অথবা, রাধাকৃষ্ণ প্রেম যতটা শরীরধর্মী ও বাস্তব, ততটা হৃদয়ধর্মী ও আদর্শায়িত নয় – শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য অবলম্বনে উক্তিটির ব্যাখ্যা কর
অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের বংশী ও বিরহ খণ্ড অবলম্বনে বড়ু চন্ডীদাসের প্রেম ভাবনার পরিচয় দাও
উত্তর : আদিমধ্যযুগের কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস একজন অসাধারণ প্রতিভাবান কবি। পুরাণ আশ্রিত রাধাকৃষ্ণ চরিত্র, প্রচলিত কথকতা, স্বকীয় কল্পনা, আর যুগপৎ ভাবধারাকে আশ্রয় করে বড়ু চণ্ডীদাস আখ্যানধর্মী প্রেমের কাব্য রচনা করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মানুষরূপী গো পালক ও তার প্রেয়সী রাধাকে অবলম্বন করে তেরটি খণ্ডে গড়ে তুলেছেন একমুখী এ প্রেমের কাব্যখানি। কবির অভিপ্রায় ছিল প্রেমরসে সিক্ত করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্য রচনা করা। কিন্তু কবির সে অভিপ্রায় শেষ পর্যন্ত পরিণতি লাভ করেনি। আসলে রাধাকৃষ্ণের প্রেম যতটা শরীরধর্মী ও বাস্তব- ততটা হৃদয়ধর্মী ও আদর্শায়ত নয়। কবি বাস্তব মানব-মানবীয় প্রেমরসের কাব্য রচনা করেছেন।
বড়ু চণ্ডীদাস রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে মানবিক বা নাটকীয় পরিচর্যার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। কাব্যের কুটনি চরিত্র বড়াইয়ের মুখে রাধিকার রূপের বর্ণনা শুনে কৃষ্ণ তার প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে প্রেম প্রস্তাব হিসেবে ফুল, মালা, কর্পর মিশ্রিত তাম্বুল পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু আইহনের স্ত্রী, আত্মগরবিনী রাধা পদদলিত করে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ফলে একদিকে বড়াই অপমানিত বোধ করে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। অন্যদিকে, ধীরে ধীরে রাধাকে পাওয়ার জন্য কৃষ্ণ ব্যাকুল হয়ে ওঠে। দান খণ্ডে রাধার কাছে দেহ প্রার্থনা করে ব্যর্থ হলে জোরপূর্বক মিলিত হয় তাতেও রাধার মনের পরিবর্তন হয়নি। ফলে নৌকাখণ্ডে কৃষ্ণ কৌশলে যমুনার বক্ষে মিলিত হয় দ্বিতীয়বার। এ পর্যায়ে রাধার খানিকটা মানসিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ভাব ও ছত্রখণ্ডে প্রেমের ব্যাপারে রাধার মানসিকতা আরো খানিকটা উন্নতি লাভ করতে দেখা যায়। বৃন্দাবন খণ্ডে কৃষ্ণের প্রতি রাধার প্রেম গভীরতায় এসে পৌঁছে। এ পর্যায়ে আমরা রাধার মাঝে প্রেমিকাসুলভ ঈর্ষা বা অভিমানের সাক্ষাৎ পাই। বস্ত্র হরণ খণ্ডে ও হার খণ্ডে রাধার মনোভাব আপাতদৃষ্টিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ বিপরীতমুখী বলে বোধ হলেও তা আসলে নারী সুলভ প্রকৃতির প্রকাশ। অন্যকথায়, তা মনের অন্য একটি পর্যায়। বাণ খণ্ডে কামলোভী কৃষ্ণ রাধার বক্ষে অকারণ নিষ্ঠুর পুষ্পবাণ নিক্ষেপ করেছে। কিন্তু এরই মধ্য দিয়ে নতুন করে মিলনের মধ্য দিয়ে পুরাতন প্রেম নবীন হয়ে উঠেছে।
বংশীখণ্ডে কবি রাধাকৃষ্ণের প্রেমের পরিণতি লাভ করেছেন। আমাদের পাঠ্য এ খণ্ডে দেখা যায় দীর্ঘ বিরহজনিত ব্যাকুলতা দেখা দিয়ে রাধার মাঝে এবং সেই সাথে যোগ হয়েছে কৃষ্ণের জন্য চোখের জল। গোপাল যমুনা নদীর তীরে বাঁশি বাজায়, সে বাঁশির সুর রাধার মনের ব্যারলতার ঝাড় তোলে। এতদিন সে কৃষ্ণের রূপ জানত, এবার দূর হতে স্বরূপ উপলব্ধি করে। বংশী ধ্বনি শ্রবণে রাধা ব্যাকুল হয়ে বলে-
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।।
আকুল শরীর মোর বেআকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মো আঊলাইলোঁ রান্ধন।।
রাধাকৃষ্ণের এ বাঁশির সুর সহ্য করতে পারে না। কৃষ্ণকে কাছে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল রাধা বড়ায়ের পরামর্শে বাঁশি চুরি করেছে। “না লঙ্ঘি বচন রাধা” প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে কৃষ্ণ তার বাঁশি ফেরত নিয়েছে রাধার কাছ থেকে। কিন্তু কামোক্ত কৃষ্ণ রাধার বচন রাখেনি, তার মন বুদ্ধির এ চিত্র দেখা যায় রাধার বিরহখণ্ডে। এ পর্যায়ে রাধা সম্পূর্ণ কৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং রাধা সম্পূর্ণ কৃষ্ণের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। অথচ কৃষ্ণ রাধা প্রেম পদদলিত করে মথুরায় চলে গেছে এবং রাধাকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করার সংকল্প করেছে।
রাধা চরিত্রের মধ্য দিয়ে চণ্ডীদাসের প্রেম সম্পর্কে উচ্চমার্গীয় ধারণা পাওয়া যায়। রাধা চরিত্রকে বিকাশধর্মী মানবিক চরিত্র রূপে পাওয়া যায়। একটি পূর্ণাঙ্গ নারী চরিত্র অঙ্কনেও তার চেতনার পরিণতির প্রত্যেকটি স্তরে নিপুণ দক্ষতার কবি যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা বিস্ময়কর। নামশ্রবণ বা রূপদর্শনজনিত প্রথাসিদ্ধ পূর্বরাগ ছাড়া নিতান্ত দেহমিলনের দ্বারা পুরুষের প্রতি নারীর প্রেম কিভাবে অঙ্কুরিত, পল্লবিত ও বিকশিত হয়ে উঠতে পারে তারই পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র অঙ্কন করেছেন বড়ু চণ্ডীদাস।
গতানুগতিক প্রেমের চিত্র চিত্রণে সখীর মুখে কৃষ্ণের কথা শুনে রাধা সেখানে অভিসারিকা হয়েছে, সেখানে বড়ু চণ্ডীদাস স্ত রবিন্যাসের মধ্য দিয়ে রাধাকে অভিসারে চালিত করেছেন। কবির সৃষ্ট রাধা নিতান্তই একজন বাঙালি কুললক্ষ্মী নারী। সে কারণে ভোগের মাধ্যমে কৃষ্ণের সাথে পরকিয়া প্রেম প্রস্তাব পেয়ে জ্বলে উঠেছে এবং ঘৃণা ভরে সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে। স্বামী এবং সংসারকে সে বড়ো করে দেখেছে যা নিতান্তই স্বাভাবিক। সামাজিক অনুশাসনের কারণে রাধা বার বার কৃষ্ণের অস্বাভাবিক দেহকামনা এবং যৌন বাসনা প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও একান্ত অনিচ্ছায় কৃষ্ণ জোরপূর্বক তার সাথে মিলিত হয়েছে। সে কারণে তার মাঝে নারীসুলভ ঘৃণা, চপলতা, চঞ্চলতা প্রকাশ পেয়েছে।
‘বংশীখণ্ডে’ প্রেমাকুল রাধা আত্মহারা, আত্মসম্মান ভুলে গেছে। কৃষ্ণের বাঁশির সুর শুনে। তাই সে কৃষ্ণকে এনে দেওয়ার জন্য বড়ায়িকে অনুরোধ করেছে। বড়ায়ের চলার অক্ষমতা সে মানতে নারাজ। তাই শেষ পর্যন্ত রাধার অনুরোধে বড়াই অক্ষম দেহ নিয়ে কৃষ্ণকে খুঁজতে বেরিয়েছে, কিন্তু পাষাণ বলে তার মন বাধ মানেনি। সেজন্য ঘুমন্ত স্বামীকে বিছানায় রেখে কৃষ্ণ অভিসারে সে বেরিয়েছে। না পেয়ে সে মূর্ছা গেছে। এ পর্যায়ে রাধার কৃষ্ণদর্শনের কামনার পাশাপাশি তীব্র দেহ কামনা সৃষ্টি হয়েছে। কৃষ্ণের মোহন বাঁশির সুরে দেহের মধ্যে যে আগুন জ্বলতে শুরু করেছে তাতে সে বলেছে- “কাহ্ন আলিঙ্গিআ সকল দেহ জুড়ায়িবো”। এ খণ্ডে আমরা আরো দেখতে পাই বড়ায়ির সাহায্যে রাধা কৃষ্ণের সাক্ষাৎ পেয়েছে এবং সুযোগমতো তার বাঁশি চুরি করেছে। অনেক পীড়াপীড়ির পর কৃষ্ণকে তার বাঁশি ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করেছে এই বলে-
হের ভাল মতোঁ চাহি নেহ কাহ্নাঞি বাশি।
আজ হতে চন্দ্রাবলী হৈল তোর দাসী।
এরপর আমরা বিরহখণ্ডে দেখি কৃষ্ণপ্রাণা রাধা দীর্ঘ কৃষ্ণ অনুপস্থিতিতে বিরহ ব্যাকুল। রাধাকৃষ্ণের আশা মোহিনী বেশ ধারণপূর্বক কিশলয় শয্যা রচনা করে, কিন্তু কৃষ্ণের দেখা মেলে না। সেজন্য রাধা বড়াইকে শত অনুরোধ করেছে কৃষ্ণকে তার কাছে এনে দেওয়ার জন্য। বার বার মনে হয়েছে-
ফুটিল কদমফুল ভরে নোঁআইল ডাল।
এভোঁ গোকুলক নাইল বাল গোপাল৷
অনেক খোঁজাখুঁজির পর যখন কৃষ্ণের সাক্ষাৎ মিলিত তখন শ্রীকৃষ্ণ কংস বধ করতে মথুরা এসেছে। সে আর রাধার কাছে ফিরে যাবে না বলে স্থির করে। অনেক দুঃখ, তাপ অবহেলা সহে কৃষ্ণ রাধাকে ভুলতে চেষ্টা করেছে তার সাথে আর কোনো সম্পর্ক না রেখে এ পর্যায়ে কাব্যের পরিসমাপ্তি হয়েছে। বাকি অংশ না পাওয়ায় এ প্রেমের শেষ পরিণতি জানা যায় নি।
উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, রাধা চরিত্রের মাঝে কবি যথার্থ প্রেমবোধ প্রকাশ করেছেন। মানবিক প্রেমের আনুপাতিক পর্যায়কে মেনে কবি রাধা চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রেমের স্রোতে ধাবিত হয়েছেন। রাধা চরিত্রের ক্রমবিকাশ, প্রেমসৌন্দর্য একান্ত বাঙালি নারীসুলভ। কাম নয় মনের আকাঙ্ক্ষা বা প্রেম অনুভূতি তাকে চালিত করেছে। এখানেই বড়ু চণ্ডীদাসের প্রেমভাবনার সার্থকতা।
Leave a comment