১৮০০ খ্রীস্টাব্দের ১০ই জানুয়ারী শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন এবং ঐ বছরের মার্চ মাসে শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের কাজ শুরু হয়। এই মিশনের ধর্মপ্রচার ও মুদ্রণ কার্যই ছিল প্রধান। পরিচালনায় ছিলেন উইলিয়ম কেরী (১৭৬১ খ্রীঃ-১৮৬৪ খ্রীঃ), জন টমাস (১৭৫৭ খ্রীঃ-১৮০১ খ্রীঃ), যশুয়া মার্শম্যান (১৭৬৮ খ্ৰীঃ-১৮৩৭ খ্রীঃ), উইলিয়াম ওয়ার্ড (১৭৬৯ খ্ৰীঃ-১৮২৩ খ্রীঃ) রামরাম বসু প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। এই মিশনারীদের প্রতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসকবর্গের অনুদার মনোভাব থাকায় দিনেমার অধিকৃত শ্রীরামপুরে এঁরা মিশন ও প্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এঁদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ধর্মপ্রচার। সেই কারণে বাইবেলের অনুবাদ এবং প্রচার-পুস্তিকা প্রণয়ন ও মুদ্রণে এঁরা মনোযোগী হন। কিন্তু ধর্মপ্রচারের সঙ্কীর্ণ উদ্দেশ্য অতিক্রম করে সেইসঙ্গে দেশীয় গ্রন্থ মুদ্রণে, সংবাদপত্র প্রকাশে এবং বাংলা ভাষা নির্মাণে উদ্যোগী হন।
(ক) দেশীয় ভাষায় গ্রন্থ-মুদ্রণ : বাংলা গদ্যে লেখা প্রথম পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, কেরীর সংস্কৃত ব্যাকরণ, ব্যোপদেবের মুগ্ধবোধ, কোলব্রুক-সম্পাদিত অমরকোষ, মূল সংস্কৃতে সাংখ্যপ্রবচন-ভাষ্য, কেরী ও মার্শম্যান সম্পাদিত বাল্মীকি রামায়ণ (চার খণ্ড), কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশীরাম দাসের মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থ মিশন প্রকাশ করে।
(খ) বাইবেল অনুবাদ ও প্রচার-পুস্তিকা প্রকাশ : উইলিয়ম কেরীর ‘মঙ্গল সমাচার মাতিউর রচিত’ (১৮০০), নিউ টেস্টামেন্ট সমগ্র অংশ ও ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রথম অংশ (১৮০১), কেরী-কৃত বাইবেলের বঙ্গানুবাদ (১৮০৯), কেরীর ‘কৃষ্ট ও খ্রীস্টের তুলনা’, ‘হিন্দুদিগের প্রতি ভাষণ’, ওয়াটের ‘নিশ্চিত শরণ লাভ’ (১৮০১), কেরীর ‘ধর্মপুস্তক’ (১৮৩২-৩৩) এখান থেকে প্রকাশিত হয়। এইভাবে ১৮১৮ খ্রীস্টাব্দের পূর্বে প্রায় আশিখানি গদ্য প্রচারপুস্তিকা প্রকাশ করে তার সাত লক্ষ কপি মিশন বিতরণ করেছিল।
(গ) জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাস-সাহিত্যাদি প্রকাশ : ইংরেজী ও বাংলা দুই ভাষাতেই লেখা হয় জন ক্লার্ক মার্শম্যানের ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’, দুখণ্ড (১৮৩১), ‘পুরাবৃত্তের সংক্ষেপ বিবরণ সংকলন’ (১৮৩৩), ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ (১৮৪৮), ‘ব্যবস্থা বিধান’ বা আইনের পরিভাষা (১৮৫১), ফেলিক্স কেরীর ‘ব্রিটিশ দেশীয় বিবরণ সঞ্চয়’ (১৮২০), ‘যাত্রীদের অগ্রেসরণ বিবরণ’ বানিয়নের ‘Pilgrim’s Progress-এর অনুবাদ (১৮২১), জন ম্যাকের ‘কিমিয়াবিদ্যার সার’ নামে রসায়নগ্রন্থ, জন রবিনসনের ‘রবিনসন ক্রুশের জীবনরচিত’ অনুবাদ গ্রন্থ ইত্যাদি। উপরোক্ত গ্রন্থগুলি বাদে ওয়েঙ্গার, পিয়ার্স, লসন, হার্লি, পিয়ার্সন ও জেমস কিথ, বাটন প্রমুখ লেখকদের বিভিন্ন রচনা শ্রীরামপুর প্রেস, স্কুল বুক সোসাইটি থেকে মুদ্রিত হয়।
(ঘ) সংবাদপত্র প্রকাশ : যশুয়া মার্শম্যানের পুত্র জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় প্রথম বাংলা পত্রিকা সাপ্তাহিক দিগ্দর্শন (এপ্রিল, ১৮১৮ খ্রীঃ) এবং ঐ বছরেই সাপ্তাহিক ‘সমাচারদর্পণ’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
শ্রীরামপুর মিশন প্রধানতঃ বিভিন্ন ভাষায় বাইবেল অনুবাদ ও প্রচার করে নিজস্ব ভূমিকা পালন করে। তবে বহুবার সংশোধন সত্ত্বেও ন’বছরের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই অনুবাদের ভাষা কখনই তেমন স্বচ্ছন্দ বা মার্জিত হয়নি। যেমন : “খ্রীস্টের স্বর্গে গমনের পরে মঙ্গল সমাচার প্রকাশ হইল প্রায় সকল সংসারে। তাঁহার অনেক শিষ্যেরা তাহা প্রকাশনের কারণ বধ পাইল। য়িরোশলমও ধ্বংস হইল এবং য়িহোদী বর্ণ ছাড়িয়া গেল সর্ব পৃথিবীতে। যেমন খ্রীস্ট কহিয়াছিলেন। মঙ্গল সমাচার প্রকাশ হইলে সমস্ত ঠাকুর ঠাকুরাণী লোপ হইল, লোক ত্যাগ করিল তাহাদের সেবা ও আপনারদের হাত দিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিল পশ্চিমদিগের প্রতিমাকে। …এবং সে যোহনের ছিল উটের লোমের পরিচ্ছদ ও চর্মের পটুকা কোমরে, তাহার ভক্ষ্য ও পঙ্গপাল, ফড়িঙ্গ ও বনমধু।”
এই অবোধ্য অনুবাদের ব্যর্থতার মূলে আছে কয়েকটি কারণ; যেমন—
(১) ইংরেজী সাহিত্যে ‘বাইবেল’ ধর্মগ্রন্থ হয়েও ‘সাহিত্য’ হিসাবে তার লিখনশৈলীর জন্য আদরণীয় হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় তাকে শুধুমাত্র ‘শাস্ত্র’ রূপে জ্ঞান করে তার মূলানুবাদের দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। ঐতিহাসিক গোপাল হালদারও এই ত্রুটি উল্লেখ করে বলেছেন : “সত্যই যদি বাইবেল স্বচ্ছন্দ বাঙলায় অনূদিত হত তাহলে বাঙলা লেখকদের ভাব জগতের মধ্যে হয়ত যীশুর উক্ত কথা, বা গল্প ও ধারণা এমন বেমানান ঠেকত না। কারণ আরবদের ‘আরব্যরজনী’র মত, য়িহুদীদের ওল্ড টেস্টামেন্টও পৃথিবীর একখানা মহৎ গ্রন্থ আর যীশুর কাহিনী সরল ও সরস অপূর্ব ভাব-সম্পদ। সে রস খাঁটি বাঙলায় পরিবেশিত হলে সাহিত্য হত”
(২) নিকৃষ্ট তৎসম শব্দের বাহুল্য, জটিল ও আড়ষ্ট বাক্যরচনা রীতি, বানান ভুল, পদান্বয়দোষ, অসম্বন্ধ বাক্য বিন্যাস, ছেদচিহ্ন স্থাপনে ত্রুটি ইত্যাদি বিবিধ দোষ দেখা যায়।
উপরোক্ত দোষগুলি সত্ত্বেও বলা চলে, এই মিশন ধর্মবিজয়ে সফল না হলেও এদেশীয় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের মনে ধর্মসচেতনতা ও আত্মসচেতনতা বোধ জাগিয়েছিল। তাঁদের আক্রমণাত্মক প্রচার পুস্তিকাগুলির প্রতিক্রিয়ায় রামমোহনের মত বিশ্বন্ধর ব্যক্তিও বিচলিত হয়ে কলম ধরেছিলেন। এছাড়া সংবাদপত্র প্রকাশ করে ও পাঠ্যপুস্তক ও ধর্মগ্রন্থ মুদ্রিত করে মিশনারীগণ এদেশীয়দের মধ্যে পাঠকের কৌতূহল ও জ্ঞানস্পৃহা জাগরণে সহায়তা করেছিলেন। ১৮৩৭ খ্রীস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন লন্ডনের ব্যাপটিস্ট মিশনের সঙ্গে এক হয়ে যায় ও তার স্বাধীন সত্তা লোপ পায়।
Leave a comment