অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বাঙালির আবহমান কালের শাশ্বত কাহিনি – আলোচনা কর
উত্তর: বৈষ্ণব পদাবলীর মতো শুধু আধ্যাত্মিকতা নয় বরং বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি ধারাবাহিকভাবে পাঠ করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কাব্যে রাধাকৃষ্ণ বাস্তব সমাজ পরিবেশের মধ্যে সংস্থাপিত হয়েছে। বিশেষত সমাজ সংসারের সাধারণ নারী-পুরুষের মতোই তাদের পরকীয়া প্রেম গড়ে উঠেছে। চোদ্দো শতকে রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, কাব্যে পুরাণের কিছু কিছু কাহিনি থাকলেও সেকালের লোক প্রচলিত কাহিনি এমনকি কল্পিত কাহিনিও এখানে স্থান পেয়েছে। এই কাহিনির মধ্যে সমকালীন সমাজের পরিচয় উপস্থাপিত হয়েছে। এই সমাজ ধর্মনির্ভর গ্রামীণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের। কাব্যের বিভিন্ন অংশে এই সমাজের নানান দিক যেমন- কুসংস্কার, জীবনবোধ, ধর্মবিশ্বাস, আচার-আচরণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ, পেশা ও জীবিকা বিবিধ বিষয় এতে স্থান পেয়েছে। বড়ু চণ্ডীদাস উচ্চাঙ্গের কবি প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। ফলে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে সমাজ জীবনের লৌকিক স্তরে রাধাকৃষ্ণের মানবিক প্রেমলীলারস তুলে ধরেছেন। রাধা ও কৃষ্ণ এখানে লৌকিক, মানবিক এবং আমাদের পরিচিত জগতের রক্ত-মাংসের সাধারণ মানব-মানবী হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। রাধা-কৃষ্ণের হৃদয়ানুভূতি আবেগ ও লৌকিক মানসিকতার সুষম মিথষ্ক্রিয়ার আশ্চর্য শিল্পিত প্রকাশ ঘটেছে এই পৌরাণিক প্রেমগাঁথার মধ্যে। সঙ্গত কারণেই বলা হয়ে থাকে বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে আধ্যাত্মিকতা তুচ্ছ এতে প্রাধান্য বিস্তার করেছে লৌকিকজীবন ও লোকরুচি তথা মানব-মানবীর চিরন্তন প্রণয়গাঁথা। কবির মূল উদ্দেশ্য আধ্যাত্মিকতার উচ্চাঙ্গের প্রকাশ থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত মাটির পৃথিবীর মানবীয় প্রেমকাহিনিমূলক উপাখ্যানে রূপান্তরিত হয়েছে।
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বস্তু জাগতিক তথা পার্থিব জীবনভিত্তিক রচনা। এ কাব্যে ধর্মীয় ভাবের পরিবর্তে রয়েছে জনজীবনের প্রতিচ্ছবি। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এর রাধাকৃষ্ণ বাস্তব সমাজ পরিবেশে লালিত সাধারণ নরনারী সমাজ সীমার মধ্যে সাধারণ মানব ও মানবীর মতোই তাদের প্রেম ও প্রেমবিহ্বল চিত্তের প্রকাশ ঘটেছে। ফলে এ কাব্যে কবি বড়ু চণ্ডীদাস দেহ বা শরীরকে অস্বীকার করেননি। আত্মা এখানে দেহকে আশ্রয় করে আবর্তিত ও বিবর্তিত ও বিকশিত হয়েছে, লেখক জ্ঞাতসারে কখনোই দেহকে অস্বীকার করতে চাননি। ‘বৈষ্ণব পদাবলী’তেও দেহ আছে তা সম্ভোগের বিস্তারিত বর্ণনাও আছে। কিন্তু এখানে দেহ যেন মানুষের শ্রদ্ধার বাহ্যরূপ মাত্রা। এর মধ্যে প্রাণোত্তাপ সজীবতা কিংবা প্রকৃত ব্যবহারিক মানবহৃদয়ের প্রকাশ অনুপস্থিত। বড়ু চণ্ডীদাসের রাধাকৃষ্ণের প্রেমগাঁথা পুরাণের প্রচলিত কাহিনি থেকে অনেকাংশে পৃথক ও স্বতন্ত্র। এ কাব্যে লৌকিকজীবন, লৌকিকরুচির প্রকাশ মুখ্য ও স্বতঃস্ফূর্ত। প্রেমগাঁথার সাথে যুক্ত হয়েছে সমাজ সংসারের বাস্তবচিত্র। মর্ত্য পৃথিবীর রাধাকৃষ্ণের প্রেম এ কাব্যে কামনার রঙে আলোড়িত-আন্দোলিত। এ প্রণয়গাথার প্রকাশ সংকোচহীন:
“কুচযুগ দেখি তার অতি মনোহরে।
অভিমান পাআঁ পাকা দাড়িম বিদরে ॥
মাঝাখিনী গুরুতর বিপুল নিতম্বে।
মত্ত রাজহংস-জিনী চলএ বিলম্বে ॥
দিনে দিনে বাড়ে তার নহুলী যৌবন।”
এ কাব্যের নায়ক কৃষ্ণের মধ্যে যে অশ্লীলতা ও রুচিহীনতার পরিচয় পাওয়া যায় তা সে যুগের এবং সেকালের সমাজজীবনের আলেখ্য। অবশ্য প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে আদিরসাত্মক প্রসঙ্গ নতুন কিছু নয়, বরং ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের শৃঙ্গাররস শেষ পর্যন্ত মানবীয় বাস্তবতায় রূপান্তরিত হয়েছে। এখানেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের সার্থকতা এবং কবির শৈল্পিক নৈপুণ্য। কবির কবিপ্রতিভা ও জীবনাভিজ্ঞতার স্পর্শে এ কাব্যের কাহিনি জন্মখণ্ডের পর থেকেই ক্রমশ জনজীবনের তথা লোকজ প্রেমকাহিনির দিকে মোড় নিয়েছে। বংশী ও বিরহখণ্ডে দেব-দেবীর প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। রাধাকৃষ্ণ এখানে বাস্তব সমাজ পরিবেশে স্থাপিত হাসছে। রাধার রূপ যৌবনের অনুপুঙ্খ বর্ণনা ও যৌবন সৌন্দর্য রসে আসক্ত কৃষ্ণ ভ্রমর হিসেবেই অঙ্কিত হয়েছে। এই অঙ্কনে কবি শ্লীলতা-অশ্লীলতার প্রশ্নে আবদ্ধ নন বরং পার্থিব জীবন স্পর্শে উজ্জীবিত। কবি সমকালীন লোকরুচি, স্থুল দেহসম্ভোগ অনুভূতিতে মানবীয় প্রেমের অনিবার্য আকর্ষণকে চিত্রিত করেছেন। যথা:
“চউঠ পহরে কাহ্ন করিল আধর পান
মোর ভৈল রতিরস আশে।
দারুণ কোকিল নাদে ভাঁগিল আহ্মার নিন্দে
গাইল বড়চণ্ডীদাসে ॥”
ঋতুর আগমনে বাস্তব রূপ লাবণ্যে মানুষের রতিসচেতন মন ও দেহের ক্রিয়া বৈশিষ্ট্য চিত্রিত হয়েছে। শুধু রাধার চিত্রণ কিংবা রাধা-সম্ভোগ চিত্রই নয়, সেই সাথে কৃষ্ণের অথবা রাধার কামনা বাসনার ক্ষেত্রেও কবি কোনোরূপ অলৌকিক, পরমার্থিক সুখানুভূতির অথবা কোনো অতীন্দ্রিয় আনন্দের ছবি আঁকেননি। যতটুকু এঁকেছেন তা বাস্তব, লৌকিক এবং রক্ত মাংসের রাধা- কৃষ্ণের দেহকে কেন্দ্র করে। পরিচিত সমাজ-সংসার জীবনের মানব-মানবীর হৃদয়ের বাস্তবতা অঙ্কনে কবি বড়ু চণ্ডীদাস সচেতন ছিলেন। কবি বিশেষভাবে সচেতন ছিলেন প্রেমের অনিবার্য জৈবিক চাহিদা সম্পর্কে যা আলঙ্কারিক বিচারে আদিরসাত্মাক হিসেবে আখ্যায়িত। তাছাড়া কবি বড়ু চণ্ডীদাস বাস্তব সমাজজীবনের চরিত্রগুলোর সত্যাসত্য অবস্থান সম্পর্কেও যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। কাব্যে উপস্থাপিত চরিত্রগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের স্ববিরোধিতা পাওয়া যায় না বরং চরিত্রগুলো সম্পর্কে পাঠকের ধারণা জন্যে যে, তারা বাস্তব সমাজজীবনেরই প্রতিচ্ছবি। অর্থাৎ প্রতিটি চরিত্র সামাজিক বাস্তবতায় গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে:
তোমার যৌবন রাখা কৃপণের ধন।
পোটলি বান্ধিআঁ রাখ নহুলী যৌবন৷৷
রাধার রূপজ মোহে কৃষ্ণ অন্ধ হয়েছে, তার কাছে সামাজিক রীতিনীতির মূল্য নেই। এমনকি ভগবান হিসেবেও তার মধ্যে কোনো ধরনের সংযম দেখতে পাওয়া যায় না। কৃষ্ণের এই আচরণ দৃষ্টে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কৃষ্ণ স্বর্গের দেবতা হলেও কবি বড়ু চণ্ডীদাসের হাতে যে কৃষ্ণ নির্মিত হয়েছে, সে নিতান্তই রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। অন্যদিকে রাধা চরিত্রকে কবি উপস্থাপন করেছেন অশিক্ষিতা এক গ্রাম্যবধূ রূপে। যে রাধা প্রথমে কৃষ্ণের প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছে সেই রাধাই শেষে এসে কৃষ্ণের নিকট নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। অথচ কৃষ্ণকামিনী রাধার মন থেকে দুরভিসন্ধি যায়নি। বরং কৃষ্ণের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে রাধা সুযোগ খুঁজেছে তাকে অপমান করার। আবার চপলা চঞ্চলা এক গ্রাম্য কিশোরীর মতোই শ্রীমতী রাধা কৃষ্ণের বাঁশী চুরি করেছে। আর কৃষ্ণও গ্রাম্য রাখালের মতোই উত্তেজিত হয়েছে। উত্তেজিত কৃষ্ণের উচ্চারণ: ‘সব আভরণ তোর কাড়িয়া লইবো’ বলে রাধাকে হুমকি দিয়েছে। অবশেষে বাঁশির জন্য রাধার নির্দেশে ষোলো’শ গোপিনীর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতেও দ্বিধা করেনি কৃষ্ণ। কৃষ্ণকে দেবতা হিসেবে অঙ্কন করলে এভাবে তাকে অপমান করতে পারতেন না। অন্যদিকে রাধা প্রথম পর্যায়ে কলহ- পরায়ণা একগুঁয়ে স্বভাবের গ্রাম্যবধূ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যে। কিন্তু পরিশেষে সেই রাধাই লৌকিকপ্রেমে ও বিরহে মানবীয় যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়েছে। তার অন্ত দহন কিংবা বাঁশির ধ্বনি শুনে মানবী প্রিয়া রাধার ব্যাকুলচিত্তের খবর কবি উপস্থাপন করেন এভাবে:
“কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।
কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকূলে।
আকুল শরীর মোর বে আকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মোর আওলাইলো রান্ধন ॥” (বংশী খণ্ড)
বস্তুত জৈবিক আকুলতা ও হৃদয়ার্তি দিয়ে কবি রাধার মধ্যে একজন সম্পূর্ণ বাঙালি লোক-মানবীকেই সৃষ্টি করেছেন। ‘নৌকাখণ্ড’ ও ‘দানখণ্ডে’ এই অবস্থা ক্রমশ পরিণতি লাভ করেছে। ‘বংশী’ ও ‘বিরহখণ্ডে’ এসে কাব্যের মানবীয় প্রেমচেতনা এক অনন্ত অভিসারের পথে ধাবিত হয়েছে। কিন্তু এই অভিসার ইন্দ্রিয়াতীত নয়, নয় অলৌকিক কিংবা দেব-দেবীর স্বর্গের লীলাকীর্তন। বরং এই রাধাকৃষ্ণের প্রেম লীলাকীর্তন কবির একান্ত লোকজীবন ঘনিষ্ঠতার ফলাফল। ড. আহমদ শরীফের মতে:
‘এ কাব্যে কবির কোনো বিশেষ প্রতিপাদ্য নৈতিক তত্ত্ব ছিল না বটে, কিন্তু আজকের সমাজ সচেতন পাঠক এর মধ্যে একটা ফলিতার্থ পেতে পারে।’
তা হচ্ছে এই কাব্যে প্রতিফলিত সমাজ সম্পৃক্ত মানবিক আবেদন। এই কাব্যের একদিকে ভোগলিঙ্গু কৃষ্ণ, অন্যদিকে বিরহ ও কামতপ্ত রাধিকার পরিচয় ফুটে উঠেছে:
“চুম্বিল কপোল গল আধর নয়নে।
বদনে বদনে জুড়ি কৈল মধুপানে ॥
মনতোষ ভৈল কাহ্নাঞি ছাড়ে ঘন শাসে।
কাঢ়ী লইল আভরণ পুন রতী আশে॥”
এই প্রণয়, এই সম্ভোগ অলৌকিক অথবা অতিপ্রাকৃতের স্পর্শ ও তত্ত্ববিমুখ। কাব্যে কখনো কখনো কৃষ্ণের উক্তিতে তার অলৌকিক ক্ষমতা কিংবা পৃথিবীতে অবতার হিসেবে প্রেরিত হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ পেলেও তা শুধু কথাসর্বস্ব, ঘটনাপ্রবাহে তার প্রকাশ নেই।
আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্যে লালিত পৌরাণিক প্রেমগাঁথার আবহে আজও মর্ত্য লোকবাসী রাধাকৃষ্ণের প্রেমগীতির মধ্য দিয়ে বিবর্তনে বিবর্তনে নিজেকে, নিজের দেহকে, নিজের মন ও পার্থিব লীলারসকে আবিষ্কার করেন। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য পাঠ করলে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলো এর রাধা এবং কৃষ্ণ বাস্তব সমাজ পরিবেশের মধ্যে সংস্থাপিত হয়েছে। তাই রাধাকৃষ্ণের কাহিনি লৌকিক মানবপ্রেমের কাহিনি। বাঙালির শাশ্বত লৌকিক জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলার মাধ্যমে। তাই বলা যেতে পারে যে, বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি বাঙালির লৌকিকজীবনের উজ্জ্বল দলিল।
Leave a comment