বংশীখণ্ড
০১. বড়ায়ি লইআঁ রাহী গেলী সেই থানে।
সখিসবে বুইল রাধা লড়িউ সিনানে৷৷
ষোল শত গোপী গেলা যমুনার ঘাটে।
তা দেখিআঁ কাহ্নাঞি পাতিল নাটো। (পদ-১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বড়ায়িকে সঙ্গে নিয়ে রাধা সেই স্থানে গমন করলে সখিরা বললো এসো রাধা স্নানে যাই। ষোলো শত গোপী নিয়ে যমুনার ঘাটে যাত্রা করল। তা দেখে কৃষ্ণ নাট্যলীলা আরম্ভ করে দিলেন।
০২. হরিষে পুরিআঁ কাহ্নাঞি তাহাত ওঁকার।
বাঁশীর শবদেঁ পারে জগ মোহিবার।
যমুনার ঘাটে রাধা বাঁশীনাদ সুণী।
জল লআঁ ঘর আয়িলী আইহনের রাণী। (পদ-১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে কৃষ্ণ তাতে ওঙ্কার ধ্বনি দিলেন। বাঁশির শব্দ শুনে জগৎ মোহিত করতে পারে। আইইন পত্নী রাধা যমুনার ঘাটে বাঁশির শব্দ শুনে জল নিয়ে ঘরে ফিরল।
০৩. আকুল করিতে কিবা আহ্মার মন।
বাজাএ সুসর বাঁশী নান্দের নন্দন।
পাখি নহোঁ তার ঠাই উড়ী পড়ি জাওঁ।
মেদনী বিদার দেউ পসিআঁ লুকাওঁ। (পদ-২)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আমার মন আকুল করার জন্যই কি নন্দের পুত্র কৃষ্ণ সুমধুর সুরে বাঁশি বাজায়। (আমি) পাখি তো নই যে তার কাছে উড়ে যাব। হে ধরিত্রী (পৃথিবী) বিদীর্ণ হও সেখানে প্রবেশ করে আত্মগোপন করি।
০৪. সুসর বাঁশীর নাদ সুণী আইলো
মো যমুনাতীরে।
শোভন কলসী করে ধরিআঁ
পারিলো যমুনানীরে।
বড়ায়ি ল।
বাঁশীর নাদ না শুণী এবে
কাহ গেলা কিবা দূরে।
প্রাণ বেআকুল ভৈল এবে
কিমনে জায়িবোঁ ঘরে। (পদ-৩)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আমি মধুর বাঁশির সুর শুনে যমুনা তীরে এলাম। শোভন কলসী হাতে নিয়ে যমুনার জল পার হলাম। ওগো বড়াই, বাঁশির সুরতো আর শুনতে পাইনে, কৃষ্ণ কি দূরে চলে গেল? আমার প্রাণ যে বড়ো ব্যাকুল হয়ে উঠল, কেমন করে ঘরে ফিরে যাব।
০৫. আহোনিশি মো আন না জাণো
এত দুখ কহিবো কাএ।
কাহ্নের ভাবে চিত্ত বেআকুল
লাজে মোঁ না কান্দো রাএ॥ (পদ-৩)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: কতদিন আমি আর অন্য কিছুই জানি না, আমার এ দুঃখের কথা কাকে বলব? কৃষ্ণের ভাবনায় আমার চিত্ত ব্যাকুল, লজ্জায় আমি চিৎকার করে কাঁদতে পারি না।
০৬. এবে বড় নয়নে মো না দেখোঁ সুন্দরী।
কথাঁ গেলে পাইব আহ্মে শ্রীকৃষ্ণ হরী॥
হেনক উপায় মোক বোল চন্দ্রাবলী।
তবে মো তোহ্মাক আণি দিবোঁ বনমালী॥ (পদ-৪)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ : সুন্দরী (রাধা), আমি এখন চোখ মেলে দেখতে পাই না। কোথায় গেলে আমি শ্রীকৃষ্ণকে পাব। চন্দ্রাবলী, আমাকে কোন উপায় বলে দাও। তবে, আমি তোমার বনমালীকে এনে দেব।
০৭. আইস ল বড়ায়ি মোর রাখহ পরাণ।
সহিতে না পারোঁ মদন পাঁচ বাণ॥
সরস বসন্ত ঋতু কোকিল রাএ।
আধিক বিরহশিখি হৃদএ জলএ॥ (পদ-৫)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো বড়ায়ি, এসো আমার প্রাণ রক্ষা কর। মদনের পঞ্চবাণ সহ্য করতে পারছি না। কাল সরস বসন্ত, কোকিল ডাকছে। হৃদয়ে বিরহ-জ্বালা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
০৮. কে বোলে চন্দন চাঁদ আতি সুশীতল।
আহ্মার মনত ভাএ যেহেন গরল॥
নব কিশলয় ভৈল দহন সমান।
ঘাঅত উপরে ঘাঅ বাঁশীর সান॥ (পদ-৫)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: চন্দন ও চাঁদকে কে অতি সুশীতল বলে, আমার কাছে সবকিছু বিষ মনে হয়। নব কিশলয় আমার কাছে আগুনের সমান। সেখানে বাঁশির সুর যেন আঘাতের উপর আঘাত।
৯. আষাঢ় শ্রাবণ মাসে মেঘ বরিষে যেহ্ন
ঝরএ নয়নের পাণী।
আল বড়ায়ি
সংপুটে প্রণাম করি কুইলোঁ সব সখিজনে
কেহো নান্দোকাহ্নঞিকে আণী॥ (পদ-৬)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে মেঘ থেকে যেমন বৃষ্টি ঝরে তেমনি আমার নয়ন থেকে জল ঝরে। ওগো বড়ায়ি, কর জোড় প্রণাম করে সব সখীকে বললাম কিন্তু কেউ আমার কৃষ্ণকে এনে দিল না।
১০. কাহ্নঞি বিহাণে মোর সকল সংসার ভৈল
দশ দিগ লাগে মোর শূন।
আঞ্চলের সোনা মোর কে না হরি লআঁ গেল
কিবা তার কৈলোঁ অগুণ।॥(পদ-৬)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: কৃষ্ণ ছাড়া আমার সকল (পদ-৬) সংসার এবং দশ দিক শূন্য মনে হয়। আমার আঁচলের সোনা কে চুরি করে নিল, আমি তার কি ক্ষতি করেছি।
১১. উত্তম গোআলকুলে তোহ্মার জরম।
তোহ্মাকে জুগত নহে এ সব করম॥
দুচারিণী যার মা তার হেন গতী।
সেসি পর পুরুষের বাঞ্ছএ সুরতী॥(পদ-৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: উত্তম গোপীকুলে তোমার জন্ম। এসব কাজ তোমার সাজে না। যার মা দ্বিচারিণী তারই এমন অবস্থা হয়। সেই পর পুরুষের সঙ্গে রতি বাসনা কামনা করে।
১২. দূতা তোক লয়িআঁ কাহ্নের মুখ দেখিবো।
মো জে কস্তুরী কফুর খাইবোঁ।
কিশলয় শয়ন বিছাইবো।
কাহ্ন আলিঙ্গিআঁ সকল দেহ জুড়ায়িবোঁ॥ (পদ-৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: দূতি, তোকে সঙ্গে নিয়ে আমি কৃষ্ণের মুখ দর্শন করব। আমি কস্তুরী কর্পর খাব। কচি পাতার শয্যা বানাবো। কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে শরীর জুড়াব।
১৩ . আল রাধা।
বৃন্দাবনে কাহ্নাঞি আণিবোঁ।
তোর সঙ্গে সুরতী করায়িবোঁ।
যত দুখ দেখিলোঁ তোহ্মারে।
একে একে কহিবোঁ কাহ্নেরে॥
আবসি সোঁঅরি তোর নেহে।
কাহ্নাঞি আসিব কুঞ্জগেহে॥ (পদ-৯)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো রাধা, কৃষ্ণকে বৃন্দাবনে এনে তোর সঙ্গে রতি-ক্রিয়া করাব। তোমার যত দুঃখ দেখলাম সব কৃষ্ণকে বলব। অবশ্যই তোর প্রেম স্মরণ করে কৃষ্ণ কৃষ্ণ গৃহে আসবে।
১৪. রাধা তোওঁ মুগধী আবালী গোআলী
না জাণ কহ্নের শুধী।
তোহোর অন্তরে চতুর কাহ্নাঞি
পাতএ আশেষ বুধী॥ (পদ-১০)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: রাধা, তুই মোহমুগ্ধ বুদ্ধিহীন গোয়ালিনী। কৃষ্ণের ব্যাপারে কিছুই জানিস না। তোর কারণেই চতুর কৃষ্ণ নানা প্রকার ছলনা বিস্তার করে।
১৫. ঘরেত বাহির হইআঁ নাগর কাহ্নাঞি
কোণ দিগে সার ণীসারে।
বাঁশির শব্দে চিত্ত বেআকুল বড়ায়ি
জাইবোঁ তার আনুসারে॥(পদ-১১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ঘর থেকে বের হয়ে নাগর কৃষ্ণ কোনদিকে বাঁশি বাজাচ্ছে। ওগো বড়াই, বাঁশির সুরে আমার চিত্ত ব্যাকুল হলো। আমি তার সন্ধানে বের হব।
১৬. বৃন্দাবন পসিআঁ সুন্দুর কাহ্নাঞি
বাঁশী বাএ সুললিত ছান্দে।
হার কঙ্কন পসিআঁ সব তেআগিবোঁ
সুণী তাক বুক কে বা বান্ধে॥ (পদ-১১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বৃন্দাবনে প্রবেশ করে সুন্দর কৃষ্ণ সুললিত সুরে বাঁশি বাজায়। ওগো বড়াই, আমি হার কঙ্কন সব ত্যাগ করব। বাঁশির শব্দ শুনে আমি বুক বেঁধে রাখতে পারছি না।
১৭. আগর চন্দনে বড়ায়ি শরীর লেপিআঁ।
কেলি কৈল যেই বৃন্দাবনত পসিআঁ॥
নাগর কাহ্নাঞি সমে বিবিধ বিধানে।
এবে লআঁ চল বড়ায়ি সেই বন্দাবনে॥ (পদ-১৩)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বড়াই, অগুরু চন্দনে শরীর লেপন করে কানাই যে বৃন্দাবনে প্রবেশ করে নগরের সাথে বিবিধ খেলা করছে, সেই বৃন্দাবনে আমাকে নিয়ে চলো।
১৮. বড়ার বৌহারী আহ্মে বড়ার ঝী।
কাহ্ন বিনি মোর রূপ যৌবনে কী৷৷
এরূপ যৌবন লআঁ কথাঁ মো এঁ জাওঁ।
মেদনী বিদার দেউ পসিআঁ লুকাওঁ৷৷ (পদ-১৩)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আমি মানী লোকের বৌ এবং মানী লোকের কন্যা তাই কৃষ্ণকে ছাড়া আমার রূপ যৌবন দিয়ে কী হবে। এরূপ যৌবন নিয়ে আমি কোথায় যাই। মেদিনী (পৃথিবী) বিদীর্ণ হও, প্রবেশ করে নিজেকে লুকাই।
১৯. তোহ্মাত লাগিআঁ এত কৈল দামোদরে৷৷
তভোঁ তাক দোষ দেসি তোওঁ বারে বারে৷৷
এখন বোলহ রাধা আহ্মার মরন।
এবেঁ কথাঁ পাইব আহ্মে নান্দের নন্দন ৷৷ (পদ-১৪)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: তোমার জন্যই দামোদর (কৃষ্ণ) এতো করল, তবুও বারে বারে তাকেই দোষ দিচ্ছ। রাধা তুমি এখন বলছ আমার মরণ হোক। আমি এখন নন্দের নন্দকে কোথায় পাব।
২০. রান্ধনের জুতি হারায়িলোঁ বড়ায়ি
সুণিআঁ বাঁশীর নাদে॥
নান্দের নান্দন কাহ্ন আড়বাঁশী বাএ
যেন রএ পাঞ্চরের শুআ।
তা সুণিআঁ ঘৃতে মো পরলা বুলিআঁ
ভাজিলোঁ এ কাঁচা গুআ ৷৷ (পদ-১৫)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বড়ায়ি, বাঁশির শব্দ শুনে রান্নার জো হারালাম। নন্দের নন্দন কৃষ্ণ আড়বাঁশি বাজায়। মনে হয় যেন পিঞ্জরের শুকপাখি রব করে। আমি তা শুনে বিভ্রান্ত হয়ে পটল বলে এই কাঁচা সুপারি ঘিয়ে ভাজলাম।
২১. আপণার সুখে কাহ্নঞি ভ্রমে বৃন্দাবনে।
লাজ না বাস বুলিতে হেন বচনে।
তাহাক আণিতে তোক্ষে নাম্বায়িলে আম্বলে।
ছোলঙ্গ চিপিআঁ রস দিলে নিমঝোলে ৷৷ (পদ-১৬)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: কৃষ্ণ মনের সুখে বৃন্দাবনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব কথা বলতে তোমার লজ্জা হয় না। তাকে (কৃষ্ণকে) আনবার জন্যই তুমি অম্বল নামালে এবং টক লেবু চিপে রস দিলে নিমঝোলে।
২২. কাখেত কলসী বড়ায়ি জাওঁ ধীরে ধীরে।
চতুৰ্দ্দিশ চাহো বড়ায়ি যমুনার তীরে ৷৷
বাঁশী নাদ সুণী কাহ্ন দেখিতে না পাওঁ।
মেদনী বিদার দেউ পসিঞাঁ লুকাওঁ ৷৷ (পদ-১৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো বড়াই কাঁকে কলসী নিয়ে ধীরে ধীরে চলছি। যমুনার তীরে চারদিকে দেখছি। বাঁশির সুর শুনতে পাচ্ছি কিন্তু কৃষ্ণকে দেখতে পাচ্ছি না। মেদিনী (ধরণী) দ্বিধাবিভক্ত হোক, তার মধ্যে প্রবেশ করে লুকাই।
২৩. যমুনার তীরে বড়াই কদমের তলে।
পূর্ণ ঘট পাতী বড়ায়ি চাহি ত মঙ্গলে ৷৷
মঙ্গল পায়িলে হয়ে চিত্তের সোআপ্লে।
তবেসি মেলিব এখাঁ প্রিয় জগন্নাথে ৷৷ (পদ-১৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বড়াই, যমুনাতীরের কদমতলে পূর্ণঘট পেতে মঙ্গল কামনা করি। মঙ্গল পেলে চিত্ত স্বস্তি পাবে। তবেই প্রিয় জগন্নাথের (কৃষ্ণের) সঙ্গে মিলন হবে।
২৪. কোপছলে পরিখে তোহ্মার মতি কাহ্নে।
এখন পায়িবাক তাক না কর যতনে।।
বিরহে বিকল হআঁ তোহ্মার থানে।
আপণে মেলিব আসি নাগর কাহ্নে ৷৷ (পদ-১৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: কৃষ্ণ রাগের ছলে তোমার মন পরীক্ষা করছে, এখন তাকে পাবার জন্য চেষ্টা করোনা। বিরহে ব্যাকুল হয়ে নাগর কানাই (কৃষ্ণ) নিজে এসে তোমার (রাধার) সঙ্গে মিলিত হবে।
২৫. শ্রীনন্দনন্দন গোবিন্দ হে।
অনাথী নারীক সঙ্গে নে ৷৷
দুঅজ পহরে নিন্দে আকুল আইহন।
নাছে গিআঁ চাহে রাহী নান্দের নন্দনা ৷৷
চারি পাশ চাহে রাহী চমকিত মনে।
কথাঁহো না পায়িল কাহ্নের দরশনে ৷৷ (পদ-১৯)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: হে নন্দনন্দন গোবিন্দ অনাথী নারীকে সঙ্গে নাও। দ্বিতীয় প্রহরে আইহন নিদ্রায় অভিভূত হলে রাধা পথে বেরিয়ে নন্দের নন্দনকে (কৃষ্ণকে) খুঁজতে লাগল। চমকিত মনে রাধা চারদিকে খুঁজতে লাগল কিন্তু কোথাও কৃষ্ণকে দেখতে পেল না।
২৬. তোহ্মার বচনে যমুনাক আহ্মে জাইব।
তথাঁ গেলে কেমনে কাহ্নঞির লাগ পাইবা ৷৷
তথাঁ বাঁশী চোরায়িতে করিউ যতনে।
যমুনার তীরে সব খন থাকে কাহ্নে ৷৷ (পদ-২০)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: তোমার কথায় আমি যমুনাতে যাব কিন্তু সেখানে গেলে দেখা পাব কিভাবে। সেখানে গিয়ে কৃষ্ণের বাঁশিটি চুরি করতে চেষ্টা করো। কৃষ্ণ সারাক্ষণ যমুনার তীরেই থাকে।
২৭. যমুনার তীরে কদম তরুতলে
বাঅ বহে সুশীতলে
তথাঁ বশিআঁ সে দেবরাজ
পুরিল বাঁশীত শরে ৷৷
নিদ্রাহো আসিআঁ চাপিল কাহ্নে
তেঁসি না গেলা ঘরে।
নব কিশলয় শয়নে সুতিল
বাঁশীত দিআঁ সিারে ৷৷ (পদ-২১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: যমুনাতীরে কদমগাছের তলায় সুশীতল বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। সেখানে বসে দেবরাজ বাঁশিতে সুর দিল। অতঃপর তাঁকে নিদ্রা পেয়ে বসলো। সেজন্য সে (রাধা) ঘরে গেল না। নব (কৃষ্ণ) কিশলয় শয়নে মাথার কাছে বাঁশিটি রেখে ঘুমিয়ে গেল।
২৮. বাঁশী হারায়িলো বড়ায়িল
আল গোকুলে আসিআ।
হাকান্দ করুণা করোঁ ভূমিত লোটায়িআঁ ৷৷
এবে কে বা নীল মোহন বাঁশে।
মুকুতার ঝারা পাটখোপ দুআ পাশে ৷৷
মাণিকে খঞ্চিল তথি সোনার পাতা।
সুরপতী জাণে মোর বাঁশীর বারতা ৷৷ (পদ-২২)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো বড়াই, গোকুলে এসে বাঁশি হারালাম। এই দেখো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ব্যাকুল হয়ে বিলাপ করছি। এমন মোহন বাঁশিটি কে নিল। তার দু’পাশে মুক্তার ঝালর, পাটের গুচ্ছ। মানিকে খচিত সোনার পাতে তা মোড়ানো। সুরপতি আমার বাঁশির বৈশিষ্ট্য জানে।
২৯. সুণহ সুণহ কাহ্ন না কর আতোষে।
আহ্মে সব কহিআঁ দিব বাঁশীর উদ্দেশে।
আহ্মার বচনে তোক্ষে কর অবধান।
গোপীকুলের তোক্ষে কৈলে আপমান ৷৷
তেকারণে এবে আহ্মে করি অনুমান।
তে সঙ্গে চোরায়িল বাঁশী তোর কাহ্ন ৷৷(পদ-২৩)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: শোন কানাই (কৃষ্ণ), দুঃখ করো না। আমি তোমার বাঁশির সন্ধান বলে দেব। আমার কথা তুমি মন দিয়ে শোন। তুমি গোপীদের অপমান করেছ। সে জন্য আমি অনুমান করছি তারা সকলে মিলে তোমার বাঁশি চুরি করেছে। হে মুরারী (কৃষ্ণ) বাঁশির সন্ধান তোমাকে বললাম। গোপীদের মধ্যে কেউ তোমার বাঁশি চুরি করেছে।
৩০. মোরে বাঁশীগুটি দিআঁ মেণ দানে।
আল হে রাধা
বারেক রাখহ সমানে ল॥
বাঁশী পাইল হর গৌরী বরে।
দেখিতে আতি মনোহরে।
যার নদে গোকুল রহে ৷৷ (পদ-২৪)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো রাধিকা আমাকে বাঁশিটি দান করে অন্তত একবার আমার সম্মান রাখ। দেখতে অতি মনোহর এ বাঁশি হরগৌরীর বরে পেয়েছি। যার সুরে গোকুল স্থির থাকে।
৩১ . গলাত পাথর বান্ধি দহে পইসওঁ
কিবা মরোঁ আনলে পুড়িআঁ।
তবে বা মোওঁ কাহ্নের ঝগড় এড়াওঁ
কিবা মরোঁ খরল খায়িআঁ ৷৷ (পদ-২৫)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: গলায় পাথর বেঁধে দহে প্রবেশ করব। কিংবা আগুনে পুড়ে মরব। তবেই বুঝি আমি কৃষ্ণের কলহ এড়াতে পারব, না হয় আমি বিষ খেয়ে মরব।
৩২. হরি হরি।
কে না পরাণে দুখ দিল।
আল হের।
বিরহবিনোদ বাঁশী নিল হে ৷৷
মোর বাঁশী ত্রিভুবনে জাণী।
খিঞ্চিল মাণিকে হিরা মণী ৷৷
বাঁশী নিআঁ রাধা নাহি মানে।
সে নিল জাণো আনুমানে ৷৷ (পদ-২৬)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: হায় হায় ভগবান, কে আমার প্রাণে এতো দুঃখ দিল। ওগো দেখ, বিরহ বিনোদ আমার বাঁশিটি চুরি করে নিল। ত্রিভুবনে আমার বাঁশির কথা কেনা জানে। হীরা- মণি-মানিকে তা খচিত। বাঁশি নিয়ে রাধা স্বীকার করছে না। অনুমানে জানি সেই (রাধা) বাঁশি নিয়েছে।
৩৩. বড়ার ঝিআরী বড়ার বৌহারী
আহ্মে আইহণের রাণী।
আহ্মে বাঁশী তোর চোরায়িল কাহ্নাঞি
মুখে আন হেন বাণী ৷৷(পদ-২৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আমি আইহনের স্ত্রী, সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে, সম্ভ্রান্ত ঘরের বৌ। আমি তোমার বাঁশি চুরি করেছি। এমন কথা কানাই, মুখে আন।
৩৪. নাটকী গোআলী ছিনারী পামরী
সত্যে ভাষ নাহি তোরে।
তোএঞ নিলী বাঁশী (পদ-২৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: নাটুকে গোয়ালিনী ছিনালপাপীয়সী। তোর কি সত্য কথা বলতে মানা। তুই-ই (রাধা ) নিয়েছিস বাঁশি।
৩৫. কোণ আসুভ খনে পাঅ বাঢ়ায়িলো।
হাঁছী জিঠী আয়র উঝট না মানিলোঁ।
শুন কলসী লই সখী আগে জাএ ৷৷ (পদ-২৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: কোন অশুভ ক্ষণে পা বাড়ালাম। হাঁচি, টিকটিকি, হোঁচট মানলাম না। শূন্য কলসী নিয়ে সখী আগে যাচ্ছিল। বাঁয়ের শিয়াল আমার ডান দিকে যাচ্ছিল।
৩৬. ঘৃত দধি দুধ বড়ায়ি দহতে পেলায়িবোঁ ৷৷
যোগিনীরূপে মো দেশান্তর লইবোঁ।
আনলকুণ্ডত কিবা তনু তেআগিবোঁ।
কাহৃত লাগিআঁ কিবা বিষ খাইআঁ মরিবোঁ ৷৷ (পদ-২৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বড়াই ঘি, দই, দুধ জলে ফেলে দেব। যোগিনী হয়ে দেশান্তরে যাব। অগ্নিকুণ্ডে দেহ ত্যাগ করবো। কিংবা কৃষ্ণের জন্য বিষ খেয়ে মরবো।
৩৭. আপণা চিহ্নিআঁ বাঁশী দেহ মোরে আণী।
যবে তোর পরাণ না লৈব চক্রপাণী ৷৷
সব আভরণ তোর কাঢ়িআঁ লইবোঁ ৷৷
বাঁশীত লাগিআঁ তোক রান্ধিআঁ রাখিবোঁ ৷৷
জীবার আশ যবে আছএ তোহ্মার।
ঝাঁট করী বাঁশীগুটী দিআর আহ্মার ৷৷ (পদ-২৯)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: নিজের মঙ্গল চেয়ে আমার বাঁশিটি এনে দাও। নইলে চক্রপাণি তোমার প্রাণ নেবে। তোমার সব অলঙ্কার কেড়ে নেবে। বাঁশির জন্য তোমাকে বেঁধে রাখব। যদি তোমার বাঁচার ইচ্ছা থাকে তবে তাড়াতাড়ি আমার বাঁশিটি শিয়া দিয়ে দাও।
৩৮ . হারায়িল তোহ্মার বাঁশী তেঁসি বাড়ায়িতে হাসি
মোর বোল সুণ চক্রপাণী।
বুলী চৌর পৈসে ঘরে গিহীক সত্বর করে
হেন দুঠ বড়ায়ির বাণী ৷৷ (পদ-৩০)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: তোমার বাঁশি হারিয়ে গেল সেজন্য বড়াই হাসছে। হে চক্রপাণি আমার কথা শোন। একদিকে চোরকে ডেকে ঘরে ঢোকায় অন্যদিকে গৃহীকে সতর্ক করে, এমনি ধূর্ত বড়ায়ির কথাবার্তা।
৩৯. কেহ্নে আমান করসি।
আক্ষে জাণী তোক্ষে নিলে বাঁশী ৷৷
তোরে বোলোঁ চন্দ্রাবলী আকুল মো বনমালী
তোহ্মে কৈল চুরী মোর বাঁশী।
কথাঁ নিআঁ বাঁশী এড়ি মিছাঞি দোষসি বুড়ী
হৃদয়ত ভয় না মানসী ৷৷ (পদ-৩১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: কেন অস্বীকার করছ। আমি জানি তুমিই বাঁশি নিয়েছ। চন্দ্রাবলী তোমাকে বলছি আমি বনমালী আকুল। তুমি আমার বাঁশি চুরি করেছ। কোথায় লুকিয়ে রেখেছ। এখন মিছেমিছি দোষ দিছে বুড়িকে। তোমার মনে ভয় হয় না।
৪০. চান্দ সুরুজ বাত বরুণ সাখী।
যে তোর বাঁশী নিল সে খাউ দুয়ি আখী।
যবে মোর চুরী কৈলো হআঁ নারী সতী।
তবে কালসাপ খাইএ আজিকার রাতী। (পদ-৩২)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: চন্দ্র, সূর্য, বাতাস, বরুণ * সকলই সাক্ষী, যে তোর বাঁশি নিয়েছে সে তার দু’চোখের মাথা যাক। আমি সতী নারী হয়ে যদি চুরি করে থাকি তবে আজ রাতেই যেন আমাকে কাল সাপে খায়।
৪১. চান্দ সুরুজ মোর আছে দুয়ি সাখী।
আহ্মা মিছা দোষ কাহ্ন খাইবি দুঈ আখী ৷৷
সপ্ত লাখের মোর বাঁশী করী চুরী।
আহো গালী দেহ মোরে রাধিকা নাগরী। (পদ-৩৩)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: চন্দ্র, সূর্য উভয় সাক্ষী আছে আমার তাই কানাই (কৃষ্ণ) আমাকে মিছেমিছি দোষ দিলে দু’চোখের মাথা যাবে। নাগরী রাধা, আমার সাত লাখ টাকার বাঁশি চুরি করে আমাকে আবার গালি দিচ্ছে।
৪২. অপ্রাণ ধরণ না জাএ সুন্দরি রাধে।
কে না নিল মোহন বাঁশী ৷৷
ঋগ যজু সাম আথর্ব্ব
চারী বেদ পাওঁ মোর বাঁশীর সরে।
সুণী সব দেবগণে কি বুলিহে আক্ষারে
কে না নীল বাঁশী সিঅরে ৷৷ (পদ-৩৪)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: হায় সুন্দরী রাধা, প্রাণ যে আর ধরে রাখতে পারি না। কে নিল আমার মোহন বাঁশি। বাঁশি দিয়ে আমি ঋক-সাম-যজু-অথর্ব এই চারি বেদের গান করি। শিয়র থেকে কে আমার বাঁশি নিয়ে গেল। এ কথা শুনে দেবতারাইবা আমাকে কি বলবে।
৪৩. শিঅরে হারায়িত তোক্ষে বাঁশী।
মিছা কেহ্নে আহ্মারে দোষসি।
হয়িল মোর এতেক বএসে।
কেহো নাহি দিল চুরীদোষে ৷৷
সব লোক মোরে ভালে জাণে।
চুরিণী হয়িলাহোঁ তোর থানে ৷৷ (পদ-৩৫)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: হে কানাই, তুমি শিয়র থেকে বাঁশি হারিয়ে কেন আমাকে দোষ দিচ্ছ। আমার এত বয়স হলো, কেউ আমাকে চুরির অপবাদ দেয়নি। সব লোকেই আমাকে ভালো জানে। কেবল তোমার কাছেই আমি চোর হলাম।
৪৪. পান্তরে হারাআঁ বাঁশী মোর থানে খোজসি
এহা না সহে মোর পরাণে।
হেন যবে বোলে আন কাটো তার নাক কান
তোহ্মা তেজোঁ ভাগিনা কারণে ৷৷ (পদ-৩৬)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: মাঠে বাঁশি হারিয়ে আমার কাছে খোঁজ করছ, এ আমার প্রাণে সহ্য হয় না। এমন কথা যদি অন্যে বলত তবে তার নাক, কান কেটে নিতাম । কেবল ভাগনে বলেই ছেড়ে দিলাম।
৪৫. এত বড় মোর আপমাণে।
সুণি কি বুলিব দেবগণে।
সুণ তোক্ষে নান্দের কুমার।
নিজ কাজে বিকল সংসার ৷৷
যোরহাতে বুলিহ বচনে।
সুখী হইব রাধার মণে। (পদ-৩৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আমার এত বড় অপমান। দেবতারা শুনলে কি বলবে। হে কানাই তুমি নন্দের নন্দন। শোন সংসারের সকলেই নিজের কাজে ব্যস্ত। তুমি হাত জোড় করে কথা বলো, রাধা মনে মনে খুশী হবে।
৪৬. মেঘ যেহ্ন আষাঢ় শ্রাবণে।
ঝরে তার পাণী নয়নে, গো ৷৷
কান্দিআঁ মলিন কৈল মুখে।
কত তার দেখিবোঁ দুখে গো ৷৷ (পদ-৩৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের মেঘের মতো তার চোখের জল ঝরছে। কাঁদতে কাঁদতে মুখ মলিন হলো। ওগো তার দুঃখ আর কত দেখব।
৪৭ . বাঁশরী শোকে চক্রপাণী।
এবে তাক দেহ আণী ৷৷
যোড়হাথ কৈল দেব কাহ্নে।
এবে তাক বাঁশী দেহ দাণে ৷৷
নাহি পিন্ধে উত্তম বসনে।
শরীরে দুবল ভৈল কাহ্নো ৷৷ (পদ-৩৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বাঁশির শোকে কাতর। এবার তাকে বাঁশিটি এনে দাও। দেবতা কৃষ্ণ জোড় হাত করছে, এবার তার বাঁশি দিয়ে দাও। সে (কৃষ্ণ) ভালো কাপড় পরে না, শরীর তার দুর্বল হয়েছে।
৪৮. কভোঁ কি না দিবে আহ্মাক দুখে।
এহা বোল আপণ মুখে ৷৷
তবে কহিবোঁ মো বাঁশী উদ্দেশে। (পদ-৩৯)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আমাকে আর কখনো দুঃখ দেবে কি না নিজের মুখে তা বল। তাহলেই আমি তোমার বাঁশির সন্ধান বলে দেব।
৪৯. বিরহে আকুলী যবে চাহোঁ মো তোহ্মারে।
তখন আসিহ তোক্ষে আতি অবিচারে ৷৷
হের ভালমতে চাহি নেহ কাহ্নাঞি বাঁশী।
আজি হৈতে চন্দ্রাবলী হৈল তোর দাষী ৷৷ (পদ-৪১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বিরহে আকুল হয়ে যখন তোমাকে আহ্বান করব তখন তুমি অবিলম্বে আসবে। কানাই ভালোভাবে বাঁশি দেখে নাও। আজ থেকে চন্দ্রাবলী তোমার দাসী হইল।
রাধাবিরহ
১. আইল, চৈত মাস।
কি মোর বসতী আশ ৷৷
নিফল যৌবনভারে।
বিরহে আন্তর জলে।
সুতিলোঁ কদমতলে।
আধিক আন্তর মোর পোড়ে (পদ-১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: চৈত্র মাস এল, নিষ্ফল যৌবন ভার নিয়ে আমার বেঁচে থাকার আশা কোথায়। বিরহে অন্তর জ্বলছে। কদমতলায় শয়ন করলাম। তাতে আমার অন্তর আরো বেশি জ্বলে।
২. ডালী ভরী ফুল পানে।
মোরে পাঠায়িল কাহ্নে।
তাক মো না ছুয়িলোঁ হাথে ৷৷
তাম্বুল না লেলোঁ করে।
তোক মাইলোঁ চড়ে।
তেঁসি কাহ্ন আসুখিল মোরে ৷৷ (পদ-১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ডালা ভরে কৃষ্ণ আমার কাছে ফুল, তাম্বুল পাঠাল। সেসব আমি হাতেও ছুলাম না। তাম্বুল হাতে নিলাম না। তাকে (বড়ায়িকে) চড় মারলাম। তাই কৃষ্ণ আমাকে, দুঃখ দিল।
৩. এ মোর নিফল জীবন এ বড়ায়ি ল।
সে কৃষ্ণ আনিআঁ দেহ মোরে হে॥
লেপিআ তনু চন্দনে বুলিআঁ তবে বচনে
আড়বাঁশী বা এ মধুরে।
চাহিল মোরে সুরতী না দিলোঁ মো আনুমতী
দেখিলোঁ মো দুঅজ পহরে ॥ (পদ-২)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ : হে বড়াই, আমার জীবন করে, নিষ্ফল। সেই কৃষ্ণকে আমার কাছে এনে দাও। শরীর চন্দনে লেপন করে, মিষ্ট কথা বলে মধুর সুরে বাঁশি বাজল। আমার রতি ক্রিয়া চাইল। আমি অনুমতি দিলাম না। দ্বিতীয় প্রহরে এটি দেখলাম।
৪. অনমীষ নয়ন করিআঁ।
বিকলী মো তার বাট চাহিআঁ॥
এবে মোর সংপুন বএসে।
কিকে কাহ্ন করে আমরিষে॥
ঝাঁট করী আন কাহ্ন পাশে। (পদ-৩)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ : অনিমেষ নয়নে ব্যাকুল হয়ে আমি তার পথ চেয়ে আছি। এখন আমার যৌবনকাল। কী কারণে কৃষ্ণ রাগ করে থাকে। অবিলম্বে কৃষ্ণকে পাশে এনে দাও।
৫.কাহ্নের তাম্বুল রাধা দিলো তোর হাথে।
সে তাম্বুল রাধা তোঁ ভাগিলি মোর মাথে।
এবেঁ ঘুষঘুসাআঁ পোড়ে তোর মন।
পোটলী বান্ধিআঁ রাখ নহুলী যৌবন। (পদ-৪)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: রাধা, তোর হাতে কৃষ্ণের তাম্বুল এনে দিলাম। তুই তা আমার মাথায় ছুঁড়ে মারলি। এখন কেন তোর মন ঘুস ঘুস করে পুড়ছে। তোর নবযৌবন পুঁটুলি করে বেঁধে রাখ।
৬. এ ধন যৌবন বড়ায়ি সবঈ আসার।
ছিণ্ডিআঁ পেলাইবোঁ গজমুকুতার হার॥
মুছিআঁ পেলায়িবোঁ মোয়ে সিসের সিন্দুর।
বাহুর বলয়া মোর করিবোঁ শংখচুর॥ (পদ-৫)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ : বড়াই, আমার এ যৌবন-মন- সম্পদ সবই অসার। গজ মুক্তার হার ছিঁড়ে ফেলব। মুছে ফেলব মাথার সিঁদুর। বাহুর বলয় আমি ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করব।
৭. নিবারিআঁ থাক নিজ মনে।
আপণা রাখিআঁ কাহ্ন এবেঁ গেলা নিজ থান
তাক পাইব কেন মনে॥
তোর চরিত্র ভাবি আন্তর দগধ হআঁ
ভালমন্দ কিছু না মানিআঁ।
প্রতিজ্ঞা করিআঁ কাহ্নে গেল মাঝ বৃন্দাবনে
তোর নেহে তিনাঞ্জলী দিআঁ॥ (পদ-৬)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: নিজের মন সংযত করে থাক। নিজের মান রক্ষা করে কৃষ্ণ এখন নিজের জায়গায় চলে গেছে। তাকে কেমন করে পাব। তোর চরিত্র চিন্তা করে দগ্ধ চিত্তে ভালোমন্দ কিছু না ভেবে কৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করে তোর প্রেমকে ভুলে মাঝ-বৃন্দাবনে চলে গেছে।
৮. পোড়ে কলেবর সেই চন্দনে।
আহ্মা নিআঁ যাহ সেই বৃন্দাবনে॥
বাঘ ভালুকে আতি গহনে।
কেমনে যাইবে সে বৃন্দাবনে॥
বাঘ ভালুকে বা আহ্মাক খাউ।
কাহ্নাঞির উদ্দেশে পরাণ ঝাউ ॥ (পদ-৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: সেই চন্দনেও শরীর জ্বালা করে, আমাকে সেই বৃন্দাবনে নিয়ে চল। গভীর বনে বাঘ ভালুক থাকে। কেমন করে সে (রাধা) বৃন্দাবনে যাবে। বরং বাঘ, ভালুকই আমাকে খাক। কৃষ্ণের জন্য প্রাণ যাক।
৯. তথাঁ না পাইলে চাইহ যশোদার কোলে।
মায়া পাতে কাহ্নঞি তথাঁ নিন্দাভোলে॥
তথাঁ না পাইআঁ চাইহ যমুনার কূলে।
বাছা রাখিবারে কাহ্ন চাএ সে গোকুলে॥
‘তথাঁ না পাইআঁ চাইহ যমুনার ঘাটে।
শিশু সঙ্গে বেড়াএ সে যমুনানিকটে॥ (পদ-৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: সেখানে না পেলে যশোদার কোলে খোঁজ কোরো। ঘুমের ছলে সেখানে কৃষ্ণ মায়া পেতে থাকে। সেখানে না পেলে যমুনার তীরে সন্ধান করিও। কানাই গরু চরাতে গোকূলে যায়। সেখানে না পেলে যমুনার ঘাটে দেখবে। সে যমুনাতটে শিশুদের সঙ্গে বেড়ায়।
১০. মোওঁ ত সুন্দরি রাধা আতি বড় বুঢ়ী ল
বেড়ায়িতে মোতে বল নাহী।
মোঞ যে বোলোঁ উত্তর তাত আনুমতি কর
আপণেঞি চাহ ত কাহ্নাঞি॥ (পদ-৯)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: সুন্দরী রাধা, আমিতো অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়েছি। ঘুরে বেড়ানোর শক্তি আমার নেই। আমি যে কথা বলি তাতেই রাজি হও। নিজেই কৃষ্ণের সন্ধান কর।
১১. না বিকাএ যদি দুধ তথাঁ।
সুণ বড়ায়ি ল।
তভোঁ কাহ্নাঞি সমে হৈবে কথা।
আল হের।
মথুরার নামে প্রাণ ঝুরে।
সুণ বড়ায়ি ল।
সাদ লাগে কাহ্নাঞি দেখিবারে।
পিন্ধি বউল পুষ্পের হার।
কন্নত কুণ্ডল হিরার ধার।
পিন্ধিআঁ আমূল পাটোলে।
কাহ্নাঞি দেখি পড়ি গেলোঁ ভোলে৷৷ (পদ-১০)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: দেখ রাধা দুধ যদি সেখানে না বিক্রি করি। তাহলেও কৃষ্ণের সাথে কথাতো হবে। ওগো বড়াই, মথুরার জন্য প্রাণ কাঁদে। কৃষ্ণকে বার বার দেখার ইচ্ছা হয়। গলায় বকুল ফুলের মালা আর কানে হীরার ঝালর দেওয়া কুন্তল এবং বহু মূল্য পট্টবস্ত্র পরিধান করে কৃষ্ণকে দেখে আমি আত্মবিস্মৃত হয়েছি।
১২. মুকুলিল আম্ব সাহারে।
মধুলোভে ভ্রমর গুজরে।
ডালে বসী কুয়িলী কাঢ়ে রাএ॥
যেহ্ন লাগে কুলিশের ঘাএ॥ (পদ-১১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আমের শাখা মুকুলে ভরে গেল। মধু লোভে ভ্রমর গুঞ্জন করে। ডালে বসে কোকিল ডাকে যেন কুলিশের ঘা লাগে।
১৩. হৃদয়ে ভরস কর থাক মোর থানে।
আপণে মেলিব তোেক গোকুলের কাহ্নে।
আইস মোর সঙ্গে রাধা যাই বৃন্দাবনে।
চাহি কুঞ্জে কুঞ্জে তোর প্রিয় নারায়ণে।
বারতা পুছিউ রাধা সব জন থানে।
আবসি দেখিল কেহো শ্রীমধুসূদনে৷ (পদ-১৪)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: মনে বিশ্বাস রেখে আমার কাছে থাক। গোকুলের কৃষ্ণ নিজেই এসে তোমার সাথে মিলিত হবে। রাধা আমার সাথে চল বৃন্দাবনে যাই। তোমার প্রিয় নারায়ণকে কুঞ্জে কুঞ্জে খোঁজ করি। রাধা প্রত্যেকের কাছে জিজ্ঞেস করব, কেউ কৃষ্ণকে দেখেছে কি না।
১৪. দূতা ল
তোক্ষে কি দেখিলে কৃষ্ণ জায়িতে।
এ বাটে জায়িতে গায়িতে নান্দের পোঅ
হাসিতে এ বাঁশী বোলায়িতে॥
নির্মূল কমল বঅনে নীল উতপল নয়নে
রতন কুণ্ডল শোভে কন্নে।
মাণিক দশন যুতী গিএ শোভে গজমুতী
জীএ রাহি তার দরশনে ॥ (পদ-১৫)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো দূতি, তুমি কি কৃষ্ণকে যেতে দেখেছ। গান গাইতে গাইতে বাঁশি বাজাতে বাজাতে নন্দের পুত্রকে এই পথে যেতে দেখছ। নির্মল কমল বদন। নয়ন নীল উৎপল। কানে লোভা পায় রত্ন কুণ্ডল। মানিক্যতুল্য দর্শন জ্যোতি এবং গলায় গজ মতি শোভা পায়। তাকে দেখলে রাধা প্রাণে বাঁচে।
১৫. শুভযাত্রা করি রাধা কর মনোবল।
তথাঁ তোর মনোরথ হয়িব সফল।
অক্ষে জাণি কাহ্নাঞির চরিত্র সকল।
ছাড়িতে না পারে সে তো কদমের তলা॥ (পদ-১৬)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: শুভ যাত্রী করে হে রাধা, মনে শক্তি সঞ্চয় কর। সেখানে তোমার মনোবাসনা সফল হবে। আমি কানাইয়ের চরিত্র সম্পর্কে সব জানি। সে তো কদমতলা ছাড়তে পারে না।
১৬. তরুদল চালএ পবনে।
কাহ্ন আইসে হেন তাক মানে।।
না দেখিআঁ ছাড়এ নিশাসে।
বড়ায়িক মাঙ্গে আশোআসে।
হেনমতে কতোখন রহী।
কতদতলাত রাধা রাহী।
না পাইল কাহ্নাঞি দৈবদোষে। (পদ-১৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বাতাসে বৃক্ষের নড়াচড়া দেখে রাধার মনে হয় কৃষ্ণ আসছে। না দেখে নিঃশ্বাস ছাড়ে, বড়াইয়ের কাছে আশ্বাস প্রার্থনা করে। এই ভাবে কতক্ষণ কদমতলায় থেকেও রাধা দুর্ভাগ্যক্রমে কৃষ্ণকে দেখা পেল না।
১৭. দিনের সুরুজ পোড়াআঁ মারে।
রাতিহো এ দুখ চান্দে।
কেমনে সহিব পরাণে বড়ায়ি চখুত নাইসে নিন্দে।
শীতল চন্দন আঙ্গে বুলাওঁ তভোঁ বিরহ না টুটে।
মেদিনী বিদার দেউ গো বড়ায়ি
লুকাওঁ তাহার পেটে। (পদ-১৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: দিনের বেলায় সূর্য পুড়িয়ে মারে। রাতেও চাঁদ দুঃখ দেয়। বড়াই, কেমন করে প্রাণে সহ্য করব। চোখে ঘুম আসে না। অঙ্গে শীতল চন্দনের প্রলেপ দেই। তবুও বিরহ যায় না। ওগো বড়াই, পৃথিবী বিদীর্ণ হোক। তার মধ্যে লুকিয়ে বাঁচি।
১৮. মেঘ আন্ধারী অতি ভয়ঙ্কর নিশী।
একসরী ঝুরোঁ মো কদমতলে বসী॥
চতুৰ্দ্দিশ চাহোঁ কৃষ্ণ দেখিতে না পাওঁ।
মেদনী বিদার দেউ পসিআঁ লুকাওঁ॥(পদ-১৯)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: মেঘের আঁধার অতি ভয়ঙ্কর রাত। কদমতলায় একা বসে চোখের জল ফেলছি। চারদিকে তাকাই, কৃষ্ণকে দেখতে পাই না। ধরণী দ্বিধাবিভক্ত হও। প্রবেশ করে নিজেকে লুকাই।
১৯. বড় পতিআশে আইলোঁ বনের ভিতর।
তভোঁ না মেলিল মোরে নান্দের সুন্দর॥
উন্নত যৌবন মোর দিনে দিনে শেষ।
কাহ্নাঞি না বুঝে দৈবে এ বিশেষা॥ (পদ-১৯)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বড়ো প্রত্যাশা করে বনের ভিতর এলাম। তবুও কৃষ্ণের দেখা মিলল না। আমার যৌবন দিনে দিনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কানাই একথা বুঝে না।
২০. মথুরার পথে বড়ায়ি এহি কদমের তলে
ধীরে ধীরে বহে বসন্তের বাএ।
এবে নানা ফুলে মোঞা সেজা বিছাইআঁ
কাহ্নাঞি কাহ্নাঞি দেওঁ রাত্র॥ (পদ-২০)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বড়াই, মাথুরার পথে এ কদমতলায় ধীরে ধীরে বসন্তের বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। এখানে আমি বৈচিত্র্য ফুলে শয্যা রচনা করে কানাই কানাই বলে ডাকছি।
২১. সংপুন শশধর বদনে।
কমললোচন পাপ বিমোচনে॥
সে কাহ্নাঞি দিআঁ মোক দুখ আতী।
রতি ভুঞ্জে লআঁ কোণ যুবতী॥ (পদ-২১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: পূর্ণচন্দ্রের মতন মুখ তার। তার এ কমললোচন দর্শনে পাপ মোচন হয়। সেই কানাই আমাকে দুঃখ দিয়ে না জানি কোন যুবতীকে নিয়ে রতি বাসন করছে।
২২. নানা ফুলে সেজা বিছাইআঁ এ
থাকিলোঁ মো কাহ্নকোলে সুতী।
হেন সম্ভেদে মো জাগিলোঁ এ
নিফলে পোহাইল রাতী॥ (পদ-২২)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বিচিত্র ফুলে শয্যা রচনা করে আমি কৃষ্ণের কোলে শুয়ে ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ জেগে উঠলাম। বৃথাই কেটে গেল আমার রাত্রি।
২৩. মুগধী বড়ায়ি তোতে নাহি কিছু বুধী।
হাথে হাথে ছাড়িলী কেহ্নে গুণনিধী॥
আইস তোর সঙ্গে জাইউ বৃন্দাবন।
অআঁ আবসি পাইব নান্দের নন্দন॥
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: মুগ্ধা বড়াই, তোর কোনো বুদ্ধি নাই। গুণনিধিকে হাতে পেয়েও ছেড়ে দিলি কেন। চল তোর সঙ্গে বৃন্দাবনে যাব। সেখানে কৃষ্ণকে অবশ্যই পাব।
২৪. অনাথী নারীক কত থাকে অভিমান।
আলিঙ্গন দিআঁ কাহ্ন রাখহ পরাণ॥
নাহি উপেখিহ মোরে নান্দের নন্দন। (পদ-২৪)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: অনাথা নারীর কতই না অভিমান থাকে। হে কৃষ্ণ আলিঙ্গন দিয়ে প্রাণ রক্ষা কর। নন্দের নন্দন আমাকে উপেক্ষা করো না।
২৫. চল চল গোআলিনী নিবারহ মতী।
ঘর গিআঁ সেব তোক্ষে আইহন পতী॥
কিসক করহ রাধা আহ্মারে যতন।
না পাত জঞ্জাল এবেঁ জাওঁ বৃন্দাবন॥
ছার হেন দেখোঁ এবে তোমার যৌবন।
এতেকে নিবারিলোঁ রাধা তোহ্মাতে মন॥
এহা তত্ত্ব জাণী কর ঘরকে গমন। (পদ-২৫)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: গোয়ালিনী যাও মন নিবৃত্ত করে গিয়ে তোমার স্বামী আইহনের সেবা কর। রাধা আমাকে এতো অনুনয় করছো কেন। গোলমাল করো না আমি এখন বৃন্দাবনে যাচ্ছি। এখন তোমার যৌবনকে আমি তুচ্ছ জ্ঞান করি। এখন থেকে রাধা তোমাতে আমার মন রইল না। একথা সত্য জেনে ঘরে চলে যাও।
২৬. মোর রূপ যৌবনে পড়িলাহা ভোলে।
দূতা দিআঁ পাঠায়িলে কপূর তাম্বুলে॥
দূতাক মাইল আহ্মে উনমত কালে।
আন্তর পোড়এ এবে বিরহ আনলো॥
যোড় হাত করী গোসাঞি বোলোঁ মো তোহ্মারে।
আহ্মার সকল দোষ খণ্ডহ বিদূরে॥
নিকট বসিতে মোক দেহ আনুমতী। (পদ-২৬)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আমার রূপ যৌবনের মোহে পড়ে তুমিই একদিন আমার কাছে দূতীর মাধ্যমে পান-কপূর পাঠিয়েছিল। তখন উন্মত্ত অবস্থায় আমি দূতীকে মেরেছিলাম। এখন বিরহের আগুনে অন্তর পুড়ে যায়। গোঁসাই হাত জোড় করে তোমাকে আমি বলছি। আমার সকল দোষ ক্ষমা করে দাও। আমাকে তোমার পাশে বসতে দাও।
২৭. দূতা দিঞা পাঠায়িলোঁ গলার গজমুতী।
তবে নাম পাড়ায়িলে আহ্মে আবালি সতী॥
এবে কেহ্নে গোআলিণী পোড়ে তোর মন।
পোটলী বান্ধিঞাঁ রাখ নহুলী যৌবনা॥ (পদ-২৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: দূতীকে দিয়ে গলার গজমতি পাঠালাম। তখনও নাম জাহির করলে যে, আমি অবলা সতী। তবে গোয়ালিনী এখন কেন তোমার মন পোড়ে। নবীন যৌবন পুঁটুলি করে বেঁধে রাখ।
২৮. কায় মনে পরসন হয় মোক কাহ্ন।
একবার কর দেব আহ্মার সমান॥
তোহ্মার সমান মোঞে রাধা চন্দ্রাবলী।
কর রতী অনুমতী পৃয় বনমালী॥ (পদ-২৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: কৃষ্ণ, কায় মনে আমার প্রতি প্রসন্ন হও। দেব, একবার আমার সম্মান রক্ষা কর। আমি রাধা চন্দ্রাবলী তোমার অযোগ্য নই। প্রিয় বনমালী, আমার প্রার্থনা মঞ্জুর কর।
২৯. দূর আনুসর সুন্দরি রাহী।
মিছা লোভ কর যায়িতে কাহ্নাঞী॥
ইড়া পিঙ্গলা সুসমনা সন্ধী।
মন পবন তাত কৈল বন্দী॥
দশমী দুয়ারে দিলোঁ কপাট।
এবে চড়িলোঁ মো সে যোগবাটা॥ (পদ-২৯)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: সুন্দরী রাধা দূরে থাক। কৃষ্ণকে পাওয়ার লোভ করছ মিছেমিছি। ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্নার সন্ধিস্থলে মন পবনকে বন্দি করলাম। দশমী দুয়ারে কপাট লাগিয়ে দিলাম। এখন আমি যোগ-মার্গে আরোহণ করলাম।
৩০. কাহ্ন তোহ্মার নেহাত লাগিল।
সকল রজনী জাগিল।
তোহ্মাক না পাইল মোঞে ত বড় আভাগী ল॥
এবে পায়িলোঁ দরশনে ল।
আর জরমের পুনে ল।
দেব দামোদর হয় মোক পরসনে ল ॥ (পদ-৩০)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো কানাই তোমার প্রেমের জন্যই সারা রাত জাগি। আমি বড়োই অভাগী, তাই তোমাকে পেলাম না। গত জন্মের পুণ্য ছিল বলে এখন দেখা পেলাম। ওগো দামোদর, আমার প্রতি প্রসন্ন হও।
৩১. রাধা ল
আহ্মে চিত্ত নেবারিল তোরে।
বাপ বসুল মাঅ দৈবকী হইল মোরে॥
উত্তম কুলত মোর জরম ভৈল ল
আহ্মা লঞা নাহি পরদারে।
…………………………………………
আহ্মে দেব ত্রিভুবনে সারে॥ (পদ-৩১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো রাধা, তোমার কাছ থেকে মনকে সরিয়ে নিয়েছি। আমার বাপ বসুল, মা দৈবকী। উত্তম কূলে আমার জন্ম। আমি পরস্ত্রী গ্রহণ করি না। ত্রিভুবনে শ্রেষ্ঠ দেবতা আমি।
৩২. নানা তপফলে তোহ্মা মোরে দিল বিধী।
আরে
কেহ্নে ঘর জাইতে মোরে বোল গুণনিধী॥
তোক্ষে জবে যোগী হৈলা সকল তেজিঞাঁ।
থাকিব যোগিনী হঞা তোহাঁক সেবিঞা॥(পদ-৩২)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: নানা তপস্যার ফলেই বিধাতা তোমায় আমাকে দিয়েছে। তবে গুণনিধি, কেন আমাকে ঘরে যেতে বল। তুমি যদি সব কিছু পরিত্যাগ করে যোগী হলে। তাহলে আমিও তোমায় সেবা করে যোগিনী হয়ে থাকব।
৩৩. আহ্মে সে কশ্যপ ঋষির কুয়র
তোক্ষে সাগরকোঁয়রী।
যৌবন গরবে আহ্মা না চিহ্নিলী
সুণ মুগধী পামরী।
সব দৈত্যগণ আপনে মারিলো
মোঞে তোহ্মার আন্তরে।
সব দেখে মেলি যুগতি করিঞাঁ
তোহ্মা সফিল আহ্মারে। (পদ-৩৩)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আমি সেই কশ্যপ ঋষির পুত্র, তুমি সাগর দুহিতা, যৌবনের গর্বে মুগ্ধ হে পামরী তুমি আমাকে চিনলে না। তোমার জন্য আমি নিজে অসুরগণকে বধ করেছি। দেবতারা যুক্তি করে তোমাকে আমার কাছে সমার্পণ করেছেন।
৩৪. দৈবকীর পুত্র তোক্ষে বসুলকুমার হে
তোক্ষে দেব কংশের আরী।
গোপীর বালেন্দু হরী আহ্মে বিরহিনী নারী
তোহ্মা বিণি বঞ্চিতে না পারী। (পদ-৩৪)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: তুমি বসুলকুমার দৈবকীর পুত্র। কংসারি দেবতা তুমি। তুমি গোপীদের প্রিয়। কিন্তু আমি তো বিরহিণী নারী। তোমাকে ছাড়া দিন যাপন করতে পারিনে।
৩৫. বিরহ সন্তাপ রাধা একেঁসি জাণিলে।
যৌবন গরবে রাধা আহ্মা না চিহ্নিলে॥
তোহ্মাত লাগিআঁ রাধা বড় পাইলোঁ দুখ।
হেন মন কৈলোঁ না দেখিবোঁ তোর মুখ॥
তোহ্মাত লাগিআঁ রাধা তেআগিল ঘর।
তভোঁ মোর বচনে না দিলে উত্তর॥ (পদ-৩৫)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: রাধা, বিরহ সন্তাপ টের পেলে এতোদিন। রাধা যৌবনগর্বে এতো দিন আমাকে চিনতে পারেনি। রাধা তোমার জন্য বড়ো দুঃখ পেলাম। তাই মনে করছি তোমার মুখ দেখব না। তোমার জন্য রাধা ঘর ছাড়লাম। তবুও আমার কথার উত্তর দিলে না।
৩৬. বিণি দোষে কেহো নাহি তেজে রমণী।
সিতা রামে দুখ পাইল সুণ চক্রপাণী॥
সপনে গেআনে মনে চিন্তো আহোনিশী।
রাতী দিনে একলী কদমতলে বসী॥
তোহ্মাত লাগিআঁ যবে প্রাণ মোর জাএ।
তবে তিরীবধ লাগে কাহ্নাঞি তোহ্মাএ॥ (পদ-৩৬)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বিনা দোষে কেউ স্ত্রীলোক ত্যাগ করে না। শোন চক্রপানি, সীতার জন্য রাম দুঃখ পেয়েছিল। দিন-রাত একাকী কদমতলায় বসে স্বপ্ন জ্ঞানে সারাক্ষণ চিন্তা করি। তোমার জন্য যদি আমার প্রাণ যায়, তবে কানাই তোমাকে স্ত্রী হত্যার পাপ স্পর্শ করবে।
৩৭. যে বেলিতে তোকে দূতা পাঠাইলোঁ
ভাড়াআঁ পাঠাইলি মোরে।
একেঁসি মোর টুটিল সে নেহ
মন জাএ তোহ্মারে॥ (পদ-৩৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: যে কথা বলতে তোমার কাছে দূতী পাঠালাম। তার কথা না শুনেই প্রতারিত করে তাকে আমার কাছে ফেরত পাঠালে। এখন আমার প্রেম টুটে গেছে। আমার মন তোমার কাছ থেকে চলে গেছে।
৩৮. চল চল তোক্ষে সুন্দরি রাধা
মো পরিহরিলোঁ তোরে।
বাপ নন্দ ঘোষ মাঅ যশোদা
তেঁ তুহ্মী মামী আহ্মারে॥
সোনা ভাঙ্গিলে আছে উপাএ
জুড়িএ আগুণতাপে।
পুরুষ নেহা ভাঙ্গিলে
জুড়িএ কাহার বাপে॥ (পদ-৩৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো সুন্দরী রাধা তুমি চলে যাও। আমি তোমাকে পরিত্যাগ করলাম। আমার বাপ নন্দ ঘোষ, মা যশোদা, তাই তুমি আমার মামী। সোনা ভাঙলে আগুনের তাপে জোড়া দেওয়া যায়। কিন্তু পুরুষের প্রেম ভাঙলে জোড়া দেবে কার বাপের সাধ্য।
৩৯. সরস বসন্ত কালে।
কোকিলের কোলাহেলে।
এ নআ যৌবন কাহ্নাঞি প্রাণ রে ॥
এবে তোহ্মার বিরহে।
মোর আকুল দেহে।
আহ্মাকে তেজিতে তোর উচিত নহে॥ (পদ-৩৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো প্রাণের কৃষ্ণ। সরস বসন্তকালে কোকিল কোলাহল করে। এদিকে আমার নব যৌবন। তাই তোমার বিরহে আমার দেহ ব্যাকুল। আমাকে ত্যাগ করা তোমার উচিত নয়।
৪০. এবে কেহ্নে রাধা পাতসি মায়া মোহে।
এহাত না ভুলে আর নান্দের পোহা॥
যতন করিআঁ বেদ কহিলেন্ত বিধী।
পাপ করিলে কোণ কাজে নাহি সিধী॥
আসুর মারিআঁ খণ্ডিবোঁ পৃথিবীর ভার।
পাপ করিলে সে ত নহিব আহ্মার॥ (পদ-৩৯)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: হে রাধা এখন কেন মায়া বিস্তার করছো। এতে নন্দন পুত্র ভুলবে না। বিধাতা বলে দিয়েছেন, পাপ করলে কোনো কাজ সিদ্ধি হয় নানা অসুর বাধ করে পৃথিবীর ভার খণ্ডন করব। পাপ করলে তা হবে না।
৪১. মৈনাক মারিলে কোণ মহাসিধি হএ।
আপণেঞি গুণ কাহ্নাঞি আপণ হৃদএ॥
এ তীন ভুবনে তোহ্মার আধিকার।
তোর আগে গোপনারী হএ কোণ ছার॥ (পদ-৪০)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: কৃষ্ণ, তোমার চরণে আশ্রয় নিলাম। আমাকে যে ফল প্রদান করবে তা এখনই কর। কৃষ্ণ, তোমার সকল দুঃখ সইতে পারি, তোমার বিরহযন্ত্রণা সইতে পারি না।
৪২. আল হের মোরে দয়া না করহ কেহ্নে।
কাহ্নাঞি ল ছাড় নিষ্ঠুর ভাব মনে॥
দুখদিআঁ সত্য বোলোঁ শিরে দেওঁ হাফ।
তোক্ষে মোর প্রাণ জগননাথ॥
জিআঅ আড় নয়নে চাহী।
বিরহের জালাএ মরে রাহী ॥ (পদ-৪১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আমাকে দয়া করছ না কেন। ওগো কানাই মন থেকে নিষ্ঠুর ভাব ত্যাগ কর। মাথায় হাত দিয়ে সত্য করে বলছি। তুমিই আমার প্রাণস্বরূপ জগন্নাথ। রাধা বিরহজ্বালায় মরছে। আড় নয়নে চেয়ে তাকে বাঁচাও।
৪৩. ছিনারী পামরী নাগরী রাধা
কিকে পাতাসি মায়া।
তোক্ষে যবে জাণ আহ্মে তোর প্রিয়
তবে কেহ্নে না কৈলে দয়া ৷৷
পান ফুল দিআঁ পাঠায়িলোঁ তোরে
বাম চরণে টালিআঁ ৷৷ (পদ-৪২)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো ছিনাল পাপীয়সী নাগরী রাধা। কেন মায়া বিস্তার করছ। তুমি যখন জানতে যে, আমি তোমার প্রিয়, তবে কেন দয়া করলে না। দূতীর হাত দিয়ে তোমাকে পান ফুল পাঠিয়ে ছিলাম। তখন বাম পায়ে নাড়া দিয়ে পান ফেলে দিলে।
৪৪. মোরে কি না ভয়িঞাঁ গেল বড়ায়ি নাএ।
বিরহে বিকলী খোঁজো মো নান্দের পোএ॥
নিশি সপন দেখিলোঁ কাহ্ন কোলে করি সুয়িলো
চিআয়িঞাঁ চাহোঁ নাহিক বাল গোপালে।
এ মোর যৌবন ভার সকল ভৈল আসার
আনল সরণ হৈবে দুতা রে॥ (পদ-৪৩)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ : ওগো বড়াই, এ কী না হয়ে গেল আমার। আমি বিরহে ব্যাকুল হয়ে নন্দের পুত্রকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। রাতে স্বপ্ন দেখলাম, কৃষ্ণ আমাকে বুকে নিয়ে শয়ন করল। জেগে দেখি বাল-গোপাল নেই। আমার এ যৌবন ভার সকলি অসার হলো। ওগো দূতী, আগুণই হবে আমার একমাত্র আশ্রয়।
৪৫. যখন কাহ্নাঞি তোরে পাঠাইলে পানে।
তবে তারে বুলিলি বচন আনচানে ৷৷
এবেঁ মোক বোলসি কাহ্নাঞি আণিবারে।
বুঢ় বয়সত বড় দুখ দিলে মোরে ৷৷ (পদ-৪৪)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: যখন কানাই তোমাকে পান পাঠাল তখন তাকে উল্টো কথা বললে । এখন আমাকে বলছ কৃষ্ণ আনতে । বুড়ো বয়সে বড়োই দুঃখ দিচ্ছ আমাকে।
৪৬. মোঁ তোলোঁ যুমনাত পাণী।
পরিহাস কৈল চক্রপাণী।
মতিমোষে যশোদারে কহিলোঁ সে সব কাহিনি ৷৷
কাহ্ন না চিহ্নিলোঁ খাইলোঁ আখী ৷
চান্দ সুরুজ দুয়ি সাখী।
এ রূপ যৌবন কাহ্নেরে থুয়িবোঁ রাখী ৷৷ (পদ-৪৫)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ : আমি যমুনাতে পানি তুলছিলাম চক্রপাণি আমাকে পরিহাস করল। বুদ্ধির ভুলেই সব কথা যশোদাকে বলে দিলাম। চোখের মাথা খেলাম। কানাইকে চিনলাম না। চন্দ্র-সূর্য সাক্ষী এ রূপ যৌবন কৃষ্ণের জন্যই রেখে দেব।
৪৭. এবেঁ তোক্ষে মোরে বোর বুধী।
মোঞ ভৈলোঁ এহাত মুগধী ৷৷
কাকুতী করিল কাহ্ন তোরে।
মোক পাঠায়িল বারে বারে ৷৷
তভোঁ তার না কৈলে সামনে।
তেকারণে রুষ্ট ভৈল কাহ্নে৷ ৷৷ (পদ-৪৬)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: এখন তুমি আমাকে বুদ্ধি দাও। আমার বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। কৃষ্ণ তোমাকে কতো আকুতি করল। আমাকে বার বার পাঠাল। তবু তার সম্মান করলে না। সেই জন্য কৃষ্ণ রুষ্ট হলো।
৪৮. দুহে মেলিআঁ কাহ্নাঞি চাহিল
না পাইআঁ জুড়িল ক্রন্দনে।
হেনই সম্ভেদে নারদ মুনী
আসিআঁ দিল দরশনে ৷৷ (পদ-৪৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: দুজনে মিলে কৃষ্ণকে খুঁজল। পেয়ে রাধা কাঁদতে লাগল। এমন সময় নারদ মুনি এসে দেখা দিল।
৪৯. তোর বিরহ দহনে।
দগধিলী রাধা জীএ তোর দরশনে ৷৷
কুসুমশর হুতাশে।
তপত দীর্ঘ নিশাসে।
সঘন ছাড়এ রাধা বসি এক পাশে ৷৷
ক্ষেপে সজল নয়নে।
দশ দিশে খনে খনে।
নালহীন কৈল যেন নীল নলিনো ৷৷ (পদ-৪৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো তোমার বিরহ-দহনে দগ্ধীভূত রাধা তোমার দর্শন পেলেই বেঁচে উঠবে। পুষ্প-শর যাতনায় রাধা একপাশে বসে ঘন ঘন তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে। ক্ষণে ক্ষণে সজল নয়নে চারদিকে তাকাচ্ছে। যেন নীল পদ্ম বৃন্তচ্যুত করা হয়েছে।
৫০. বনের হরিণী যেন তরাসিনী মনে।
দশ দিশ দেখে রাধা চকিত নয়নে ৷৷
দয়া করী এবেঁ তাক দেহ আলিগংনে । (পদ-৪৯)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বনের হরিণীর মতো রাধা চকিত নয়নে ত্রস্তভাবে চারদিকে চেয়ে দেখছে। দয়া করে এখন তাকে আলিঙ্গন দাও।
Leave a comment