব্য থেকে জানা যায় কবির বয়স যখন দশ তখন প্রকৃতির প্রতি এক দুর্বার আকর্ষণ তিনি বোধ করেছেন। তবে সে আকর্ষণের মধ্যে ছিল এক অন্ধ বা অবোধ আনন্দ ও ভয়, আর ছিল অনির্দিষ্ট, অস্পষ্ট, ভাসা ভাসা অনুভব, কিন্তু তা এমন সর্বগ্রাসী যে কবি ইচ্ছে থাকলেও তা ঝেড়ে ফেলতে পারতেন না। এই বয়সে তিনি কী অনুভব করেছেন তা নয়, কেমনভাবে অনুভব করেছেন (not what he felt, but how he felt’) সেই কথা এবং কীভাবে প্রকৃতিপ্রেমিক হয়ে উঠলেন তার ক্রমপরিণতির মুখ্য স্তরগুলির কথা তিনি বিবৃত করেছেন তার ইম্মটালিটি ওড’ (The Immortality Ode) কবিতায়।
ষোল বছর বয়সে প্রকৃতি সম্বন্ধে এ সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় ভাবনার কোরক থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃতি ও প্রকৃতিপ্রেম সম্বন্ধে তিনি সজাগ হয়ে উঠলেন। তিনি অনুভব করতেন তিনি প্রকৃতির একটা অংশমাত্র নন, প্রকৃতি তারই এবং তাঁর নিজের চেতনা ও প্রকৃতির স্বতঃলব্ধ জ্ঞান বা স্বজ্ঞার মধ্যে কোনো পার্থক্যই নেই। কবি মানসিকতার এই পর্যায়কে আমরা দ্বিতীয় পর্যায় বলতে পারি। এই যুগ ইন্দ্রিয়ানুভূতির যুগ। কবির সমগ্র অন্তচেতনা এক তীব্র আবেগ ও passion দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
তৃতীয় পর্যায়ে কবি-মানসিকতার পরিবর্তন ঘটল। প্রথমত ফরাসি বিপ্লবের আশাভঙ্গহীনতা কবি-চেতনাকে অনুভূতিহীন করে তুলেছিল। জীবনের প্রতি সমগ্র আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে মরুভূমির ঊষরতা ব্যঞ্জিত হল। কবি মানসিকতার এই অপমৃত্যু থেকে তাঁকে রক্ষা করল একদিকে স্নেহময়ী ডরোথি এবং বন্ধু কবি কোলরিজের নিবিড় সাহচর্য, অপরদিকে হ্রদ-বেষ্টিত কাম্বারল্যান্ড অঞ্চলের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য। আশাভঙ্গ ও শূন্যতার ক্ষত নিরাময়ে ওয়ার্ডওয়ার্থের কাছে প্রকৃতিই হয়ে উঠল soother and healer। এই পর্বে নতুন করে প্রকৃতির অনুধ্যানের সঙ্গে যুক্ত হল সুগভীর মানবপ্রেম। প্রকৃতিকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মানুষকেও ভালোবাসলেন। ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথাকে নিয়ে মানুষের সাধারণ জীবন অসাধারণ ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ হয়ে রোমাণ্টিক মানবতাবাদী কবি ওয়ার্ডওয়ার্থের দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হল। ওয়ার্ডওয়ার্থের প্রকৃতি চেতনার বিবর্তনে প্রথম পর্বে প্রকৃতি বালক কবির খেলার সাথী এবং ক্রীড়া উচ্ছ্বাসের পটভূমি। দ্বিতীয় পর্বে সর্বেন্দ্রিয় দিয়ে চলেছে কবির প্রকৃতি আপ্যায়ন। প্রকৃতি ও মানবের একাত্মতা এখানে উচ্চারিত হয়নি। তৃতীয় পর্বের আশাভঙ্গের মনোবেদনায় কবি প্রকৃতির মধ্যেই পেলেন বিশল্যকরণীর খোঁজ এবং নতুন করে প্রকৃতিকে ভালবাসার মধ্য দিয়ে নতুন করে মানুষকেও ভালবাসলেন।
প্রকৃতি-চেতনার বিবর্তনের পথে চতুর্থ পর্বে কবির দার্শনিক সত্তা বড়ো হয়ে উঠল। প্রকৃতিকে তিনি দেখলেন philosopher and guide-রূপে। কলেজের ছুটিতে রাত্রে বনে বনে বেড়ানোর সময় তিনি নিজেকে একজন উৎসর্গিত আত্মা (dedicated spirit) বলে অনুভব করেছিলেন। ‘সিম্পলন পাস’ (The Simplon Pass). ‘টিনটার্ন অ্যাবে’ (Tintern Abbey) প্রভৃতি কবিতাতে কবি অনুভব করলেন যে ভগবৎসৃষ্ট বৃষ্টি, বাতাস, কুয়াশা, তুষার সবকিছুর মধ্য দিয়ে একজনের ইচ্ছাই মূর্তরূপ পরিগ্রহ করেছে। কবি নিজেও এই ইচ্ছারই এক প্রকাশ। উপলব্ধির চরম পর্যায়ে ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতির মধ্যে ভগবানের জ্যোতির্ময় আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করলেন। অতীন্দ্রিয় অনুভূতির সুনিবিড় প্রশান্ত উপলব্ধিতে কবির কাব্যভাষা যেন মন্ত্রের ভাষা হয়ে উঠল। কবি ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের মধ্যে শোনা গেল ঋষি ওয়ার্ডওয়ার্থের কণ্ঠস্বর। রোমান্টিক কবির চেতনায় জেগে উঠল মিষ্টিক কবির সুর।
Leave a comment