বড়ু চণ্ডীদাস রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি রাধাকৃষ্ণ লীলা বিষয়ক কাব্য। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যকে প্রেম, সৌন্দর্য ও দিব্য চেতনার কাব্যতীর্থে উন্নীত করেছে যে বৈশ্বব সাহিত্য, সে-টি জয়দেব রচিত ‘গীতগোবিন্দ’। দুটি সাহিত্যেই মধ্যযুগের রাধা কৃষ্ণ বিষয় কাহিনি। তবে ‘গীতগোবিন্দ’-এর তুলনায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে নাটকীয়তা অধিক বিবৃত।
সাহিত্যের এই অমূল্য সম্পদটি দীর্ঘকাল অনাবিষ্কৃত ছিল। ১৩১৬ বঙ্গাব্দে শ্রীযুক্ত বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ মহাশয় পুঁথিটি আবিষ্কার করেছিলেন। কাব্যটির প্রথম মধ্য ও শেষের দিকের কয়েকটি পৃষ্ঠা পাওয়া যায়নি বলে কবি পরিচয় অজ্ঞাত থেকে যায়। কাব্যটি ১৩টি খণ্ডে বিন্যস্ত—’জন্মখণ্ড’, ‘তাম্বুলখণ্ড’, ‘দানখণ্ড’, ‘নৌকাখন্ড’, ‘ভারখন্ড’, ‘ছত্রখন্ড’, ‘বৃন্দাবনখণ্ড’, ‘কালীয়দমনখন্ড’, ‘যমুনাখন্ড’, ‘হারখন্ড’, ‘বাণখন্ড’, ‘বংশীখন্ড’ ও ‘রাধাবিরহ’ তবে কাহিনি ও চরিত্র যেভাবে অগ্রসর হয়েছে তাতে অখন্ড কাব্য হিসাবে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। খন্ডগুলির কাহিনি, এমনটি—
জন্মখন্ড— কংসনিধনের জন্য বসুদেবের পুত্ররূপে কৃষ্ণের জন্মগ্রহণ এবং গোকুলে স্থানান্তর।
তাম্বুলখন্ড— কৃষ্ণ কামাতুরা হয়ে রাধাকে প্রেম নিবেদন করেছেন, তাম্বুল প্রেরণ করেছেন বড়ায়ির মাধ্যমে।
দানখন্ড— এই খণ্ডে কৃষ্ণ যমুনায় দানী সেজে রাধার জন্য অপেক্ষমান৷
নৌকাখন্ড— মিলনের জন্য কৃষ্ণ ও বড়ায়ি ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলেন। কৃষ্ণ রাধার সঙ্গ কামনায় যমুনার ঘাটে ঘাটোয়াল সেজে নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করেন এবং বড়ায়ি কৌশলে রাধাকে সেখানে নিয়ে আসে—এই খন্ডে রাধা কৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পন করে।
ভারখন্ডে— ভারী বেশে কৃষ্ণ রাধার জন্য অপেক্ষা করেন।
ছত্রখন্ড— বড়ায়ি-এর পরামর্শে রাধার মাথায় কৃষ্ণ ছত্র ধারণ করেছেন।
বৃন্দাবন খন্ডে— এই খন্ডে গীতগোবিন্দের প্রভাব বিদ্যমান। এই খন্ডে রাধা ও কৃষ্ণের মিলন ঘটে।
কালীয় দমন ও যমুনা খন্ড— কালীদহে জলক্রীড়ায় উৎসাহী হয়ে প্রথমে কালীয়নাগ দমনে তৎপর হলেন। পরে যমুনা খন্ডে রাধা ও তাঁর সখীদের সঙ্গে কৃষ্ণের জল ক্রীড়া বর্ণিত।
হারখন্ড— রাধার হার চুরি করে কৃষ্ণের যশোদার কাছে প্রহার লাভ।
বাণখন্ড— এই খন্ডে কৃষ্ণের রাধার প্রতি সম্মোহিনী বাণ নিক্ষেপ। ফলে রাধাও কাম জ্বালায় জর্জরিত হন এবং মিলনে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন।
বংশীখন্ড— এই খন্ড থেকেই কৃষ্ণের মনের গতি পরিবর্তন হয়। কৃষ্ণ একটি মোহনসুন্দর বাঁশি নির্মাণ করেন এবং বাজান কিন্তু একবারও রাধার সম্মুখে আসেন না।
রাধাবিরহ— রাধা বিরহ অংশে খন্ড নাম যুক্ত হয়নি। তাই অনেকের মত এটি বড়ু চন্ডীদাসের রচনা নয়।
এই কাব্যটিতে বড়ু চণ্ডীদাস অলঙ্কারাদি প্রয়োগ করেছেন। যেমন—‘লবলী দল কোমল’, ‘জুডু আ দেখি আঁ যেহ রুচিক অম্বল’, ‘শরৎ উদিত চান্দো বন্দো কমল’, ‘চরণ থলকমল মন্থর গমনে’ ইত্যাদি বাকাংশের মধ্য দিয়ে অলংকারের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ছন্দের বৈচিত্রও লক্ষণীয়। দিগক্ষরা—
‘একদিনে মনের উল্লাসে
সখী মনে রস পরিহাসে।”
একাবলী –“আয়ি না দেবের সুমতি গুনি।
কংসের আগেক নারদমুনি।।
এছাড়া পয়ার ত্রিপদী বহু ছন্দের পরিচয় পাওয়া যায়।
পরিশেষে বলতে হয় এখানে নাট্যধর্মিতা, গীতিধর্মিতা যেমন লক্ষণীয় তেমনি অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট। কিন্তু তার জন্য বড়ু চণ্ডীদাসকে দোষী করা যায় না। কারণ সেই সময়ের পরিবেশ ছিল স্থূল। তাই সব মিলিয়ে বলতে হয় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই কাব্য।
Leave a comment