সূচনা: বৌদ্ধগ্রন্থ ‘অঙ্গুত্তরনিকায়’, জৈনগ্রন্থ ‘ভগবতীসূত্র’, হিন্দু পুরাণ প্রভৃতি থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতে কোনাে ঐক্যবদ্ধ কেন্দ্রীয় শক্তির অস্তিত্ব ছিল না। উক্ত সাহিত্যিক উপাদানগুলি থেকে এই সময় উত্তর ভারতে ষােলােটি ছােটো ছােটো রাজ্যের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। এই ষােলােটি ক্ষুদ্র রাজ্যকে একত্রে ষােড়শ মহাজনপদ বলা হয়। ষােড়শ মহাজনপদের মধ্যে উত্তর ভারতে পনেরোটি এবং দক্ষিণ ভারতে একটি রাজ্যের উত্থান ঘটেছিল।
ষােড়শ মহাজনপদের রাজ্যগুলির অবস্থান ছিল আফগানিস্তানের কাবুল থেকে দক্ষিণ ভারতে গােদাবরী নদীর উপকূলের মধ্যবর্তী অঞ্চলে। রাজ্যগুলি হল一
[1] কাশী: এর অবস্থান ছিল বর্তমান উত্তরপ্রদেশের পূর্বদিক।
[2] কোশল: এর অবস্থান ছিল বর্তমান অযােধ্যা বা শ্রাবস্তী।
[3] অঙ্গ: এর অবস্থান ছিল বর্তমান পূর্ব বিহার। এই রাজ্যের রাজধানী ছিল চম্পা।
[4] মগধ: মগধের অবস্থান ছিল বর্তমান বিহারের গয়া ও পাটনা জেলা। এর প্রথম রাজধানী ছিল গিরিব্রজ বা রাজগৃহ। পরে পাটলিপুত্রে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়।
[5] অবন্তী: এর অবস্থান ছিল বর্তমান মালব ও মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশে। এর উত্তরাংশের রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী ও দক্ষিণাংশের রাজধানী ছিল মাহিস্মতি।
[6] বৎস: এর অবস্থান ছিল বর্তমান এলাহাবাদের নিকটবর্তী গঙ্গার দক্ষিণ তীরে। এর রাজধানী ছিল কৌশাম্বী।
[7] বৃজি: এর অবস্থান ছিল বর্তমান উত্তর বিহারে। এর রাজধানী ছিল বৈশালী।
[8] মল্ল: এর অবস্থান ছিল বর্তমান উত্তরপ্রদেশের গােরক্ষপুর জেলা। এর রাজধানী ছিল কুশীনগর বা পাবা।
[9] কুরু: এর অবস্থান ছিল বর্তমান দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। এর রাজধানী ছিল ইন্দ্রপ্রস্থ।
[10] পাঞ্চাল: এর অবস্থান ছিল বর্তমান রােহিলখণ্ড। উত্তর পালের রাজধানী ছিল অহিচ্ছত্র এবং দক্ষিণ পাঞ্চালের রাজধানী ছিল কাম্পিল্য।
[11] চেদি: এর অবস্থান ছিল বর্তমান বুন্দেলখন্ড ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। এর রাজধানী ছিল শুকতিমতী।
[12] মৎস্য: এর অবস্থান ছিল বর্তমান রাজপুতানার জয়পুর। এর রাজধানী ছিল বিরাটনগর।
[13] শূরসেন: এর অবস্থান ছিল যমুনা নদীর তীরে মথুরা অঞ্চল। এর রাজধানী ছিল মথুরা।
[14] অম্মক: এর অবস্থান ছিল বর্তমান গােদাবরীর উপত্যকা অঞ্চল বা পাটলি। এর রাজধানী ছিল পােটালি বা পােটান।
[15] গান্ধার: এর অবস্থান ছিল বর্তমান রাওয়ালপিন্ডি ও কাশ্মীর উপত্যকা। এর রাজধানী ছিল তক্ষশিলা৷
[16] কম্বোজ: এর অবস্থান ছিল বর্তমান দক্ষিণ-পশ্চিম কাশ্মীর। এর রাজধানী ছিল রাজপুর।
প্রথমদিকে ষােড়শ মহাজনপদের রাজ্যগুলির মধ্যে অবন্তী, বৎস, কোশল এবং মগধ-এই চারটি রাজ্য প্রাধান্য লাভ করেছিল। অবশেষে হর্ষঙ্ক, শৈশুনাগ, নন্দ ও মৌর্য—এই চারটি রাজবংশের আমলে মগধকে কেন্দ্র করে উত্তর ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
[1] সুযোগ্য নেতৃত্ব : হর্ষঙ্ক বংশের বিম্বিসার, অজাতশত্রু, শৈশুনাগ বংশের শিশুনাগ, নন্দ বংশের মহাপদ্মনন্দ, মৌর্য বংশের চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশােক প্রমুখ রাজন্যবর্গের দক্ষ নেতৃত্বে মগধের সাম্রাজ্যবাদ সফলভাবে পরিচালিত হয়েছিল। মগধের বাসসাকর, কৌটিল্য, রাধাগুপ্ত প্রমুখ মন্ত্রীবর্গের সুযােগ্য পরামর্শও এবিষয়ে যথেষ্ট সহায়তা করেছিল।
[2] বিদেশি আক্রমণ থেকে রক্ষা : মগধের অবস্থান ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের উপদ্রুত অঞ্চল থেকে অনেক দূরে হওয়ায় বিদেশি আক্রমণকারীদের পক্ষে ভারতের অভ্যন্তরে এত দূরে আক্রমণ করা সহজ ছিল না।
[3] ভৌগােলিক অবস্থান : মগধ রাজ্য ও রাজধানী নদী ও পাহাড়ের দ্বারা বেষ্টিত ছিল। মগধের প্রথম রাজধানী রাজগৃহ ছিল পাহাড়বেষ্টিত। পরবর্তী রাজধানী পাটলিপুত্র গঙ্গা, শােন ও গণ্ডক নদীবেষ্টিত হয়ে যেন এক জলদুর্গে পরিণত হয়েছিল। এরূপ ভৌগােলিক নিরাপত্তা ভেদ করে শত্রুদের পক্ষে মগধ আক্রমণ করা সহজ কাজ ছিল না।
[4] উর্বর কৃষিজমি: গঙ্গা ও অন্যান্য নদীবিধৌত মগধের কৃষিজমি ছিল খুবই উর্বর। কৃষিতে প্রচুর উৎপাদনের ফলে প্রভূত পরিমাণ রাজস্ব আদায় সম্ভব হত। ফলে মগধে সৈন্যদের ভরণ-পােষণে সুবিধা ও রাজকোশের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল।
[5] বৈদেশিক বাণিজ্য: বিভিন্ন দূর দেশের সঙ্গে মগধের রপ্তানি বাণিজ্য চলত। মগধের সমৃদ্ধ বৈদেশিক বাণিজ্যের ফলে সেখানকার অর্থনীতি মজবুত হয়েছিল। এই আর্থিক শক্তি মগধের সামরিক শক্তির ভিতও শক্ত করেছিল।
[6] অরণ্য সম্পদ: মগধের ঘন অরণ্য ছিল হিংস্র জীবজন্তু ও অসংখ্য বৃক্ষে পরিপূর্ণ। এইসব বৃক্ষের কাঠ যুগ্ধকরণে কাজে লাগত। এ ছাড়া এই অরণ্য থেকেই মগধের সৈন্যের যুদ্ধের জন্য প্রয়ােজনীয় রণহস্তী সংগ্রহ করা হত।
[7] খনিজ সম্পদ: মগধের তামা ও লােহার খনিগুলি সামরিক অস্ত্রশস্ত্র ও কৃষির জন্য প্রয়ােজনীয় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যবহৃত হত। ফলে মগধের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষিরও উন্নতি হয়েছিল।
[8] মিশ্র সংস্কৃতি : মগধের সীমানার একদিকে আর্য ও অন্যদিকে অনার্য সংস্কৃতির অবস্থান থাকায় এখানে এক মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা মগধের অগ্রগতিকে সহজ করেছিল।
Leave a comment