উত্তর : চোদ্দো শতকে রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, কাব্যে পুরাণের কিছু কিছু কাহিনি থাকলেও সেকালের লোক প্রচলিত কাহিনি এমনকি কল্পিত কাহিনিও এখানে স্থান পেয়েছে। এই কাহিনির মধ্যে সমকালীন সমাজের পরিচয় উপস্থাপিত হয়েছে। এই সমাজ ধর্মনির্ভর গ্রামীণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের। কাব্যের বিভিন্ন অংশে এই সমাজের নানান দিক যেমন- কুসংস্কার, জীবনবোধ, ধর্মবিশ্বাস, আচার-আচরণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ, পেশা ও জীবিকা বিধি বিষয় এতে স্থান পেয়েছে। বড়ু চণ্ডীদাস উচ্চারণঙ্গের কবি প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। ফলে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে সমাজজীবনের লৌকিক স্তরে রাধাকৃষ্ণের মানবিক প্রেমলীলারস তুলে ধরেছেন। রাধা ও কৃষ্ণ এখানে লৌকিক, মানবিক এবং আমাদের পরিচিত জগতের রক্ত-মাংসের সাধারণ মানব-মানবী হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। রাধা-কৃষ্ণের হৃদয়ানুভূতি আবেগ ও লৌকিক মানসিকতার সুষম মিথস্ক্রিয়ার আশ্চর্য শিল্পিত প্রকাশ ঘটেছে এই পৌরাণিক প্রেমগাথার মধ্যে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এর রাধাকৃষ্ণ বাস্তব সমাজ পরিবেশে লালিত সাধারণ নরনারী সমাজ সীমার মধ্যে সাধারণ মানব ও মানবীর মতোই তাদের প্রেম ও প্রেমবিহ্বল চিত্তের প্রকাশ ঘটেছে। ফলে এ কাব্যে কবি বড়ু চণ্ডীদাস দেহ বা শরীরকে অস্বীকার করেননি। আত্মা এখানে দেহকে আশ্রয় করে আবর্তিত ও বিবর্তিত ও বিকশিত হয়েছে, লেখক জ্ঞাতসারে কখনোই দেহকে অস্বীকার করতে চাননি।

এ কাব্যে লৌকিকজীবন, লৌকিকরুচির প্রকাশ মুখ্য ও স্বতঃস্ফূর্ত। প্রেমগাথার সাথে যুক্ত হয়েছে সমাজ সংসারের বাস্ত বচিত্র। মর্ত্য পৃথিবীর রাধাকৃষ্ণের প্রেম এ কাব্যে কামনার রঙে আলোড়িত-আন্দোলিত। এ প্রণয়গাথার প্রকাশ সংকোচহীন:

“কুচযুগ দেখি তার অতি মনোহরে।

অভিমান পাআঁ পাকা দাড়িম বিদরে ॥

মাঝাখিনী গুরুতর বিপুল নিতম্বে।

মত্ত রাজহংস জিনী চলএ বিলম্বে ॥

দিনে দিনে বাড়ে তার নহুলী যৌবন।”

এ কাব্যের নায়ক কৃষ্ণের মধ্যে যে অশ্লীলতা ও রুচিহীনতার পরিচয় পাওয়া যায় তা সে যুগের এবং সেকালের সমাজজীবনের আলেখ্য। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য পাঠ করলে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলো এর রাধা এবং কৃষ্ণ বাস্তব সমাজ পরিবেশের মধ্যে সংস্থাপিত হয়েছে। তাই রাধাকৃষ্ণের কাহিনি লৌকিক মানবপ্রেমের কাহিনি। বাঙালির শাশ্বত লৌকিক জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলার মাধ্যমে।