অথবা, বংশী ও বিরহখণ্ড অবলম্বনে কৃষ্ণ চরিত্রের বিকাশ ও গুরুত্ব বিশ্লেষণ কর

অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের বংশী ও বিরহখণ্ড অবলম্বনে কৃষ্ণ চরিত্র আলোচনা কর

উত্তর: শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য আবিষ্কার হওয়ার পর কৃষ্ণ চরিত্র সম্পর্কে বিভিন্ন সমালোচক বিভিন্ন মত দিয়েছেন। কোনো কোনো সমালোচক কৃষ্ণকে মহাকাব্যের ধীরোদা ও নায়ক বলে প্রশংসা করেছেন। ভক্ত পাঠক কৃষ্ণকে ভগবানের অবতার মনে করে তার সমস্ত অশ্লীল আচরণকে লীলা বলে সহজভাবে গ্রহণ করেছেন। আবার সত্যিকার অর্থে কাব্য সমালোচকগণ কৃষ্ণকে গোপপল্লির অসংযত উচ্ছৃঙ্খল যুবক বলেই মনে করেছেন। কেউ কেউ কৃষ্ণের আচার আচরণের মধ্যে বাস্তবানুগামিতার প্রাধান্য দেখে প্রীত হয়েছেন।

এখন ‘বংশী’ ও ‘রাধা বিরহ’ খণ্ড অবলম্বনে আমরা বোঝার চেষ্টা করব কৃষ্ণ চরিত্রের গুরুত্ব ও বিকাশ। কৃষ্ণ চরিত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করে এ চরিত্রের সার্থকতা কতটুকু তা দেখা যাক।

কৃষ্ণ চরিত্র অঙ্কনে কবি বড়ু চণ্ডীদাস চণ্ডদা পৌরাণিক ও লৌকিক ভাবের সম্মিলন ঘটিয়েছেন। পৌরাণিক কংসারী কৃষ্ণ ভগবান বিষ্ণুর বীর রসাত্মক অবতার। তাঁর দেহরূপ বর্ণনায় কবি সংস্কৃত কাব্যোচিত শ্রেষ্ঠ উপমাদির প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু এ চিন্তা কবির হৃদয়ে এবং চরিত্রবোধের অন্তরে প্রবেশ করতে পারেনি। ফলে যে কৃষ্ণকে আমরা এখানে প্রত্যক্ষ করি সে লৌকিক চরিত্রে পরিবর্তিত হয়ে গেছে।

কবি কৃষ্ণকে অবতার রূপে অঙ্কনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গোপপল্লির গোপবালক হিসেবে কৃষ্ণের যে পরিচয় তুলে ধরেছেন। তা একজন অসংযত চরিত্র যুবকেরই প্রতিচ্ছবি। কৃষ্ণ চরিত্র বিশ্লেষণে চার বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। যথা:

  1. কামবৃত্তির প্রবণতা।
  2. বালক স্বভাব।
  3. লঘুকৌতুক এবং
  4. গ্রাম্যতা।

প্রথম হতেই কবি কৃষ্ণকে কামুক লম্পটরূপে চিত্রিত করেছেন। কৃষ্ণ চরিত্রে যে কাম-বাসনার আর্তি প্রকাশ তার সাথে হৃদয়ের সম্পর্ক কম। রাধার দেহ সম্ভোগই তাঁর একমাত্র কামনা। নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির নিমিত্ত সে বড়ায়ির দ্বারস্থ হয়েছে। ইন্দ্রিয়বৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য কৃষ্ণ নানাপ্রকার কলাকৌশল অবলম্বন করেছে। এমনকি রাধার তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও প্রায় বলপ্রয়োগ করতে সে দ্বিধা করেনি। কৃষ্ণের এই কাম-ক্রীড়ার বিস্তৃত বিবরণে যখনই কৌতুক হাস্য এবং বালকসুলভতার স্পর্শ লেগেছে কেবল তখনই তা আস্বাদ্য হয়ে উঠেছে।

প্রেমিক পুরুষ হিসেবে কৃষ্ণ চরিত্রের কোনো মহিমা প্রকাশ পায়নি। রাধার দেহসম্ভোগ ছাড়া কৃষ্ণের মনে রাধার প্রতি স্নেহ, করুণা, প্রেম প্রভৃতি সদবৃত্তির কোনো বিকাশ লক্ষ করা যায় না। রাধাকে যতদিন পর্যন্ত কৃষ্ণ ভোগ করতে পারেনি ততদিন তীব্র আকুলতা প্রকাশ করেছে; কিন্তু দেহ সম্ভোগের পর রাঁধার প্রতি কৃষ্ণের সেই আকুলতা আর দেখা যায় না কৃষ্ণের এই আচরণ ও মনোভাবের জন্য এবং রাধার প্রতি তার মানবিক চেতনা জাগেনি বলেই কৃষ্ণ চরিত্রে অসঙ্গতি বিদ্যমান। রাধা আত্মসমর্পণ করলেও কৃষ্ণ রাধাবিরহের একস্থল ব্যতীত অন্য কোথাও রাধার নিকট মানবিক প্রেমে ধরা দেয়নি। ‘রাধাবিরহে’ রাধার বিলাপ এবং বড়ায়ির অনুরোধে কৃষ্ণ যেন অনিচ্ছা সহকারে রাধার কামনা পূরণ করেছে। রাধা শ্রমান্তে কৃষ্ণের উরুদেশে মাথা রেখে নিদ্রিত হলে কৃষ্ণ সেই অবকাশে, মথুরায় প্রস্থান করে। যাবার সময়ে বড়ায়িকে বলে যায়,

‘তোহ্মার কারণে ল বড়ায়ি।

কৈলো মোঞে রাধার সঙ্গে ল॥

আর বচনেক বোলোঁ সুণ ল বড়ায়ি।

ধরিঞা তোর করে।

তাক রাখিহ যতনে আপণ আন্তরে॥’ (বিরহ, ৫৪)

এ স্থলে বড়ায়ির নিকট রাধাকে যত্নপূর্বক রক্ষা করার অনুরোধ করায় কৃষ্ণের অন্তরশায়ী স্নেহের সামান্যতম স্পর্শ পাওয়া যায়। এছাড়া ‘বাণখণ্ডে’ পুষ্পবাণে আহত রাধাকে মৃত মনে করে কৃতকর্মের জন্য কৃষ্ণ যে বিলাপ করেছিল তার মধ্যে কিছুটা আন্তরিকতার স্পর্শ আছে। এটুকু বাদ দিলে সমগ্র কাব্যের কোথাও রাধার প্রতি কৃষ্ণের আর্তি নেই, প্রেম নেই, স্নেহ নেই, করুণা নেই- কোনোরূপ কোমল প্রবৃত্তির চিহ্নমাত্র নেই। এদিক থেকে কৃষ্ণ চরিত্র বিচার করলে তাকে অসংস্কৃত মনের অধিকারী অসংযত কামুক পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়।

কৃষ্ণ চরিত্রে বালকসুলভতা এবং দাম্ভিকতা বিদ্যমান। ‘বংশীখণ্ডে’ বাঁশি হারিয়ে কৃষ্ণের কাতরতায় তার বালকস্বভাব সর্বাধিক প্রকট। এত মূল্যবান বাঁশিটির তাল হারিয়ে গেল, কি কৈফিয়ৎ দেবে সে ভাই বলরামকে; এবং

“মাঞ নিষধিল পুতা কাহ্নে ল।

মা করিহ গোঠ সয়নে।

সেহো বোল না শুণিল কানে ল।” (বংশী, ২৬)

কাজেই বাপ-মা যখন জানতে পারবে কৃষ্ণ বাঁশী হারিয়েছে তখন গাল দিবে। বাঁশীর শোকে মূহ্যমান কৃষ্ণ তাই শিশুর মতো ক্রন্দন করতে লাগল-

চারিপাশ চাহী বাঁশী না পায়িআঁ

কাঢ়িলান্ত দীর্ঘ রাএ। (বংশী, ২১)

কৃষ্ণের এ মলিন শ্রীহীন রূপ ভগবৎসত্তার বিরোধী। কাজেই কাব্যের মুখবন্ধে কৃষ্ণ জন্মের উদ্দেশ্য হিসেবে কংসনিধনের কথা উল্লেখ করা হলেও কাব্যমধ্যে বীররসের স্থান নেই। মাঝে মাঝে কৃষ্ণ নারীসমাজে যে নিজ বীরত্ব ঘোষণা করেছে তা অনেক সমালোচক প্রেমকাব্যের নায়কের পক্ষে অসমীচীন বলে নির্দেশ করেছেন। কৃষ্ণের এ বীরদম্ভ তার চরিত্রের বালকোচিত ভাবকে প্রকাশ করেছে।

উপরন্তু কৃষ্ণ চরিত্রে দাম্ভিকতা ও প্রতিশোধ স্পৃহা লক্ষ করা যায়। ‘রাধা বিরহ’ খণ্ডে রাধা যখন সমস্ত বিরূপতা ত্যাগ করে কৃষ্ণের কারণ হয়েছে তখন কৃষ্ণ তাকে আগ্রহ আকাঙ্ক্ষা ও সপ্রণয় আবেগের দ্বারা গ্রহণ করেনি। সবসময়ে সে রাধাকে রূঢ় ভর্ৎসনা করে বলেছে যে, একদা যেমন আমার আমন্ত্রণ উপেক্ষা করেছিলে, আমার দূতী বড়ায়িকে অপমান করেছিলে, আমিও সেরূপ উচিত প্রতিশোধ নিব। ‘রাধাবিরহ’ খণ্ডে বিরহ ক্লিষ্টা রাধার প্রতি কৃষ্ণের হৃদয়হীন উক্তি,

‘এবে কেহ্নে গোআলিনী পোড়ে তোর মন।

পোটলী বান্ধিঞাঁ রাখ নহুলী যৌবন।’ (বিরহ, ২৭)

অতঃপর বড়ায়ির অনুরোধে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কৃষ্ণ রাধাকে মিলনানন্দ দান করেছে। ক্লান্ত রাধা যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন কৃষ্ণ তাকে ফেলে রেখে মথুরা চলে গেছে। রাধা জেগে উঠে কৃষ্ণকে না দেখে আকুলা হয়ে পড়ে। পরে দূতী বড়ায়ি মথুরা গিয়ে রাধাকে গ্রহণ করার জন্য কৃষ্ণকে অনুরোধ করে। কিন্তু কৃষ্ণ রাধাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়নি; বরং তাঁর দাম্ভিক রুষ্ট উক্তি,

“শকতী না কর বড়ায়ি বোলোঁ মো তোহ্মারে।

জায়িতে না ফুরে মন নাম শুনি তারে।।

কৃষ্ণ গোপবালক। তার আচরণে গ্রামসুলভ স্বভাব লক্ষ্যগোচর। সে অমার্জিত, অশিক্ষিত এবং একগুঁয়ে গ্রাম্য বালকের প্রতিচ্ছবি। কালিদাস রায়ের ভাষায়,

“শ্রীকৃষ্ণ গোপ পল্লিতে প্রতিপালিত অমার্জিত চরিত্রের • সবলকায় কিশোর।”

তার মধ্যে নাগর বৈদন্ধ্যের অভাব থাকলেও গ্রাম্য প্রাণোচ্ছলতা সে অভাব পূর্ণ করেছে। গ্রামের দুরন্ত দুষ্ট ছেলে সে। রাধার দেহ কামনায় সে মজুর হয়ে ভার বয়েছে, নৌকার মাঝি সেজেছে। বিশেষকরে কালীদহ কালীয় নাগের কবল থেকে মুক্ত করে আপনার জলক্রীড়ার উপযুক্ত করবার জন্য বিপজ্জনক কাজে লিপ্ত হতে সে দ্বিধা করেনি। এসব কর্মে কোথাও দুঃসাহসিকতা কোথাও বা কৌতুক ভঙ্গি তাকে রুগ্‌ন মনোবিকার থেকে সুস্থ সবল গ্রাম্যতায় স্থাপিত করেছে।

কৃষ্ণ গ্রাম্য বালকের মতো। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য সে রাধার বক্ষে নির্মমভাবে পুষ্পবাণ নিক্ষেপ করেছে। অতঃপর রাধা কৃষ্ণের বাঁশী চুরি করলে কৃষ্ণ সাধারণ গ্রাম্য বালকের মতো উত্তেজিত হয়ে ওঠে। রাধার প্রতি তার কটূক্তি গ্রাম্য স্বভাবের পরিচয়বাহী,

‘নাটকী গোআলী ছিনারী পামরী

সত্যে ভাষ নাহি তোরে।’ (বংশী, ২৭)

কৃষ্ণের দেহ কামনাকে প্রেম বলে আখ্যায়িত করতে আমাদের সঙ্কোচ হয় ঠিকই, কিন্তু লঘু কৌতুকের হাস্য এ চরিত্রটিকে আমাদের সহানুভূতি থেকে একেবারে বঞ্চিত করেনি। রাধাকে বশ করার জন্য কৃষ্ণ নানাভাবে বীরত্ব প্রকাশ করেছে। কোনো কোনো স্থলে কৃষ্ণ রাধার প্রতি বাস্তবিক ক্রুদ্ধ হয়েছে কোথাও ‘মারিয়া ফেলিব’ বলে ভয় দেখিয়েছে। বাঁশি ফিরে পাওয়ার আশায় কৃষ্ণ সরোষে রাধাকে ভয় দেখিয়ে বলেছে,

‘যবে বা না দিবি বাঁশি ভান্ডিবি আহ্মারে।

এখণী পরাণ তোর লৈবোঁ অবিচারে।” (বংশী, ২৯)

কখনো ভয় দেখিয়ে বলেছে তার আদেশ অমান্য করলে অবিলম্বনে তার মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। সে যে দেবরাজ বনমালী এবং কংস নিধনের জন্যই তার জন্ম একথা ঘোষণা করতেও ভুলেনি। কিন্তু তার এত কথা কেবল হাসিরই উদ্রেক করেছে। এ হাস্যরস আরো উদ্দাম হয়ে উঠেছে তখন যখন ‘বিরহখণ্ডে’ কৃষ্ণ ভণ্ডযোগীর বেশ পরে গম্ভীর হয়ে অবৈধ প্রেমের বিরুদ্ধে ধর্ম উপদেশ দিয়ে রাধাকে বলেছে,

‘তোরে বেলোঁ চন্দ্রাবলী আহ্মে দেব বনমালী

কেহ্নে বোল হেন পাপবাণী। (বিরহ, ৩৪)

বড়ু চণ্ডীদাসের কৃষ্ণ চরিত্রে অসংগতি অনেক। এ কৃষ্ণ চরিত্র সম্পর্কে ড. অমিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন,

“কৃষ্ণ চরিত্র বিশ্লেষণ করলে তাহার মধ্যে স্থূল দাম্ভিকতা, দেহলোলুপ রিরংসা এবং প্রতিশোধ গ্রহণের কুটিল ইচ্ছা ব্যতীত আর কোনো সদগুণ বা কোনো মানবীয় প্রবৃত্তির সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না।” [শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের চরিত্র চিত্রণ ও কাব্যস্বরূপ]

পরিশেষে বলা যায় যে, কৃষ্ণ চরিত্র অনেকটা অপূর্ণ এবং সঙ্গতিহীনতার দোষে দুষ্ট। কৃষ্ণ চরিত্র অঙ্কনে বড় চণ্ডীদাস তেমন নৈপুণ্য দেখাতে পারেননি। দাম্ভিকতা, স্বীয় ঐশ্বর্য সম্বন্ধে সদর্প ঘোষণা, রাধাকে তীব্র ব্যঙ্গ, ভয় প্রদর্শন, সহানুভূতিহীন নির্মমতা ইত্যাদি কৃষ্ণ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। ফলে এ চরিত্রটির প্রতি পাঠক মাত্রই বিরূপ। রাধা চরিত্রের যে ক্রমবিকাশ তা কৃষ্ণ চরিত্রে নেই। এখানেই কৃষ্ণ চরিত্রের দুর্বলতা।