অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আধ্যাত্মিকতা বিচার কর
অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে কৃষ্ণ আছে, কীর্তন নেই – আলোচনা কর
উত্তর: মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য। রাধাকৃষ্ণের প্রেমোপাখ্যান অবলম্বনে রচিত এ কাব্য। এ কাব্যে কৃষ্ণ আইহন পত্নী-বালিকা রাধার রূপলাবণ্যে আকৃষ্ট হয়ে তাকে প্রণয়িনীরূপে প্রার্থনা করেছে এবং রাধার অসম্মতি সত্ত্বেও নানা ছলে তাকে অনুসরণ করেছে। কিন্তু রাধা প্রথম থেকেই কৃষ্ণের প্রতি বিরূপ। সব সময় তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছে। নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে পরিশেষে রাধাকৃষ্ণের নিকট আত্মসমর্পণ করেছে। তাদের মিলনে সেতু পথ রচনা করেছে বড়ায়ি। সম্ভবত কোনো কোনো পল্লি অঞ্চলে অমার্জিত রুচি প্রাকৃত জনসাধারণের মধ্যে ‘রাধাকৃষ্ণ’ প্রেম সম্বলিত এরূপ একটা গ্রাম্যতা দুষ্ট কাহিনি প্রচলিত ছিল এবং কবি বড়ু চণ্ডীদাস তাই-ই নিজ কাব্যের বিষয়বস্তু রূপে গ্রহণ করেছেন।
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত যে কাহিনি আছে তা আধুনিক ভাবনার কাছে নিঃসন্দেহে রুচিহীন। কেননা সমগ্র কাব্যটিতে চলেছে ‘আদিরসের অশ্রান্ত প্লাবন।’
সমালোচক ড. কৃষ্ণপদ গোম্বামীর ভাষায়, “উদগ্র যৌনতৃষ্ণার লেলিহান জিহ্বা যেন কাব্যের রসটুকু প্রায় নিঃশেষে পান করিয়াছে।” রাধা ও কৃষ্ণ বিষয়ক কথা আছে বলে আবিষ্কারক বসন্তরঞ্জন রায় গ্রন্থটির নামকরণ করেছেন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। নামটির মধ্যে উচ্চভাব আছে; একটি পবিত্রতা আছে। বিশেষকরে কৃষ্ণ ভক্তের কাছে নামটি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু সমালোচকবৃন্দ গ্রন্থের নামকরণের সাথে গ্রন্থের ভিতরে বর্ণিত বিষয়ের মিল নেই বলে নামকরণের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা স্পষ্টই বলেছেন,
“এ গ্রন্থ অশ্লীল, অনাচারী জীবন সংবাদে ভরপুর, কামকেলির অবাধ, উন্মুক্ত বর্ণনায় পীড়াদায়ক।”
এ গ্রন্থে কৃষ্ণ আছে ঠিকই কিন্তু কোনো কীর্তন নেই অর্থাৎ কৃষ্ণের কোনো গুণ বা প্রশংসা বাক্য এ গ্রন্থে ধ্বনিত হয়নি। কাব্যের কাহিনির ধারাবাহিক বিশ্লেষণে আমরা এ মন্তব্যের যথার্থতা অনুধাবন করতে চেষ্টা করব।
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে কৃষ্ণ নররূপে নারায়ণ কিন্তু তাঁর স্বর্গীয় ক্ষমতার অলৌকিক ব্যবহার এ কাব্যে আমরা কোথাও দেখতে পাই না। বাহ্য দৃষ্টিতে মনে হয় কৃষ্ণের সম্ভোগের জন্যই রাধার জন্মগ্রহণের পরিকল্পনা করে কাব্যের কাঠামো রচিত হয়েছে। পুরাণে বর্ণিত হয়েছে কৃষ্ণ মহাপুরুষ। তিনি আত্মিক জীবনের অধিকারী। মঙ্গলের বাচনিক, সত্যের রক্ষক এবং অত্যাচারী বিনাশক। পৃথিবীর পাপভার লাঘবের জন্য মানবের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে আমরা যে কৃষ্ণের পরিচয় পাই সে কৃষ্ণ ভিন্ন প্রকৃতির, ভিন্ন স্বভাবের। কবি কাহিনির বিস্তার ঘটিয়েছে গোপ পল্লিতে, সেখানে কোনো উন্নততর জীবন ভাবনা ছিল না। এ কাব্যে কৃষ্ণ চরিত্রহীন কামার্ত যুবক। মাতুলানী সম্পর্কে বিস্মৃত হয়ে যে দেহ ভোগ লিপ্সা চরিতার্থ করবার জন্য রাধার সাথে মিলিত হতে উৎসুক। রাধা বিবাহিতা। তার স্বামীই আইহন। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়াতে রাধার যৌবন ভোগ সম্পর্কে জ্ঞান নেই। তবে স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাবতী রাধা কৃষ্ণের অশোভন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তার পাঠানো তাম্বুল পায়ে দলিত মথিত করে এবং দূতী বড়ায়িকে অপমানিত করে। রাধার এই আচরণ স্বাভাবিক।
কিন্তু কৃষ্ণের এতে লজ্জাবোধ হয়নি, সে দমে যায়নি। বড়ায়ির মুখে রাধার রূপের কথা শুনে কামলোলুপ কৃষ্ণ রাধার দেহভোগের কামনায় উন্মত্ত হয়ে পড়ে। কখনো ভয় দেখিয়ে, কখনো রাগ করে, কখনো বা অনুনয় বিনয় করে সে রাধাকে বশ করতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু রাধা কোনোমতেই কৃষ্ণের প্রস্তাবে রাজি হয়নি, বরং ‘গরুর রাখাল’ বলে তাকে গালি দিয়েছে। গরুর রাখাল হিসেবে কৃষ্ণ চরিত্রের যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে নীচ ভাবনা অস্বাভাবিক নয়। কৃষ্ণ রূপমোহে অন্ধ, নীতি ও সংযমের শাসন মানে না। সামান্য ভিখারীর ন্যায় যে চন্দ্রাবলীর দ্বারে প্রার্থী হয়েছে প্রেমার্থী কৃষ্ণ রাধার ভার বইছে, মাথায় ছাতি ধরেছে, নৌকায় তাকে পার করিয়েছে, তার জন্য কালিমাগকে প্রাণ তুচ্ছ করে দমন করেছে। এসবই করেছে কৃষ্ণ দেহ ভোগের লালসায়। এমনকি সবরকমে ব্যর্থ হয়ে কৃষ্ণ রাধাকে বশ করবার জন্য রাধার বক্ষে পুষ্পবাণ নিক্ষেপ করেছে। স্থানে স্থানে কৃষ্ণের উক্তিও পরিচ্ছন্ন মনোভাবের পরিচায়ক নয়। ‘বংশীখণ্ডে’ রাধা কৃষ্ণকে অপছন্দ করার মতলবে কৃষ্ণের বাঁশী চুরি করলে কৃষ্ণ গ্রাম্য বালকের মতো উত্তেজিত হয়ে ওঠে। রাধার প্রতি তাঁর কটুক্তি অত্যন্ত নিন্দনীয়,
‘নটকী গোআলী ছিনারী পামরী
সত্যে ভাষ নাহি তোর’। (বংশী, ২৭)
আবার ‘বিরহখণ্ডে’ রাধা যখন সমস্ত বিরূপতা ত্যাগ করে কৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে তখন কৃষ্ণ তাকে আগ্রহ আকাঙ্ক্ষা ও সপ্রণয় আবেগের দ্বারা গ্রহণ করেনি। বরং কুটিল ভাষায় রাধাকে ব্যঙ্গ করে বলেছে,
‘দূতা দিঞা পাঠায়িলোঁ গলার গজমুর্তী।
তবে নাম, পাড়ায়িলে আগে আবালি সতী।
এবে কেহ্নে গোআলিনী পোড়ে তোর মন।
পোটলী বান্ধিঞাঁ রাখ নহুলী যৌবন। (বিরহ, ২৭)
কৃষ্ণের এসব আচরণ দেব মাহাত্ম্য থেকে তাকে বঞ্চিত করেছে। আবার বাঁশি হারিয়ে কৃষ্ণের আকুল ক্রন্দন-
‘হাকান্দ করুণা করোঁ ভূমিত লোটায়িআঁ।’ (বংশী, ২২)
বাঁশীর শোকে কৃষ্ণের এই আচরণও ভক্ত বৈষ্ণবকে ক্ষুব্ধ করেছে। ভক্ত বৈষ্ণব কৃষ্ণকে এ রকম আচরণ করতে দেখে মর্মাহিত হয়েছে।
রাধার প্রতি কৃষ্ণের স্নেহ, করুনা, প্রেম প্রভৃতি সদৃত্তির কোনো পরিচয় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে নেই। রাধার প্রতি কৃষ্ণের যে আচরণ তাতে সমালোচকরা দেহলোলুপ কাম পিপাসা ব্যতীত কোনোরূপ উচ্চতর প্রবৃত্তির সন্ধান পাননি। ফলে অনেকেই। কৃষ্ণকে ইতর এবং লম্পট বলেছেন। এ প্রসঙ্গে সমালোচক ড. অমিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে। লিখেছেন,
“কৃষ্ণ চরিত্র বিশ্লেষণ করিলে তাঁহার মধ্যে স্কুল দাম্ভিকতা, দেহলোলুপ প্রতিশোধ গ্রহণের কুটিল ইচ্ছা ব্যতীত অন্য কোন সদগুণ বা কোমলতার মানবীয় প্রবৃত্তির সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। সেই জন্য আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এ কাব্য বস্তুর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কৃষ্ণ চরিত্রে পূর্ণতা নেই, সঙ্গতি নাই, —কৃষ্ণ চরিত্রকে তিনি স্বখ্যাত সলিলে নিমজ্জিত করিয়াছেন।” (শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কৃষ্ণ চরিত্র)
সমালোচকদের এরূপ বলাটা অস্বাভাবিক নয়। কৃষ্ণ চরিত্র অনেকটা অপূর্ণ আর সঙ্গতিহীনতার দোষে দুষ্ট। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে পৌরাণিক কংসারী কৃষ্ণকে ভগবান বিষ্ণুর বীর রসাত্মক অবতার হিসেবে পাওয়া যায় না; তাই কোনো কোনো সমালোচক, এই বলে বক্রোক্তি করে থাকেন যে, “শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কৃষ্ণ আছে, কীর্তন নেই।” এ কাব্যের নামকরণে কীর্তন কথাটি সংযোজন করা হলেও এর তাৎপর্য কাব্যের বক্তব্যে লক্ষ করা যায় না। বৈষ্ণবদের ধর্মচর্চার বিশেষ অঙ্গ কীর্তন। তাঁরা রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে জীবাত্মা পরমাত্মার রূপক হিসেবে মনে করে থাকেন। পদাবলীতে এই প্রেমের দার্শনিকতা ও ধর্মনৈতিকতা প্রতিফলিত। কিন্তু ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রাধাকৃষ্ণলীলা বিষয়ক কাব্য এবং তা একান্ত ই একটি প্রায় কাব্য ও অতি অবশ্যই পরকীয়া প্রেম সমন্বীয়। এ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই যে, কবি বড়ু চণ্ডীদাস কৃষ্ণের কীর্তন গান করার জন্য এ কাব্য লেখেননি, তিনি তৎকালীন রুচির পরিপ্রেক্ষিতে নামমাত্র রাধাকৃষ্ণ কাহিনি নিয়ে আদি রসাত্মক কাব্য লিখেছেন এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে সমকালীন জীবন চেতনাকেই তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন।
সুতরাং ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ যারা আধ্যাত্মিকতা খোঁজেন তারা মরুভূমির মরীচিকার সন্ধানেই রত। প্রকৃতপক্ষে বলা হয়েছে, এতে পদাবলীর আধ্যাত্মিক আবেদন নেই। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের প্রেম দৈহিক কামনা বাসনার বাইরে যেতে পারেনি। তাই এ কাব্য কীর্তনের মর্যাদার অধিকারী হতে পারে না। এমনকি বৈষ্ণব ভাবাদর্শ থেকে বিচ্যুতি বলে কেউ কেউ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কৃষ্ণ নেই, কীর্তন নেই’ বলেও মন্তব্য করেছেন।
তবে একথাও ঠিক যে, স্থূলতা ও অশ্লীলতা থাকা সত্ত্বেও ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র কতকগুলো পদে কবির গভীর সৌন্দর্যবোধ ও শালীনতার পরিচয় পাওয়া যায়। ‘বংশী’ ও ‘বিরহ’ খণ্ডে পূর্বতন ধারার পরিবর্তন ঘটেছে। সেখানে রাধা চরিত্রের বিবর্তন খুবই লক্ষ্যগোচর। যে রাধা কৃষ্ণের নাম শুনতে পারত না, তার সকল | কুপ্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে, সে রাধাই কৃষ্ণগতপ্রাণ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, কৃষ্ণ রাধার দেহভোগ করার পর রাধার | প্রতি তার আর কোনো আকর্ষণ থাকল না। তাই রাধার অনুনয় বিনয় উপেক্ষা করে সে সহজেই মথুরা চলে গেছে। কৃষ্ণের এই আচরণ প্রতিশোধ গ্রহণের সামিল। পদাবলীতে যে রাধা এবং কৃষ্ণকে আমরা প্রত্যক্ষ করি, তাদের মধ্যে যে প্রেম তাকে ‘নিকষিত প্রেম’ এর সাথে তুলনা করা চলে। ‘বংশী’ ও ‘বিরহ’ খণ্ডে কৃষ্ণের প্রতি রাধার যে আকর্ষণ তা মানবিক গণ্ডি ছাড়িয়ে অনুভূতিময় আধ্যাত্মিক জগতের স্পর্শে নতুন মহিমা লাভ করেছে। তাই সমালোচক বলেছেন, “শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের যেখানে শেষ পদাবলীর সেখানে আরম্ভ।”
কবি বড়ু চণ্ডীদাস ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে কোন সত্যকে রূপ দিতে চেয়েছেন, যে আধ্যাত্মিকতা বা মানবিক প্রায় কাহিনি তা বলা কঠিন। তবে সাধারণ পাঠকের কাছে এ কাব্যের যে আবেদন তা একান্তই মানবিক। রাধা এবং কৃষ্ণকে এখানে গোপপল্লির সাধারণ নরনারী বলেই চেনা যায়। ড. নীলিমা ইব্রাহিমের ভাষায়,
“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ধর্মীয় কাহিনি ও তার অন্তরালে অবস্থিত ভক্তের মনোজগতের ঈপ্সিতভাব অপেক্ষা এর লৌকিক জগৎ ও মানবিক রূপ পরিবেশনই একাব্যকে অধিকতর হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে। সাধারণ পাঠক কৃষ্ণ নেই বলে আর্তনাদ করে না, উপরন্ত কৃষ্ণের মাধ্যমে নারী প্রেমলোভী সাধারণ মানবকে দেখে তার প্রতি অধিকতর আকর্ষণ অনুভব করে।” (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য পাঠের ভূমিকা)
সুতরাং ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ আধ্যাত্মিক কাব্য নয়। এতে আধ্যাত্মিকতা তুচ্ছ, প্রাধান্য বিস্তার করেছে লৌকিক জীবন ও লৌকিক রুচি। কবি লৌকিক কাহিনিতে পরকীয়া প্রেমের এক জীবন্ত আলেখ্য অঙ্কন করেছেন।
Leave a comment