অথবা, বংশীখণ্ড ও বিরহ খণ্ড অনুসরণে বড় চণ্ডীদাসের কাব্যের নাটকীয় গুণের পরিচয় লিপিবদ্ধ কর

অথবা, নাটকীয় উৎকর্ষে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে অতুলনীয় -আলোচনা কর

অথবা, নাটকীয় উৎকর্ষে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে অতুলনীয় -আলোচনা কর

উত্তর: মধ্যযুগের প্রথম সাহিত্য-নিদর্শন বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এটি মানবিক আখ্যানধর্মী কাব্য; দ্বিতীয়ত, কাব্যটিতে রয়েছে নাটকীয়তা। এছাড়াও এ কাব্যে পাওয়া যায় মানব-জীবনের মহিমা-কীর্তন। অজিত কুমার ঘোষ এবং আশুতোষ ভট্টাচার্য কাব্যটিকে নাটকীয় গুণে সমৃদ্ধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ গ্রন্থের আবিষ্কারক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ ‘গীতিনাট্য শ্রেণির গীতিকাব্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সুকুমার সেন গ্রন্থটিকে ‘নাট্যগীতিকাব্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। স্মরণীয় যে- নাটক দৃশ্য ও শ্রব্য কাব্যের সমন্বয়ে রঙ্গমঞ্চের সাহায্যে গতিমান মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি আমাদের সম্মুখে মূর্ত করে তোলে। । সাধারণত পাত্রপাত্রীর উক্তি প্রত্যুক্তিতে ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষ ও বহির্দ্বন্দ্বের রূপই হলো নাটক। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” কাব্যে এ নাট্যরসের অপূর্ব বিকাশ ঘটেছে। নাটক ও গীতিকবিতার বেলাভূমির উপর দিয়েই এ কাব্যের স্রোতধারা গভীর খাতে প্রবাহিত হয়েছে। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি নাটকীয় ঢঙে লেখা। এর আবিষ্কার কর্তা বসন্তরঞ্জন রায় ভূমিকায় বলেছেন, “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন গীতগোবিন্দের অনুকরণে রচিত গীতিনাট্য শ্রেণির গীতিকাব্য।”

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের নাটকীয় গুণ বা উপাদান : বড়ু চণ্ডীদাসের “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” কাব্য রাধাকৃষ্ণের বিরহ মিলনের আধারে রচিত আখ্যায়িকা কাব্য। এর অঙ্ক ও দৃশ্য বিভাগ না থাকলেও এতে খণ্ডবিভাগ, গতিশীল চরিত্র এবং চরিত্রানুযায়ী সংলাপ ও উৎকণ্ঠা রয়েছে। রাধা কৃষ্ণ এবং বড়ায়ি এই তিন জনের কথোপকথন বা সংলাপের মধ্য দিয়ে সমস্ত গ্রন্থটি নাটকীয় গুণে মণ্ডিত হয়েছে। এই সংলাপধর্মিতা নাটকের অন্যতম উপাদান। কাজেই নাটকের বিশিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে কাহিনির চরিত্র সৃষ্টি, ঘটনার ঘাত-প্রাতঘাত “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” কাব্যে বিদ্যমান। প্রত্যেকটি ঘটনা নাটকীয় ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে এবং পরবর্তী ঘটনা জানার জন্য প্রবল আগ্রহ ও উৎসাহ পাঠককে উন্মুখ করে তুলেছে।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” রাধাকৃষ্ণ লীলা বিষয়ক নাট্যগীতিকাব্য। এটি ত্রয়োদশ খণ্ডে বিভক্ত; যথা: জন্মখণ্ড, তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ভারখণ্ড, ছত্রখণ্ড, বৃন্দাবনখণ্ড, কালিয়াদমন খণ্ড, যমুনাখণ্ড, হারখণ্ড, বাণখণ্ড, বংশীখণ্ড ও রাধাবিরহ (খণ্ড)। প্রথমে এর খণ্ডগুলো বিচার প্রসঙ্গে নাট্যধর্মের পরিচয় দেওয়া যাক। কাব্যের প্রথম খণ্ডে অতি সংক্ষিপ্তভাবে নাটকীয় পরিবেশ রচনার ভেতর দিয়ে অনেক কথা ব্যক্ত হয়েছে। এ ‘জন্মখণ্ড’কে গ্রহণ করা যেতে পারে সমগ্র নাট্যপালার মুখবন্ধ হিসেবে। এ অংশে কাহিনির দ্রুত গতি ও সংক্ষিপ্ততা বিস্ময়কর বলে মনে হয়, বিশেষকরে মূল কাহিনির অতি বিলম্বিত গতির সাথে তুলনীয়। এ অংশে কৃষ্ণ, রাধা এবং বড়ায়িকে আমাদের সামনে পরিচিত করিয়ে কবি সংলাপ সংগীতময় নাটকের মূল প্রাণ অংশে প্রবেশ করলেন।

‘তাম্বুলখণ্ড’ থেকে নাটকীয়তা শুরু। এ খণ্ডে কৃষ্ণ রাধাকে কামনা করেছে এবং রাধা আপত্তি করেছে। দ্বন্দ্বের কেন্দ্র এখানেই। কৃষ্ণের ইচ্ছা এবং রাধার ইচ্ছার বৈপরীত্যতা থেকে চেষ্টা এবং ক্রিয়ার বৈপরীত্য কাহিনি আকারে বিন্যস্ত। কৃষ্ণের দানীর ভূমিকা গ্রহণ, নৌকা বিলাস, ভূঙ্গারের জলে রাধার চৈতন্য সঞ্চার প্রভৃতি ঘটনার মধ্যে নাটকোচিত আকস্মিকতা ও বৈচিত্র্য লক্ষিত হয়। বার্ণখণ্ড এসে রাধার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। সৃষ্টি হয়েছে অন্তর্দ্বন্দ্বের। আর এখান থেকেই নাটকীয় রস দানা বেঁধে উঠেছে।

তারপর কবি একটি সংঘাতাভাস সৃষ্টি করেছেন ‘বংশীখণ্ডে’। কৃষ্ণের বংশী চুরি ঘটনায় নাটকীয়তা বিদ্যমান। এখানে রাধা কৃষ্ণের সংলাপের ভিতর দিয়ে বিতর্ক উদ্দাম, দ্বন্দ্ব ক্ষুব্ধ এবং নাটকীয় হয়ে উঠেছে। যেমন-

কৃষ্ণ- ‘গাই রাখিতে নিন্দ গেলোঁ বাঁশী মাথে।

সে না বাঁশী আল রাধা নিলী কোণ ভিতে’।

রাধা- ‘নান্দের নন্দন কাহ্নাঞি বোলোঁ মো তোহ্মারে।

কথাঁ বাঁশী হারায়িত দোষসি আহ্মারে।’ (বংশী, ৩৩)

এখানে নাটকীয় দ্বন্দ্ব তীব্রতা পেয়েছে। ‘বিরহখণ্ডে’ এসে এ দ্বন্দ্ব সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হয়ে উঠেছে। রাধা এবারে চেয়েছে কৃষ্ণ চায়নি। নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টিতে এ বিরুদ্ধ মনোভাব বিশেষরূপে কার্যকরী হয়েছে। বিরহখণ্ডে নারদ এক পরম নাটকীয় মুহূর্তে উপস্থিত হয়েছেন। কৃষ্ণগতাপ্রাণা রাধা যখন বড়ায়িকে নিয়ে ব্যাকুল চিত্তে বন-বনান্তরালে কৃষ্ণকে অন্বেষণ করছে এবং তাকে না পেয়ে কাঁদতে আরম্ভ করেছে-

‘দুহেঁ মেলিআঁ কাহাঞি চাহিল

না পাইআঁ জুড়িল ক্রন্দনে।’ (বিরহ, ৪৭)

সেই সময় নারদ এসে উপস্থিত হয়েছেন এবং রাধার প্রণয় ব্যাকুল অবস্থা দেখে ধ্যানস্থ হয়ে বলে দিয়েছেন যে কৃষ্ণ বৃন্দাবনে এক কদমতলায় অবস্থান করছে। মৃতপ্রায় রাধা যেন জীয়ন কাঠির স্পর্শে নতুন জীবন লাভ করেছে এবং সে ছুটেছে বৃন্দাবনে। প্রিয়ামানসের এই ব্ল‍্যাকুলার্তির সাথে কবি ছন্দের যাদুস্পর্শে পাঠক চিত্তকেও ক্রমোচ্চ আবেগে দোলায়িত করেছেন। রাধা ও কৃষ্ণের মিলন দৃশ্য অবলোকনের জন্য যখন পাঠকের অন্তর্লোক ভিতরে ভিতরে তীব্র ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, সেই মুহূর্তে কবি কৃষ্ণদর্শন প্রাপ্তা রাধাকে মূর্ছিতা করে চরম নাটকীয়তা সৃষ্টি করেছেন। আবার রতি-বিহার ক্লান্ত। রাধা যখন কৃষ্ণের উরুতে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে নিদ্রা গেল তখন কৃষ্ণ নিদ্রাভিভূত রাধাকে রেখে মথুরার পথে অদৃশ্য হলো। এরপর জাগ্রত রাধার বুকে বিরহের যে তীক্ষ্ণশেল নিক্ষিপ্ত হয়েছে তা চরম নাটকীয়তায় পাঠকের মনকেও বিদীর্ণ করে গেছে।

নাটকের সংলাপ কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং এই সংলাপ কাহিনির বিভিন্ন চরিত্র বা পাত্র-পাত্রির মুখে উচ্চারিত হয়। এ কাব্যের কাহিনি কৃষ্ণ, রাধা ও বড়ায়ি চরিত্রের সংলাপ, প্রতি সংলাপের মধ্য দিয়ে পরিণতি লাভ করেছে। কবি নাটকের রীতি অনুসরণ করেই পাত্র-পাত্রীর উক্তি-প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে রাধা-কৃষ্ণের সামনে উপস্থিত করার জন্য নাটকীয় কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। বিশেষত এ কাহিনির নায়িকা রাধাকে কৃষ্ণের সামনে উপস্থিত করার জন্য নাটকীয় কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। কৃষ্ণের নিকট রাধার রূপ বর্ণনা করার প্রয়োজনে কবি পূর্ব থেকেই নাট্যগুণ সমন্বিত পটভূমি রচনা করেছেন। প্রধান চরিত্রগুলোর ক্রমবিকাশের দিক দিয়ে ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং বহির্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা নাট্যধর্মিতার আর একটি বৈশিষ্ট্য। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র রাধা এবং কৃষ্ণের যুগল চরিত্রের ক্রমবিকাশে বিভিন্ন নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাতে এই অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং বহির্দ্বন্দ্বের সুনিপুণ প্রকাশ ঘটেছে। বিশেষকরে রাধা চরিত্রের ক্রমপরিণতিতে নাট্যকারের প্রতিভা সুপরিস্ফুট। সমালোচক ড. নীলিমা ইব্রাহীমের ভাষায়-

“নায়িকা রাধা চরিত্রের ক্রমবিকাশ ও পরিণতিও আমরা দেখতে পাই। তার চরিত্রের আত্মিক ও বহির্দ্বন্দ্ব এ কাব্যকে অধিকতর নাট্যিক সার্থকতা দান করেছে।”

বড়ায়ির মুখে রাধিকার রূপের কথা শুনে কৃষ্ণের মনপ্রাণ আকুলি-বিকুলি করে ওঠে এবং কৃষ্ণ তার সেই মনোভাবের প্রকাশ করে এভাবে-

“তোর মুখে রাধিকার রূপকথা সুনী।

ধরিবার না পারোঁ পরাণী ॥ বড়ায়ি ল॥”

প্রথম খণ্ডে যে রাধিকা কৃষ্ণের প্রতি বিরূপ সেই রাধিকাই বংশী খণ্ডে কৃষ্ণপ্রেমে পাগলিনী, অন্যদিকে যে কৃষ্ণ রাধা বিরহে পাগল প্রায় আবার সেই কৃষ্ণই রাধার প্রতি চরম ঔদাসিন্য ও নির্লিপ্ততার পরিচয় দিয়েছে। এ পরিবেশটি রমণীয় নাটকীয় এবং উপভোগ্য। ‘দানখণ্ড’ এবং ‘নৌকাখণ্ড’ এ সংঘাতমূলক আখ্যান সংযোজনে চণ্ডীদাস কাব্যের নাটকীয় আবেদনকে আরো ঘনীভূত করে তুলেছেন। সেইসাথে সরস ব্যঙ্গাত্মক উক্তি কাব্যের নাটকীয়তাকে গতি দান করেছে। রাধা ও কৃষ্ণের কথোপকথন থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়। যেমন-

“তোর রূপ দেখি মোর চিত নহে থীর।

প্রাণ যেহ্ন ফুটি জাএ বুক মেলে চীর ॥”

এর উত্তরে রাধিকা বলেছে-

“যার প্রাণ ফুটে বুকে ধরিতে না পারে।

গলাত পাথর বান্ধী দহে পসী মরে ॥”

এ কাব্যে কৃষ্ণের সাথে রাধার সম্পর্ক কি তা রাধার কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কিন্তু কৃষ্ণ প্রথম থেকেই এ বিষয়ে জ্ঞাত ও সচেতন। এরই সূত্র ধরে কাব্যে নাটকীয় রস বিন্দু থেকে সিন্ধুতে পরিণত হয়েছে। এ কাব্যের সমস্ত পদ রাধাকৃষ্ণ-বড়ায়ির উক্তি প্রত্যুক্তিতে বিধৃত হয়ে আছে। এই তিন জনের সরস সতেজ উক্তি প্রত্যক্তির মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ নাট্যকাব্যের সকল রস ও ভাবের বিকাশ সাধন করেছেন। যেমন- বংশীখণ্ডের এক জায়গায় রাধা কৃষ্ণের বাঁশি চুরি করে এবং এ ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে কিছু বাকবিতণ্ডা হয়-

কৃষ্ণ: “গাই রাখিতে নিন্দ গেলোঁ বাঁশি সাথে

সেনা বাঁশি আলোঁ রাধা নিলি কোল ভিতে।”

রাধা: “নান্দের নন্দন কাহ্নাঞি বোলোঁ মো তাহ্মারে

কোথা বাঁশি হারায়িতযা দোষী আহ্মারে।”

এভাবে পরস্পরের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে কাহিনির নাটকীয়তা বেশ জমে উঠেছে। দ্বন্দ্ব নাটকের প্রাণ। রাধা ও কৃষ্ণের কথোপকথনের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব অতি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। পরবর্তী আরেকটি পদে সংলাপগত দ্বন্দ্ব আরো নাটকীয় হয়ে উঠেছে। যেমন-

কৃষ্ণ: “সুনহ আইহন দাসী তো মোর চোরায়িলি বাঁশি

তেসি তোর পাছে বেড়ায়ি এ

বাঁশি ঘাটি দেহ মরে বড় পুণ পাহ তবে

বাঁশি পাইলে সুখে ঘর জাই এ।”

রাধা: “সুনহ নাটক কাহ্ন কর অপমান

তোর বাঁশি আহ্মে নাঁহি নীতি

বাঁশি যবে পাইও তবে ঘমি ঘাটিএ

চারি চীর করিয়া পোড়াই এ॥”

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” কাব্যের আর একটি বিশেষ দিক হচ্ছে কাব্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহির্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়ে নাটকীয় পরিবেশটি সংগত রূপ ধারণ করেছে। বড়ায় এর নিকট হতে রাধার রূপের প্রশংসা শুনে কৃষ্ণ যখন রাধাপ্রেমে ব্যাকুল, তখন একটা চরম বহির্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে দেখা যায়। একদিকে রাধা অজ্ঞাত যৌবনা, অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণের মাতুলানী। বয়সের পার্থক্য এবং সম্পর্কের বৈপরীত্য কাব্যের বহির্দ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে। মোটকথা ঘটনা বিন্যাসের আকর্ষণ-বিকর্ষণ, ঘাত-প্রতিঘাত এবং অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহির্দ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে নাট্যধর্মের উজ্জ্বল অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে। রাধা-কৃষ্ণের মধ্যে মামী-ভাগিনেয় সম্পর্ক। কিন্তু কৃষ্ণ তা স্বীকার করে না। কৃষ্ণের মতে- সে দেবরাজ আর রাধা তার রানি। এ কথায় রাধা তাকে বলেছে-

“এ বোল বুলিতে তোর মনে বড় সুখ।

পর ঘর পইসে যেহ্ন চোর পাটাবুক ॥”

এ কাব্যে রাধা-কৃষ্ণ-বড়ায়ি ছাড়াও কাহিনির অন্তরালে গোপীগণ, যশোদা, আইহন, রাধার শাশুড়ি-ননদ অবস্থান করেছে। নাট্যকার ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে যেমন মনস্তাত্ত্বিক ও বাহ্যিক দ্বন্দ্বের স্বরূপ তুলে ধরেছেন- তেমনি বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে অন্তরালের ঘটনাও তুলে এনেছেন নাটকীয় কৌশলে। এছাড়া কবি তৎকালীন প্রচলিত প্রবচন ও উপমার মাধ্যমে প্রয়োগ করে কাব্যের নাটকীয়তাকে সমৃদ্ধ করেছেন। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে রাধার উক্তি স্মরণ করা যায়-

“বড়ার বহুআরী আহ্মে বড়ার ঝী।

মোর রূপ যৌবনে তোক্ষেতে কী ॥

দেখিল পাকিল বেল গাচের উপরে।

আর তিল কাক তাক ভখিতে না পারে ।”

নাটকের প্রধান গুণ বাস্তবধর্মিতা। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের নায়ক নায়িকার দ্বন্দ্ব কলহ মনের ও মেজাজের উত্থানপতন, প্রথমে অসংগতি ও পরিণামে আত্মনিবেদনের ব্যাকুলতা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে কবির মানব প্রকৃতি সম্বন্ধে গভীর অভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায় এবং সংলাপগুলো ঠিক বাস্তবধর্মী বলে মনে হয়। এদিক থেকেও বড়ু চণ্ডীদাসের “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”কে নাট্যধর্মের আওতাভুক্ত করা যায়। নাটকীয় গঠন কৌশলের জন্য কাব্যের প্রথমটি অত্যন্ত চঞ্চলতার মধ্যে শুরু হয়েছে। যেখানে সংলাপের তীক্ষ্ণতা, ঘটনায় স্থান পরিবর্তন আখ্যানের গতিময়তা সকল দিক দিয়েই নাট্যধর্মের পরিচয় বহন করে। কাহিনি বিন্যাসে কথোপকথনে নাটকীয় রীতির প্রতিফলন আছে। স্থানে স্থানে গীতি-কবিতার সুর অনুরণিত হলেও গীতিকাব্যের লক্ষণ অপেক্ষা নাটকের উপাদানই বেশি প্রকাশমান। বড়ু চণ্ডীদাস রাধা, কৃষ্ণ ও বড়ায়ির সরস ও সতেজ উক্তি প্রত্যুক্তির দ্বারা শ্রেষ্ঠ নাট্যকাব্যের মতো সকল রস ও ভাবগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন। সুতরাং ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে নাট্যগীতি কাব্য বলা যেতে পারে। এতে একটি সুগঠিত নাটকীয় ব্যঞ্জনার অপূর্ব সংহতি ঘটেছে। পরিশেষে বলা যায় যে, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি নাটকীয়তার দিক থেকে যথেষ্ট সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে।