অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মানবিক আবেদন তুলে ধর

অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মূল আকর্ষণ মানবিকতা – তোমার পঠিত অংশ অবলম্বনে এই উক্তির তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর

উত্তর: মধ্য ও প্রাচীন যুগের অন্যান্য কাব্যের মতো আলোচ্য ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটিও দেবতার মাহাত্ম্য কীর্তনের জন্য রচিত। এতে কৃষ্ণলীলা মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। রাধিকা ও শ্রীকৃষ্ণ লক্ষ্মী ও নারায়ণ। কংসবধের জন্য দেবতাদের প্রার্থনায় তাঁরা পরজন্ম লাভ করেন। কিন্তু ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে ‘জন্মখণ্ডে’র পর আর দেবদেবীর কথা নেই, আঁছে মানব জীবনের কাহিনি। কবি বড়ু চণ্ডীদাস পুরাণের পটভূমিকায় কাব্যের কাহিনি শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত পুরাণকে অনুসরণ করেননি, একান্তই লৌকিক রাধা-কৃষ্ণ প্রেম বিষয়ক ভাবনা অবলম্বনেই কাব্যের কাহিনি এবং চরিত্রকে রূপদান করেছেন। ফলে এ কাব্যে রাধা এবং কৃষ্ণ চরিত্রে কোন স্বর্গীয় মহিমা দেখা যায় না। আমাদের সমাজের যুবক যুবতীর মতোই তাদের মধ্যে প্রেম ভালোবাসা গড়ে উঠেছে।

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের রাধা এবং কৃষ্ণ সমাজ সংসারের বাস্তব পরিবেশে সংস্থাপিত দুটি নরনারী। কবি তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষাপটে এবং লোক কাহিনির প্রভাবে এ চরিত্র দুটি সৃষ্টি করেছেন বলে মনে হয়। কৃষ্ণ, রাধা ও বড়ায়ি চরিত্র বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় যে, তারা একান্তই এ পৃথিবীর গ্রামীণ নরনারী। তাদের চরিত্রে দেবত্বের মহিমা নেই। সংস্কৃতকালীন জীবনভাবনাও সেখানে অনুপস্থিত।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা সাধারণ গোপবালা। তার বয়স এগারো বছর। গোপপল্লির রীতি অনুযায়ী সখীদের সাথে সে হাটে বাটে দুধ দধি বিক্রয় করতে যায়। সে বধূ বলেই বৃদ্ধা বড়ায়ি তার সাথী হয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে অঙ্কিত রাধা বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী নয়। একান্তই মানবীয় গুণে গুণান্বিত সাধারণ গ্রাম্য বালিকা। তার আবাল্য সংস্কার সতীধর্ম; সে জানে সাধ্বী নারীর পতি ভিন্ন গতি নেই। তাই স্বামী আইহন তাঁর কাছে বীর, সুপুরুষ ‘সর্বাঙ্গ সুন্দর দেহা’। স্বামী গর্বে গর্বিতা রাধা তাই কৃষ্ণের প্রেমের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। কৃষ্ণ সম্পর্কে তার ভাগিনা। তাই বার বার আত্মরক্ষার জন্য চেষ্টা করেছে রাধা। কৃষ্ণকে দেহ দানের কথা চিন্তা করাও তার পক্ষে মহাপাপ। কেননা পতি থাকতে যে অন্য পুরুষের ভজনা করে সে নারীর জীবনে ধিক। তাই রাধা কৃষ্ণ প্রেরিত তাম্বুলাদি পায়ে দলিত করেছে এবং দূতী বড়ায়িকে অপমান করেছে। স্বামীর প্রতি অবিচলিত শ্রদ্ধায় বলেছে,

‘ঘরের স্বামী মোর সর্ব্বাঙ্গ সুন্দর

আছে সুলক্ষণ দেহা।

নান্দের ঘরের গরু রাখোআল

তা সখে কি মোর নেহা।’

এখানে রাধা সাধারণ মানবী। সে বিস্মৃত হয়েছে তাঁর সর্বমাহাত্ম্য ও ঐশ্বর্যে। রাধার এই বিস্মৃতিই ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যকে এক অপরূপ মানবিক রসে সঞ্চিত করেছে। সমালোচক ড. নীলিমা ইব্রাহিমের ভাষায়,

রাধিকার মানবিক অনুভূতি, তাঁর কুল চেতনা, সতীত্বের সংস্কার, বাস্তব সংস্কার জ্ঞান- এ কাব্যকে মানবিকরূপে সিঞ্চিত করে ‘সহৃদয় হৃদয়সংবাদী’ করে তুলেছে। তাই পদাবলীর রাধাকে দূর থেকে শ্রদ্ধা জানাই কিন্তু হাত দিয়ে স্পর্শ করতে সাহস হয় না, ভরসা পাই না, মনে হয় এ রাধিকা স্বর্গ বৃন্দাবনের অধিবাসী, ইনি আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা চন্দ্রাবলী আমাদেরই একজন।

“আমাদের মতো সমাজ সংসারে প্রতিষ্ঠাতা,

আমাদের মতো কামনা বাসনা তাঁর আছে

কিন্তু কুল হারাবার ভয়ও কম নেই। তাঁর

ভয়, লজ্জা, ক্ষোভ, অসহায় অবস্থা তাঁকে

অধিকতর মানবিক গুণে ভূষিত করেছে।” (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য পাঠের ভূমিকা)

বড়ু চণ্ডীদাসের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব রাধা চরিত্রে ক্রমবিকাশ ঘটিয়ে তাকে শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণ অনুরাগী করে তুলেছেন। যে কৃষ্ণ তাঁর কাছে এক দুর্বৃত্ত গ্রাম্য যুবক ছাড়া আর কিছু ছিল না; বংশী ও বিরহখণ্ডে এসে সেই কৃষ্ণই তাকে আকুল করেছে এবং তখন সে কৃষ্ণ পায়ে দাসী হয়ে নিজেকে সমর্পণ করতে চেয়েছে। কারণ তখন রাধা আর একান্ত বালিকা নয়, তার যৌবন উন্মেষ হয়েছে। দেহভোগের আকর্ষণ এবং মাধুর্য দুই-ই তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। কবি অত্যন্ত সূক্ষ্ম লিপি কুশলতায় তা পরিস্ফুট করেছেন।

আবার রাধা চরিত্রের এ অনৈসর্গিক প্রায় বেদনার সবটুকুই যেন একান্ত ব্যক্তিগত নয়। মনে হয়, বাংলার ভাগীরথী তীরের অশিক্ষিত গোপপল্লির সামাজিক দুর্নীতি পীড়িত ট্র্যাজেডির এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি। সুপ্রাচীন লোক-সমাজ চিত্রের কিছু কিছু অংশ অপরিচ্ছন্ন মনে হলেও সেই অকিঞ্চিতকর জীবন উপাদানকে আশ্রয় করে বড়ু চণ্ডীদাস একটি গ্রামীণ নারীর জীবনার্তি অঙ্কন করেছেন। এ প্রসঙ্গে ভূদেব চৌধুরী বলেছেন,

“রাধা চরিত্র সেই জীবন ব্যবস্থা প্রভাবিত অপরিহার্য ট্র্যাজেডির বাস্তব আলেখ্য যে যুগে যে সমাজে পরিণত যৌবন পুরুষের সাথে অপ্রাপ্ত বয়স্কা বালিকার বিবাহ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল- অন্য কারণ ব্যতিরেকেও সেই সমাজের পক্ষে আলোচ্য দুর্নৈতিক পরিণাম অপরিহার্য না হলেও নিতান্তই স্বাভাবিক। সদ্য জাগ্রত যৌবন পুরুষের লালসা অপ্রাপ্ত চেতনা, অজ্ঞাত যৌবনা বালিকা হৃদয়ে আঘাত করে অকালে বোধন প্রচেষ্টাজনিত যে বিভীষিকাময় পরিণতির সৃষ্টি করতো অধুনাতন কালের সুধীজনের নিকটেও তার পরিচয় একেবারে অস্পষ্ট নয়। কিন্তু অনৈসর্গিক উপায়ে নির্বোধ বালিকার নারীত্বকে অকালে জাগ্রত করার পর তার মধ্যকার সদ্য জাগ্রত কুম্ভ কর্ণের বুভুক্ষাকে অপরিতৃপ্ত রেখেই পুরুষের পৌরুষ অপচয়ের মধ্যে স্তিমিত হয়ে পড়তে হতো প্রায়ই- জীবনের সেই বিভীষণ মুহূর্তে কিংকর্তব্যবিমূর নিরূপায় নারীত্বের অনিবার্য আর্তনাদ-ধ্বনি ঝংকৃত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে।”

রাধা চরিত্রের মতো কৃষ্ণ চরিত্রকেও মানবিকরূপে অঙ্কিত • করেছেন কবি বড়ু চণ্ডীদাস। এ কাব্যে আমরা কৃষ্ণের স্বর্গীয় ক্ষমতার অলৌকিক ব্যবহার দেখতে পাই না। এখানে কৃষ্ণ একান্ত গোপপল্লির যুবক। তার চরিত্রে অসংযত মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে। বড়ায়ির মুখে রাধার রূপের বর্ণনা শুনেই সে রাধার দেহ ভোগের জন্য উন্মুখ হয়েছে। এক্ষেত্রে সে নীতি ও সংযম শাসনের অধীন নয়। রাধার দেহ ভোগের জন্য কৃষ্ণ বল প্রয়োগেও দ্বিধা করেনি। কবি কালিদাস রায়ের ভাষায়,

“শ্রীকৃষ্ণ গোপপল্লিতে প্রতিপালিত অমার্জিত চরিত্রের সবলকায় কিশোর। এই গোপপল্লি সেই মথুরা তীরের বিদগ্ধ ভাবাপন্ন আর্তির পল্লি নয়, এ যেন বাংলার ভাগীরথী তীরের অশিক্ষিত গোপপল্লি।”

কৃষ্ণ চরিত্র যেন বাস্তব জীবনেরই আলেখ্য। রাধাকে লাভ করতে প্রেমার্থী কৃষ্ণ রাধার ভার বয়েছে, মাথায় ছাতি ধরেছে, নৌকায় তাঁকে পার করিয়েছে, তার জন্য কালীদহ কালীয়নাগকে প্রাণ তুচ্ছ করে দমন করেছে। এমনকি রাধার মন লাভে সব রকমে ব্যর্থ হয়ে মূর্খ গ্রাম্য যুবকের মতো রাধাকে বশ করবার জন্য তাকে বাণ মেরেছে। অতঃপর রাধা কৃষ্ণের বাঁশী লুকিয়ে রাখলে তাঁর প্রতি কৃষ্ণের যে কটূক্তি তাও নীচুস্তরের গ্রাম্য ভাব ও স্থূলতাকে প্রকাশ করেছে-

নাটকী গোআলী ছিনারী পামরী,

সত্যে ভাষ নাহি তোরে।

কৃষ্ণ চরিত্রের এ অক্ষমতা, দুর্বলতা তাকে দেব মাহাত্ম্য থেকে বঞ্চিত করেছে সত্য, কিন্তু সাহিত্যে তাঁকে মানবিক অনুভূতিতে চিরভাস্বর করে রেখেছে। তাই ড. নীলিমা ইব্রাহিম বলেছেন,

“সুদক্ষ রূপকার বড়ু চণ্ডীদাস এখানে মানব হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি দিয়ে কৃষ্ণ চরিত্রকে অঙ্কিত করেছেন। প্রেমের জন্য কৃষ্ণ সব ত্যাগ, সব দুঃখ স্বীকার করতে প্রস্তুত। দুঃখ ও ক্লেশের ভিতর দিয়ে তাঁর প্রেমের সাধনায় তিনি সিদ্ধিলাভ করেছেন। ……………………ব্যর্থ হয় নি মানব রস আস্বাদনের আকাঙ্ক্ষায় সৃষ্ট সাহিত্যকর্ম।” [শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য পাঠের ভূমিকা]

এ কাব্যে কৃষ্ণ চরিত্রের মধ্য দিয়ে কবি যেন নারী প্রেম লোভী সাধারণ মানবকেই অঙ্কন করেছেন।

বড়ায়ি চরিত্রটিও মানবিক ও বাস্তবতা মণ্ডিত। এ যেন আমাদের সমাজে ঠাকুমা, দিদিমা বা দাদি, নানি শ্রেণির একটি চরিত্র। বৃদ্ধা বড়ায়ি প্রেম সম্পর্কে দক্ষ এবং রাধা ও কৃষ্ণ প্রেমের মধ্যস্থতাকারিণী। মানবদরদী কবি তাকে মানবিক রূপদান করেছেন। যদিও সে কৃষ্ণের মাহাত্ম্য সম্পর্কে আস্থাবান এবং রাধাকে বার বার কৃষ্ণের প্রতি আকর্ষিত করেছে, তবু মানবিক রূপ তাকে বিশিষ্ট করেছে। বড়ায়ির সংসার বুদ্ধি তাকে পাঠকের দৃষ্টিতে আকৃষ্ট করেছে। সব কাজই বড়ায়ি রাধাকে গোপনে সারতে পরামর্শ দিয়েছে।

‘করিব আপণ কাজ না জাণিব আনে।

বড় কাজ করিআঁ না করী জানাজাণী।

চিরকাল সুখ ভুঞ্জে দেলি সিআণী॥” (বিরহ, ৬২)

কোথায় কোথায় বড়ায়ি আইহনের ভয়ে সন্ত্রস্ত:

‘ঝাঁট ঘর গেলে দোষ না দিব আইহনে। (বিরহ, ৬২)

বড়ায়ি চরিত্রের এসব দুর্বলতা, ভয়ভীতি, কৃষ্ণের প্রতি ভর্ৎসনা, রাধার প্রতি সমবেদনা- সবই তাকে মানবিক আবেদন দান করেছে।

সুতরাং বলা চলে যে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ধর্মীয় কাহিনি ও তার অন্তরালে অবস্থিত ভক্তের মনোজগতের ঈপ্সিত ভাব অপেক্ষা এর লৌকিক জগৎ ও মানবিক রূপ পরিবেশনই এ কাব্য অধিকতর হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে। দেবতাসুলভ কোনো ব্যবহার এ কাব্যে কোনো চরিত্রে আমরা পাই না। এতে কোনো আধ্যাত্মিকতার কথা নেই। মাটির মানুষের সুখ-দুঃখ, ব্যথা- বেদনায় এ কাব্য মুখরিত। রাধা-কৃষ্ণের রূপকের মাধ্যমে বড়ু চণ্ডীদাস তাঁর সমসাময়িক সমাজকেই বিধৃত করেছেন। এ কাব্যের ভাষা, শব্দ নির্বাচন, পরিবেশ সবকিছুর মধ্যেই আমাদের বাস্তব | জীবনেরই প্রতিচ্ছবি লক্ষ করা যায়। অনভিজ্ঞা বালিকার নিকট বয়স্ক যুবকের প্রেম নিবেদন, বলপূর্বক দেহ উপভোগ, অনভিজ্ঞা বালিকার মুক্তি কামনার আর্তনাদ, যৌবন প্রাপ্ত মুগ্ধাবস্থার মানসিক অবস্থা। সমাজ কর্তৃক লাঞ্ছিত হওয়ার দৃশ্য প্রভৃতি খণ্ড খণ্ড চিত্রগুলো এ কাব্যে মর্ত্যের নরনারীর প্রেমার্তিকেই ফুটিয়ে তুলেছে।

তাই বলা হয়, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মূল আকর্ষণ মানবিকতা। কল্পময় ভাবে, ঐশ্বর্যে ও অভিব্যক্তিতে এ কাব্য মানবিক রসে বিস্তৃত ঘটেছে এবং কবি বড়ু চণ্ডীদাস সেই মানবীয় প্রেমের রস সৃষ্টিতে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।