প্রাচীন বাংলা কাব্যে বিষয়ীর চেয়েও বড় ছিল বিষয়। কৃষিকেন্দ্রিক গ্রামভিত্তিক সমাজে আবহমান অথবা অনির্দিষ্ট কাল ধরে প্রবাহিত শাস্ত্র নির্দিষ্ট ধর্মীয় প্রসঙ্গ পরিধির মধ্যেই কবিকে স্বকীয় ক্ষমতার চিহ্ন এঁকে দিতে হত। তবু সব দেশে সব কালে শিল্পীর একটি অনুচ্চারিত অধিকার থাকেই অস্তরের নির্দেশ অনুযায়ী বিষয় বেছে নেবার ও পরিবর্তন করার। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে কবি বড়ু চণ্ডীদাস রাধা-কৃষ্ণের প্রচলিত প্রেমকাহিনীর মধ্যে পরিবর্তনের সূচনা করেছেন—’বংশীখণ্ড’ এবং ‘রাধাবিরহ’ অংশ গীতিময় ও নাটকীয় বৈশিষ্ট্য রূপায়ণে।

‘বংশীখণ্ডে’ বাঁশী ছাড়া কৃষ্ণের করুণ অবস্থা খণ্ডটির প্রায় শেষ পর্যায়ে বর্ণিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এই সন্নিবেশের মধ্যে তেমন কিছু নবত্ব নেই। কিন্তু সচেতন অনুসন্ধানে দেখা যায়, এর মূলে আছে কথক কবির শ্রোতা সাধারণের মনে বিস্ময়বোধ তথা চমক জাগানোর প্রবণতা। সাধারণভাবে বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য পর্বে দেখা যায় তিনি ধীরে এগিয়েছেন, হঠাৎ কিছু করতে চাননি। একথা রাধা চরিত্র সম্পর্কে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি স্বীকার্য কাহিনীর বিন্যাস ক্ষেত্রেও। এখানেও দেখা যায় খণ্ডের প্রথমাংশে আছে ‘সাতগুটি বিন্ধ’ করে ‘স্বন্নের সাম্বী হিরার’ কারুকার্য করে বাঁশী-নির্মাণ বিবরণ, তারপর কৃষ্ণের তাতে সুর সাধা এবং চিত্ত-হরণের ক্ষমতা— “হরিতে পুরিআঁ কাহ্নাঞি তাহাত ওঁকার। বাঁশীর শবদেঁ পারে জগ মোহিবার।” আরো পরে অনুপুঙ্খবোধে ভাষার গীতময় লাবণ্য কবি দেখিয়েছেন এই বাঁশীকে আশ্রয় করে কৃষ্ণের রাধার চিত্তের উপর অত্যাচার। অবশেষে একদিন মোহিনী রাধার মধ্যে বড়ায়ীর পরামর্শে জেগেছে সেই মনোবৃত্তি— “বাঁশী চোরায়িআঁ সত্বরে”। ফলে অনিবার্যভাবে ঘটনার মোড় ঘুরেছে, অন্যদিকে রাধার আর্তি এবং হাহাকারকে কবি তুলে দিয়েছেন কৃষ্ণের কণ্ঠে। পূর্ববর্তী খণ্ডবাহিত‌ ঘটনাধারার একঘেঁয়ে ও ক্লান্তিকর বিবরণের মাঝে শ্রোতার আগ্রহকে জাগাবার জন্য ব্রতকথার গল্পের মতো আকস্মিকের উৎপাত এখানেই নেই, ঘটনা অনুসরণে বরং লক্ষ্য করা যায় কবির বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী। নির্জীব একটি বস্তু ‘বাশী’কে উপলক্ষ করে নায়ক নায়িকার মধ্যে বিপরীতার্থক অথচ ঐক্যযুক্ত (যন্ত্রণা জাগার ক্ষেত্রে) মনোপরিবর্তন কিছু পরিমাণে অভিনবও বটে। কবির বক্তব্য যেন অনেকখানি বাঁশী নেই যার কাছে, বেদনা আছে তার পাশে। এক অর্থে, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘স্বর্ণগোলকে’র মহিমার যেন পূর্বসূত্র অস্পষ্টভাবে এর মধ্যে নিহিত।

বংশীখণ্ডে কৃষ্ণচরিত্রটির বিবর্তন নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয় এবং উপভোগ্য। পূর্বতথ্য হিসেবে কবি জানিয়েছেন, বড়াই “নিন্দাউলী মন্ত্রে” কৃষ্ণকে ঘুম পাড়ায় যখন সেই অবসরে রাধা বাঁশীটি নিয়ে চলে যায়। বড়াই হয়ত তখন থেকে সামনেই ছিল। কেননা, ঘুম ভাঙার পর তাকে দেখেই কৃষ্ণের শুরু হয়ে যায় বিলাপ এবং কান্না—

“বাঁশী হারায়িলোঁ বড়ায়ি ল 

আল গোকুল আসিয়া।

হাকন্দ করুণা করো ভূমিত লোটায়িআঁ ।”

শুধু তাই নয়, সকলের কাছে বাঁশী চেয়ে “কাহ্ন বুলে ঘরে ঘরে” এবং না পেয়ে “মাথাত হাত দিয়া কান্দতি গদাধরে।” তবু এখানেই শেষ নয়, বড়াইয়ের “ষোল শত যুবতীকে কর যোড় হাত” উপদেশ অনুযায়ী মহামানী “দেব চক্রপাণী” বাঁশীর জন্য “যোড়হাতে কাকুতী কৈল বনমালী।” একথা অনস্বীকার্য কৃষ্ণের এ ধরনের পরিচয় আদৌ শাস্ত্রসম্মত নয়, পুরাণসঙ্গতও নয়। কিন্তু পূর্ববর্তী খণ্ডে রাধা এবং অন্য গোপীদের প্রতি দুর্ব্যবহারের প্রায়শ্চিত্ত রূপে জীবনসংগত নিশ্চয়ই। আমাদের মনে এক্ষেত্রে সংশয় জাগে নাট্যকার-কবি poetic justice দেখাবার ইচ্ছাতেই কি পুরাণ-বহির্ভূত এই অংশটুকুর কল্পনা করেছিলেন? অথবা এমনও হতে পারে, জয়দেবের কবিতায় কৃষ্ণশিরে পদস্থাপনার দুঃসাহসিক বাসনাই তার রূপকারী বিবেককে উদ্বুদ্ধ করেছিল আপন কাব্যে-স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায়; অর্থাৎ পৌরাণিক চরিত্রের মধ্যেই নিত্যনব তথ্য যোজনায়।

পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যায় রাধাচন্দ্রাবলীর হাসি দেখে কৃষ্ণ বুঝে গেছে বাঁশী আছে কার কাছে। বাঁশীর মহিমা শুনিয়ে তার কাছে প্রথমে করেছে অনুনয় – “আল রাধে জার ধনী সরগদুয়ারে৷ মোরে বাঁশিগুটি দিআঁ যেন দানে” তারপর আচরণে ফুটে উঠেছে দাবী— “বাশী দেহ তেজিআঁ জঞ্জালে। হের তোর ধরিলোঁ আঁচলে।” ক্রমশঃ তা হয়ে উঠেছে আরো তীব্র। কৃষ্ণের নিজস্ব স্বভাববশে এই দাবী হয়ত স্বাভাবিক। কিন্তু “কালিনী নঈকুলে” ‘মাউলানী রাহী’র সঙ্গে ‘ধামালী’-রত হবার সময় লোকলজ্জা বা পারিবারিক শাসন ত্রাসনের ভয় যার কাছে ছিল অবান্তর, সেই “অতি বড় দুরুজন” “ঘোড়াচুলে কাহ্ন” যে “সপ্ত লাখ” মূল্যের বাঁশীর হারানোর ফলে পারিবারিক লজ্জা ভয় এড়াতে পারে না, তার পরিচয় পাই— “সুনী কি বুলিহে বাপ নান্দে। বাঁশী হারায়িলোঁ মো নিন্দে।” এর কারণ হয়ত সেযুগের সমাজে পুরুষের পরস্ত্রী-সংসর্গ আদৌ দোষের ব্যাপার ছিল না, কিন্তু বিনিময়ে মাধ্যমের দুঃষ্প্রাপ্যতা হেতু মূল্যবান ধাতু বা সোনা-সঞ্চয়ের প্রবণতা ছিল অত্যন্ত বেশি, কীনসের ভাষায় ‘enormous and chronic influx of the precious metals’, তাছাড়া আছে লোকপ্রচলিত বিশ্বাস– সোনা হারানো অশুভ ইত্যাদি। আবার তার ছেলেমানুষী বিশ্বাস ও অন্তর্যন্ত্রণাও এই সূত্রে উদঘাটিত— “মাঞ নিষধিল পুতা কাহ্নে ল। না করিহ গোঠ সঘনে। সেহো বোল না শুনিল কানে ল”, আছে তাই দুরন্ত ভয়— “সুনী বাপ মাঞ দিব গালী।” কৃষ্ণ চরিত্রের মধ্যে বিবর্তনের এই দৃশ্যটুকুই উপভোগ্য।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কাব্যের গোড়া থেকেই দেখা যায়, নায়ক-নায়িকার রমণে-বাচনে সংঘর্ষ সমন্বয়ে দ্বন্দ্বই হয়ে উঠেছে তাদের বিধিলিপি। দুজনেই দুজনের চোখের বালি, চোখের মণি নয়। এই দ্বন্দ্বের দোলায় যেমন গড়ে উঠেছে গল্প, তেমনি দুলে উঠেছে শ্রোতা এবং কথকের মন। আরো দেখা যায় এই দ্বন্দ্ব মুহূর্তে রচয়িতার নিরপেক্ষ থাকার প্রবণতা (স্মরণীয় রাধা-কৃষ্ণের উক্তি-প্রত্যুক্তির মধ্যে পারস্পরিক পৌরাণিক দৃষ্টান্ত-প্রসঙ্গ) রাধাকে যথেষ্ট দরদী এবং কুশলীভাবে তুলে ধরলেও, নারীর ছলনাময়ী স্বভাবটিকে কবি দেখাতে ভোলেননি। বাঁশীচুরির অপবাদে তার পারিবারিক সম্মানের দোহাই যেমন কৌতুককর— “বড়ার ঝিআরী বড়ার বৌহারী আহ্মে আইহনের রাণী। আহ্মে বাঁশী তোর চোরায়িল কাহ্নাঞি মুখে আন হেন বাণী,” তেমনি রঙ্গ তুঙ্গে ওঠে যখন সে বলে—“মিছা বোল তেজ সুন্দর কাহ্নাঞি সত্য কর প্রমাণে।” এখানে “সুন্দর কাহ্নাঞি” বিশেষণটি যেন বুঝিয়ে দেয় রাধার শপথ করার অসারতাটুকু। স্বভাবতই এরপর শোনা যায়, বিক্ষুব্ধ কৃষ্ণের কণ্ঠে সেই বহুখ্যাত গালি— “নটকী, গোআলী ছিনারী পামরী সত্য ভাষ নাহি তোরে।” এই রাগ এবং হুঙ্কার অবশ্য আবার পরিণত হয়েছে রাধার প্রতি মিনতিতে ও বিলাপে এবং শেষে অনুরাগে। বড়াইয়ের কথামত রাধা ফেরৎ দিয়েছে কৃষ্ণের বাঁশী। দেবসুলভ দর্প ত্যাগ করে কৃষ্ণ মানবিক দুর্বলতায় স্বীকার করেছে— “যত কিছু করিলোঁ মোঞ রাধার আতোষে তার ফল পাইলোঁ নিজ দোষে।” প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে— “সবদোষ মরমিল তোর চন্দ্রাবলী। আর তোর অহিত না করে বনমালী॥” বলা বাহুল্য, এই স্বীকৃতি এবং প্রতিশ্রুতি লক্ষণীয় উভয়ত — “আজি হৈতেঁ চন্দ্রাবলী হৈল তোর দাসী।” এইভাবেই পরস্পরের বিবাদের সমাপ্তি শাস্তিরসে, গল্প দ্বন্দ্বের বক্ররেখা ছুঁয়ে উপনীত হয়েছে শেষে মিলনের বৃত্তবিন্দুতে।