[ প্রশ্নের মান ৫ ]


পড়ার ঘরে মেজদা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন কেন? প্রকৃত ঘটনা কি ছিল?

মেজদার ফিটের ব্যামো ছিল। তাই অন্ধকারের অকস্মাৎ একটা ‘হুম’ শব্দ শুনে সে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।

আসল ঘটনা হচ্ছে শ্রীনাথ বহুরুপী ‘রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের বেশ ধ’রে শ্রীকান্তের পিসেমশাইয়ের বাড়িতে খেলা দেখাতে এসেছিল। শ্রীকান্ত আর তার অন্য ভাইরা সন্ধ্যার সময় মেজদার কঠোর তত্ত্বাবধানে যখন পড়াশুনার চেষ্টা করছিল সেই সময় শ্রীনাথ সবাইকে ভয় দেখানোর জন্যে শ্রীকান্তের পিঠের কাছে একটা ‘হুম’ শব্দ করে উঠানের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তখন চারপাশে ঘন অন্ধকার থাকায় তাকে কেউ দেখতে পায় নি। তারা সবাই ভেবেছিল সুন্দরবন থেকে একটা ‘রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার’ এসে তাদের আক্রমণ করছে।


সে দিনটা কি মনেই পড়ে।– এই অংশটি কোথা থেকে উদ্ধৃত হয়েছে? এই কথাটি কে বলেছেন? কোন্ দিনটির কথা উল্লেখ করেছেন লেখক? সে দিনটির কথা মনে পড়ে কেন?

এই অংশটি উদ্ধৃত হয়েছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচিত ‘শ্রীকান্ত উপন্যাস থেকে। এই কথাটি বলেছেন শ্রীকান্ত। শ্রীকান্ত একটি ‘ফুটবল ম্যাচের দিনের কথা উল্লেখ করেছেন। সেই দিনটিতে ইস্কুলের মাঠে ‘বাঙ্গালী ও মুসলমান ছাত্রদের’ একটি ফুটবল খেলা হচ্ছিল। অন্য সকলের মত কিশোর শ্রীকান্তও মগ্ন হয়ে সেই খেলা দেখছিল; কিন্তু হঠাৎ খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রবল একটা মারামারি শুরু হয়েছিল। তারপরে পাঁচ-সাতজন মুসলমান ছোকরা তাকে ঘিরে ফেলে তার পিঠের ওপরে একটা ছাতার বাঁট ভেঙে ফেলে। শ্রীকান্ত এইখানে সেই কথা বলেছে।


‘তখন সেই অন্ধকারের মধ্যে যেন দক্ষযজ্ঞ বেঁধে গেল।’ কোন ঘটনার কথা এখানে বলা হয়েছে? দক্ষযজ্ঞ অর্থে ব্যবহৃত শব্দটির তাৎপর্য কী?

কথাটি বলেছে শ্রীকান্ত। কিশোর বয়সে পিসিমার বাড়িতে একদিন সন্ধ্যায় শ্রীকান্ত তার পিসতুতো ভাইদের সঙ্গে পড়াশুনার চেষ্টা করছিল। ঘরের বাইরে তখন ছিল জমাট অন্ধকার। বৈঠকখানার দাওয়ায় পিসেমশাই ক্যাম্বিশের খাটের ওপরে শুয়ে তন্দ্রা উপভোগ করছিলেন; অন্য পাশে বৃদ্ধ রামকমল ভট্টাচার্য আফিঙ খেয়ে ধূমপান করেছিলেন থেলো হুকোতে। এমন সময় অকস্মাৎ একটা ‘হুম’ শব্দ শুনে চার পাশ তোলপাড় হয়ে উঠলো। সেই প্রসঙ্গেই শ্রীকান্ত এই কথা বলেছে।

দক্ষ ছিলেন ব্রক্ষ্মার পুত্র। তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা সতীর স্বামী ছিলেন শিব। দক্ষ একবার যজ্ঞ করেন; সেই যজ্ঞে শ্মশানচারী জামাতা শিবকে তিনি নিমন্ত্রণ করেন নি; বরং সতী পিত্রালয়ে গমন করলে তাঁর কাছে শিবের নিন্দা করেন। সেই নিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহত্যাগ করেন সতী। এই শুনে শিব সেখানে যান, এবং তাঁর অনুচরেরা যজ্ঞ ধ্বংস করে দক্ষের কর্তিত মুণ্ডটিকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করে। সেই থেকে যে কোনো বিশৃঙ্খল অবস্থাকেই আমরা দক্ষযজ্ঞ বলি। এখানে ‘হুম’ শব্দ শুনে শ্রীকাত্তের মেজদা, যতীনদা, ছোটদা, পিসেমশাই, দারোয়ান প্রভৃতিরা যে ভয়ে চিৎকার করে বাতি উলটিয়ে একাকার করেছিলেন শ্রীকান্ত তাকেই দক্ষযজ্ঞ বলেছেন।


‘তখন চোরের মুখ দেখিয়া বাড়িসুদ্ধ লোকের মুখ শুকাইয়া গেল।– কোন প্রসঙ্গে ইহা বলা হয়েছে ? ‘চোর’ কাকে বলা হয়েছে?

পিসেমহাশয়ের বাড়ীতে সেই অন্ধকারের মধ্যে যে দক্ষযজ্ঞ শ্রীনাথ বহুরূপীকে কেন্দ্র করে হয়েছিল সে সময় নাকি একটা চোর পালাচ্ছিল। তখন দেউড়ির সিপাহীরা সে চোরকে ধরে ফেলেন। পিসেমহাশয় চোর শুনে হুকুম দিলেন প্রহার করতে। চোরকে মারতে মারতে আধমরা করে যখন আলোর সামনে ফেলে দিল তখন দেখা গেল এতো চোর নয়—এ হচ্ছে বৃদ্ধ রামকমল ভট্টাচার্য। এ দৃশ্য দেখে বাড়িসুদ্ধ সকলেই লজ্জিত হল।


‘সেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার দুই থাবা জোড় করিয়া মানুষের গলায় কাঁদিয়া উঠিল।’—‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’-এর মানুষের গলায় কেঁদে ওঠার রহস্যটি উদ্‌ঘাটন করো।

ছিনাথ বহুরূপী বাঘ সেজে কিছু রোজগার করার ধান্দায় গিয়েছিল শ্রীকান্তের পিসেমশাই এর বাড়িতে। সন্ধ্যায় অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে সে হুম করে একটা লাফ দিয়ে বাইরের ঘরের দাওয়ার ওপরে এসে পড়ে। অকস্মাৎ সেই শব্দে সকলে ভয়ে চিৎকার করে উঠে এবং সকলেই পালাবার জন্য ছুটাছুটি আরম্ভ করলে বাইরের ঘরের আলো নিবে যায়। ছিনাথও ভয় পেয়ে পাশের ডালিম গাছে আশ্রয় নিল। আর এদিকে ঘটনা এগিয়ে গেল দক্ষযজ্ঞের দৃশ্যে। এমন সময় ইন্দ্ৰ এসে সেই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অনুসন্ধানে তন্ন তন্ন করে খোঁজ আরম্ভ করলো। এ দৃশ্য দেখে দোতালার জানালা থেকে মেয়েরা দুর্গানাম জপ আরম্ভ করলেন। ইন্দ্র কিন্তু বেশ করে দেখে বলে উঠলো যে এ বাঘ নয়—। এ কথা শেষ হতে না হতেই ছিনাথ ভয় পেয়ে কেঁদে উঠলো যাতে তার উপর আক্রমণ না হয়। মানুষের গলায় কেঁদে ওঠার রহস্য এটি।


এই হারামজাদা বজ্জাতকে বাস্তে আমার গতর চূর্ণ হো গিয়া। এই কথাটি কে কখন বলেছেন? বক্তার গতর চূর্ণ হয়েছিল কেন?

কথাটি বলেছেন শ্রীকান্ত (১ম পর্ব) উপন্যাসের ভট্টাচার্যিমশাই। ছিনাথ বহুরূপীকে লক্ষ্য ক’রে তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন।

ছিনাথ বহুরূপী বাঘ সেজে কিছু রোজগার করার ধান্দায় গিয়েছিল শ্রীকান্তের পিসেমশাইয়ের বাড়ীতে। সন্ধ্যায় অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে সে হুম করে একটা লাফ দিয়ে পিসেমশাই-এর বাইরের ঘরের দাওয়ার ওপরে এসে পড়ে। অকস্মাৎ সেই শব্দে সকলে ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠে। বাইরের ঘরে আলোটা সেই ঠেলাঠেলির মধ্যে পড়ে নিবে যায়। সেই সুযোগে কে একজন ছুটে পালিয়ে যাচ্ছিল, পলাতককে চোর ভেবে দেউড়ির সেপাইরা তাকে ধরে বেদম প্রহার করে। তারপরে তাকে যখন টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে আসা হল তখন দেখা গেল সে চোর নয়, তাই ভট্টচার্যি মশাই এই কথা বলেছেন।


‘রেখে দাও। তোমার ওটা কাজে লাগবে।’ একথা কে কাকে কোন প্রসঙ্গে বলেছেন?

শ্রাবণ মাসে অন্ধকারময় এক সন্ধ্যায় শ্রীকান্ত, আর তার ভাইয়েরা ছোড়দার কঠোর তত্ত্বাবধানে যখন পড়াশুনার চেষ্টা করছিল এমন সময় ছিনাথ বহুরূপী বাঘের সাজ পরে খেলা দেখানোর উদ্দেশ্যে সেইখানে প্রবেশ করে এবং ‘হুম’ ক’রে একটা শব্দ করে। এই শুনে মেজদা হাত পা খেঁচে বাতি উলটিয়ে গোঁ গোঁ করে মূৰ্চ্ছা যায়। তারপরে পিসেমশাই আর তাঁর দুটি ছেলে তারস্বরে চিৎকার করতে শুরু করে। সেই হট্টগোল শুনে ইন্দ্রনাথ সেইখানে ঢুকে একটা আলো নিয়ে বাঘের সন্ধান করতে গিয়ে আসল লোকটিকে আবিষ্কার করে। ছিনাথ বহুরূপীও এই সব চিৎকারে কেমন যেন ভয়ে পেয়ে গিয়েছিল। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্যে সে সকলের হাত পা ধরে নিজের অপরাধ স্বীকার করতে লাগলো। দেউড়ীর দারোয়ান, পিসেমশাই, ভট্টাচার্য মশাই এর কাছ থেকে ধোলাই খাওয়ার পর পিসেমশাই হুকুম দিলেন তার ল্যাজটা কেটে দেওয়ার। এই শুনে পিসিমা এই ব্যাঙ্গোক্তিটি করেছেন; কারণ বাড়ির সবাই মিলে যা করতে পারলো না কিশোর ইন্দ্রনাথ তাই করেছে।


এই বয়সেই সে যে কত বড় মাঝি, তখন তাহা বুঝি না।—এই কথাটি কে কার সম্বন্ধে বলেছে? এবং কখন বলেছে?

এই কথাটি বলেছে শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথকে লক্ষ্য করে। ইন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীকান্ত গিয়েছিল নদীতে মাছ ধরতে। সুচিভেদ্য অন্ধকার রাত, তার ওপরে নদীর দিগন্তবিস্তৃত তীব্র জলধারা। আশে-পাশে সামনে কোথাও বা জলস্রোতে নিচে ধাক্কা খেয়ে ওপরে উঠছে; আবার কোথাও বা তীব্রগতিতে নেমে যাচ্ছে নিচে। অন্ধকার রাত্রিতে সেই উন্মত্ত নদীর বুকে স্থির লক্ষ্যের দিকে ইন্দ্রনাথ নির্ভয়ে নৌকা বেয়ে চলেছে দেখেই শ্রীকান্ত এই মন্তব্য করেছে।


“ওই লোকটি কি! মানুষ? দেবতা? পিশাচ?’—কার সম্পর্কে একথা বলা হয়েছে? এই উক্তির অর্থ কি?

এই কথাটা শ্রীকান্ত বলেছিল ইন্দ্রনাথকে লক্ষ্য ক’রে। মাছ চুরি করে ফিরে আসার পথে জলমগ্ন ভুট্টা আর জনার ক্ষেতের উপর দিয়ে নৌকা টানতে টানতে ইন্দ্ৰনাথ আর শ্রীকান্ত দুজনেই দেখলো সে জায়গাটি সর্পাকীর্ণ। তবু ইন্দ্ৰনাথ ভয় না পেয়ে সহজভাবে বলেছিলেন ‘যে মরতে তো একদিন হবেই’। এই কথা শুনে শ্রীকান্ত বিস্মিত হয়েছিল। তা ছাড়া, সেই বিপদসঙ্কুল পথে ইন্দ্রনাথ তাকে একবারও নৌকা থেকে নেমে আসতে বলে নি; নিজেই এক কোমর জলে নেমে নৌকা টানছিল। এই সব দেখেই শ্রীকান্ত এই মন্তব্যটি করেছিল। কারণ, জীবন মৃত্যুর সামনে দাড়িয়ে ওই রকম কচি বয়সে কেউ এতবড় স্বার্থত্যাগ করতে পারে না।


‘মরতে একদিন তো হবেই। — এই কথাটি কে কাকে কখন বলেছে? এই উক্তিতে বক্তার চরিত্রের কোন বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে?

একদিন রাত্রিতে শ্রবণের ঘন অন্ধকারে শ্রীকান্তকে সঙ্গে নিয়ে নৌকা ক’রে ইন্দ্রনাথ গিয়েছিল মাছ চুরি করতে। জেলেদের পাতা জালের ভেতর থেকে মাছ চুরি করে তারা যখন সেই তরঙ্গসঙ্কুল নদীর ওপর দিয়ে ফিরে আসছিল সেই সময় ইন্দ্ৰনাথ বুঝতে পারল যে জেলেরা তাদের কারসাজি বুঝতে পেরে নৌকা করে তাদের তাড়া করেছে। এই বুঝতে পেরে ইন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি একটা জলময় চড়ার মধ্যে নৌকাটাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলে। সেখানে আট দশ হাত দীর্ঘ ভুট্টা আর জনার গাছের বন। তারই ভেতর দিয়ে সে জলে নেমে নৌকা টানতে লাগলো। এই সময় জনার আর ভুট্টা গাছের ডাল থেকে ছপাৎ ছপাৎ শব্দে কয়েকটা সাপ জলের মধ্যে লাফিয়ে পড়তে লাগলো। শ্রীকান্তকে ভয়ে আঁতকে উঠতে দেখে, ইন্দ্রনাথ তাকে একথাটা বলেছিল।

 এই উক্তি থেকে ইন্দ্রনাথের সাহস আর বেপরোয়া মনোবৃত্তির পরিচয় আমরা পাই। তাই সে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও এতবড় তত্ত্বজ্ঞানের কথাটা তাই সে অত সহজভাবে বলতে পেরেছিল।


“মানুষের এই কিশোর বয়সটার মন এমন মহাবিস্ময়কর বস্তু বোধ করি সংসারে নাই।”—কোন প্রসঙ্গে এই উক্তি হইয়াছে? সংক্ষেপে কথাটির অর্থ বুঝাইয়া দাও।

মাছ চুরি করার পরে শ্রীকান্তকে নৌকার ওপরে বসিয়ে ইন্দ্রনাথ জেলে পাড়ার উদ্দেশ্যে চলে যাওয়ার সময় তাকে বলেছিল—আমি এক্ষুণি ফিরে আসব—তোর কিছু ভয় নেই।

এই ভয়ের প্রসঙ্গেই শ্রীকান্ত মনে মনে এই মন্তব্যটি করেছিল।

শ্রীকান্তের বক্তব্য এই যে, যে বয়সে সে ইন্দ্রের মাছ চুরির সঙ্গী হয়েছিল মানুষের জীবনে সেই বয়সটা হচ্ছে সবচেয়ে দুঃসাহসী। এটা হচ্ছে কৈশোর। সংসারিক নীতি আর রীতিকে সে তখন গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না। পার্থিব লাভ-লোকসানের খাতিয়ান তখন সে করে না। কিশোর কিশোরীর ভাবনা চিন্তা, আশা-আনন্দ, দুঃখ-বেদনাগুলির জাত আর স্বাদ আলাদা। কে তাদের ভালো বলল, কে মন্দ বলল তা নিয়ে তারা বিন্দুমাত্র ব্যতিব্যস্ত নয়। একটা অনাস্বাদিতকে আস্বাদন করার জন্যে, একটা না পাওয়াকে পাওয়ার জন্যে সে সব সময়েই উদগ্রীব হয়ে থাকে। তাই এই বয়সটিকে শ্রীকান্ত মহাবিস্ময়কর বস্তু হিসাবে চিহ্নিত করেছে।


‘রামনাম করি?’ – একথা কে কাকে কোন প্রসঙ্গে বলেছে? এই উক্তির মধ্যে দিয়ে বক্তার কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে?

রাত্রিতে শ্রীকান্তকে নৌকার ওপরে বসিয়ে রেখে ইন্দ্র জেলে পাড়ায় যাওয়ার সময়ে। তাকে বলে সাবধান করে দিয়েছিল যে কেউ মানুষের মতো, এমন কি তার মতো বেশ ধরে এসে তাকে মাছ চাইলেও সে যেন কিছুতেই তাকে মাছ না দেয়। ইন্দ্রনাথ ফিরে আসার পরে শ্রীকান্ত তাকে জিজ্ঞাসা করলো যারা মাছ চাইতে আসে তাদের সে দেখেছে কিনা। ইন্দ্রনাথ বললে, সে দেখেনি তবে শুনেছে। তার ওই রকম জায়গায় থাকতে ভয় করে কিনা—শ্রীকান্তের এই প্রশ্নের উত্তরে ইন্দ্রনাথ বললো—না ; কারণ সে রামনাম করে। রামনাম করলে ভূতেরা কিছুতেই কাছে ঘেঁষতে পারে না। এই প্রসঙ্গে ইন্দ্ৰনাথ শ্রীকান্তকে এই কথাটি বলেছিল।

এই কথার মধ্যে দিয়ে ইন্দ্রনাথের বিশ্বাসী হৃদয়ের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। অন্ধ সংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাস এই দুটিই ছিল তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।


মড়ার কি জাত থাকে রে?’ – এই কথাটি কে কোন প্রসঙ্গে বলেছে? এই কথার মধ্যে দিয়ে বক্তার চরিত্রের কোন্ বৈশিষ্ট্য শ্রোতার কাছে ধরা পড়েছিল?

চুরি-করা মাছ জেলেদের কাছে বিক্রি করে ইন্দ্রনাথ শ্রীকাত্তকে সঙ্গে নিয়ে নদীপথে যাচ্ছিল অন্নদাদিদির কাছে। বটতলায় যে ঘাটে তাদের নামার কথা তার চারপাশটা ছিল শ্মশান। সেইখানে নামতেই তারা দেখতে পেলো ছয়-সাত বৎসরের হৃষ্টপুষ্ট গৌরবর্ণ সদ্যমৃত বালকের একটি মৃতদেহ। মৃতদেহটি বোধ হয় জলের ওপরে পড়েছিল ; সম্প্রতি শেয়ালের দল সেটিকে টেনে ডাঙায় তুলে এনেছিল। এই দেখে ইন্দ্রনাথের চোখ দুটো জলে ঝাপসা হয়ে গেল। চড়ার ঝাউবনের মধ্যে ফেলে রেখে আসার জন্যে সে সেই মৃতদেহটিকে দুহাতে তুলে নৌকার ওপরে শুইয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিতেই শ্রীকান্ত তাকে বলল—’কি জাতের মড়া তুমি ছোঁবে?’ এরই উত্তরে ইন্দ্রনাথ তাকে এই কথা বলেছিল।

ইন্দ্রনাথের কথা শুনে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল শ্রীকান্ত। ইন্দ্ৰনাথ ছিল অশিক্ষিত; সুতরাং তত্ত্বকথা তার জানা ছিল না ; কথাটা সে ছেলেমানুষের মতোই বলেছিল যে তাদের ডিঙিটার যেমন জাত নেই তেমনি মড়ারও কোনো জাত নেই অর্থাৎ, যে জাতেরই হোক, মারা গেলে সব মানুষ একই জাতের হয়ে যায়। শ্রীকান্ত ভেবেছিল বিশ্বে এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম আছে যারা এই মহা সত্যকে এতটা সহজে বলতে পারে শুধু মুখে বলা নয়, কাজে পরিণত করতে পারে, এবং তা এতটা সাবলীলভাবে। এই দিক থেকে ইন্দ্রনাথের সংস্কারমুক্ত চরিত্রটিই শ্রীকান্তের কাছে প্রকাশ পেয়েছিল সবচেয়ে বেশি।


‘সে ক্রুদ্ধ হইয়া কহিল, যদি পার না তবে সাপ ধরলে কি ক’রে?’—একথা‌ কে কাকে কোন প্রসঙ্গে বলেছে?

একথা ইন্দ্রনাথ বলেছে অন্নদাদিদিকে।

অন্নদাদিদি ছিলেন সাপুড়ে শাহজীর স্ত্রী। সাপ ধরা আর সাপ খেলানোই ছিল শাহজীর কাজ। ইন্দ্রনাথকে সাপ ধরার আর নানারকম মন্ত্রতন্ত্র শেখানোর লোভ দেখিয়ে শাহজী তার কাছ থেকে টাকা পয়সা নিত। ইন্দ্রনাথও বিশ্বাস করতো যে শাহজীর নানা রকম অলৌকিক বিদ্যা জানা আছে। সেদিন শাহজীর ডেরাতে অন্নদাদিদি ঘরের ভেতর থেকে একটা তাজা বন্য সাপকে যে রকম অবলীলাক্রমে বার ক’রে এনে ঝাঁপিতে পুরে দিলেন তাতে ইন্দ্রনাথের স্থির বিশ্বাস হল যে অন্নদাদিদির ঘর-বন্ধন, দেহ-বন্ধন, ধূলো-পড়া, কড়ি-চলা প্রভৃতি অলৌকিক বিদ্যা জানা আছে। তাই ইন্দ্ৰনাথ অন্নদাদিদিকে ধরে বসলো সেই সব তাকে সেদিনই শেখাতে হবে। কত দিন ধরে সে তাদের পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই সব মন্ত্র শেখার জন্যে; কিন্তু শাহজী কেবল আজ নয় কাল, এদিন না সেদিন বলে তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। এই শুনে অন্নদাদিদি বললেন তাঁর ওসব কোনো বিদ্যা জানা নেই। এই শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ইন্দ্রনাথ তাঁকে ওই কথা জিজ্ঞাসা করেছে।


‘জানোয়ারের মতো বসে থাকা হচ্ছে কেন? –একথা কে কাকে কোন্ প্রসঙ্গে বলেছিল? এই উক্তির মধ্যে বক্তার চারিত্রিক কোন্ বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে?

দর্জিপাড়ার নতুনদাকে সঙ্গে নিয়ে নৌকো বেয়ে ইন্দ্রনাথ যাচ্ছিল থিয়েটার দেখতে। সঙ্গে ছিল শ্রীকান্ত। স্রোতের উজান ঠেলে এগোতে তাদের খুবই কষ্ট হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রনাথকে বলতেই হল যে সেই রাত্রিতে কারও সাধ্য নেই যে উজান বেয়ে সে নৌকো এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই শুনে নতুন দা রেগে বললো যেমন করেই হোক তাকে যেতেই হবে। নতুনদার ধমকে ইন্দ্ৰ বেশ বিপদগ্রস্ত হল। ইন্দ্রের অবস্থা দেখে শ্রীকান্তের খুবই মায়া হল। সে প্রস্তাব দিলে গুণ টেনে নৌকাটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা। এই প্রসঙ্গে নতুনদা অভদ্রভাবে শ্রীকান্তকে ওই কথা বলেছিল।

 এই উক্তির মধ্যে দিয়ে নতুনদার নির্দয় চরিত্র ফুটে উঠেছিল।


‘যান, কালকেই বাড়ী চলে যান।—একথা কে কাকে কোন প্রসঙ্গে বলেছিল? এই কথার মধ্যে থেকে বক্তার কী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছিল?

শ্রীকান্ত গিয়েছিল বন্ধু কুমার সাহেবের শিকার পার্টির তাঁবুতে নিমন্ত্রিত হয়ে। সেখানে কুমার সাহেব অনেক টাকা খরচ করে পাটনা থেকে পিয়ারী বাইজীকে নিয়ে এসেছিলেন। মোসাহেবপরিবৃত কুমার সাহেবের তাঁবুতে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে অনুরোধ করা হয় বাইজীকে গান করার জন্যে ফরমাস করতে। গান শেষ হওয়ার পরে বাইজী যখন চলে যাচ্ছিল সেই সময় শ্রীকান্ত বলেছিল—বাইজী, আমার বড় সৌভাগ্য যে, তোমার গান দুসপ্তাহ ধরে প্রত্যহ শুনতে পাব। এই শুনে বাইজী তাকে এই কথা বলেছিল। এই কথার মধ্যে শ্রীকান্তের প্রতি বাইজীর যে মনোভাবটি প্রকাশ পেয়েছিল তা হচ্ছে একটি অকৃত্রিম আন্তরিকতা।


বোধ করি বা যেন কি সব চেহারাও দেখিয়াছিলাম।’—এই কথা কে কোন প্রসঙ্গে বলেছে?

প্রতিবেশিনী বালবিধবা নিরুদিদির মৃত্যুশয্যার পাশে বসে রাত কাটিয়েছিল শ্রীকান্ত। তখন তার বয়স ছিল অল্প। মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে নিরুদিদি বিকারের ঝোঁকে অশরীরী আত্মাদের দেখে ভয়ে বার বার চীৎকার করে তাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। তাঁর সেই চিৎকারে শ্রীকান্তের ভয় হয়েছিল হয়ত বা অশরীরীরা নিরুদিদিকে সত্যই শাসাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে শ্রীকান্ত এই মন্তব্যটি করেছিল।


‘পঞ্চাশ এক টাকায় একজোড়া ভাল রামছাগল পাওয়া যায় না—তা জামাই খুঁজছেন।’ —এই কথাটি কে বলেছে এবং কোন প্রসঙ্গে?

সুরলক্ষ্মী এবং রাজলক্ষ্মী দুই বোন। রাজলক্ষ্মীর বয়স তখন আট ন বছর, সে সময় দু’বোনের বিয়ে দেবার জন্যে তাদের মামা অস্থির হয়ে উঠেছিলেন; কারণ যোগ্য পাত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত হঠাৎ বিরিঞি দত্তের পাচক ব্রাহ্মণের সন্ধান পাওয়া গেল। এই মানুষটি বাঁকুড়া নিবাসী এবং বঙ্গকুলীন। ব্রাহ্মণের জাতিরক্ষার মানসে পাচক ব্রাহ্মণ একশ-এক টাকার বদলে একবার এ পিঁড়িতে একবার ওপিড়িতে বসে দুটি বোনেরই আইবুড়ো নাম একসঙ্গে ঘোচাতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু দরিদ্র মামার একান্নো টাকার বেশি পণ দেওয়ার সাধ্য ছিল না। সেই শুনে পাচক ব্রাহ্মণ এই কথাটি বলেছিল।


‘রাজলক্ষ্মী কাশীতে মরিয়া শিবত্ব লাভ করিল।’—কথাটির তাৎপর্য লেখ।

সত্তর টাকায় রফা হয়ে একরাত্রে একসঙ্গে সুরলক্ষ্মী ও রাজলক্ষ্মীর বিবাহ হল। দিন দুই পরে সেই কুলীন জামাই প্রস্থান করলেন। বছর দেড় পরে স্বামী পরিত্যক্তা সুরলক্ষ্মী প্লীহাজ্বরে মারা গেল। আর বাল্যে স্বামী পরিত্যক্তা রাজলক্ষ্মী মায়ের সাথে কাশী যাত্রা করেছিল। তারপর ফিরে এসে মা জানিয়েছিল যে কলেরায় রাজলক্ষ্মীর মৃত্যু হয়। আসল ঘটনা হচ্ছে ঘটনাচক্রে রাজলক্ষ্মী পিয়ারী বাইজীতে পরিণত হয়েছিল।

শরৎচন্দ্র এই কাহিনিটি বর্ণনা করেছেন নেহাৎ ব্যঙ্গচ্ছলে। কিন্তু এর ভিতর তদানিন্তন হিন্দু বিবাহ পদ্ধতির একটি ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পেয়েছিল। ফলে হিন্দু বালিকাদের নির্মম অবিচার আর অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে। এ অবস্থাকেই তিনি ব্যঙ্গচ্ছলে ‘শিবত্ব লাভ’ বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ কাশীতে মৃত্যু হলে শিবত্ব বা মুক্তি লাভ করে।


মহাশ্মশানে সূচীভেদ্য অন্ধকারের রূপ দেখে শ্রীকান্তের চিত্তে কোন উপলব্ধি জন্মেছিল?

মহাশ্মশানের যেই সূচীভেদ্য অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভয়ঙ্কর রূপের যবনিকা ধীরে ধীরে অপসারিত হয়ে শ্রীকান্তের চোখে প্রতিভাত হল একটি অপরূপ সৌন্দর্যের উপলব্ধি। তার মতে অন্ধকারই তো এ বিশ্বের আসল রূপ — বিপুল তমসার শাস্ত সৌন্দর্যের একটি রহস্যময় অব্যক্ত শক্তি তার চেতনার মর্মস্থলে প্রবেশ করে বুঝিয়ে দিল—সে আধার শুধু বিশাল নয়। তার আদিও নেই—অস্তও নেই। তিনি বুঝতে পারলেন এ বিশ্বের যে যত গভীর সে তত অন্ধকার।


‘ছোট বাঘিয়া’ গ্রামে যে বাঙ্গালী ভদ্রলোকটির সহিত শ্রীকান্তের পরিচয় হইয়াছিল তাহাকে শ্রীকান্ত মহাপ্রাণ বলিয়াছেন কেন?

ছোটো বাঘিয়ার একটি বাঙালী ভদ্রলোকের সঙ্গে শ্রীকান্তের সামান্য কয়েকদিনের জন্যে পরিচয় হয়েছিল। আসল নামটা গোপন করে শ্রীকান্ত তাঁর নাম দিয়েছেন রামবাবু। ছোটো বাঘিয়ায় রামবাবুর ছেলেরা বসস্তে আক্রান্ত হলে সস্ত্রীক রামবাবুর অনুরোধে সেবাশুশ্রুষা করে তাদের সারিয়ে তুলে শ্রীকান্ত নিজে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু সেই রামবাবু তাঁকে অসুস্থ অবস্থায় একা ফেলে রেখে রাত্রিতে সপরিবারে গ্রাম ছেড়ে চলে যান। এর অনেক দিন পরে তাঁর সঙ্গে শ্রীকান্তের দেখা হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে চিনেও চিনতে পারেন নি। এই জন্যেই ব্যঙ্গ করে শ্রীকান্ত রামবাবুকে ‘মহাপ্রাণ’ বলেছেন।


‘কে আমাকে এক মহাশ্মশান থেকে আর এক মহাশ্মশানের পথ দেখাইয়া পৌঁছিয়া দিয়া গেল।—কোন মহাশ্মশান দুটির কথা বলা হয়েছে?

সন্ধ্যার অন্ধকারে শ্রীকান্ত যে শূন্য দীঘির ঘাটে পা ঝুলিয়ে বসেছিল তারও চারপাশে একদিন অনেক মানুষ বাস করতো, হাসতো, খেলতো, ঘরসংসার করতো; কিন্তু তারপরে একদিন কোনো মহামারিতে সেই গ্রাম উজাড় হয়ে শূন্য হয়ে গেল। পরিত্যক্ত গৃহের চিহ্ন চারপাশে দেখা যাচ্ছিল। সে-ও একটি মহাশ্মশান। সেই স্থান থেকে একটি অদৃশ্য পদশব্দ তাকে ডেকে নিয়ে পৌঁছিয়ে দিল অসংখ্য নরকঙ্কালে পূর্ণ একেবারে সেই মহাশ্মশানে। দীঘির চারপাশে ঘিরে যে মহাশ্মশান সেখানে মৃত ব্যক্তিদের আত্মাগুলি ঘুরে বেড়াচ্ছিল; দ্বিতীয় মহাশ্মশানে ছড়িয়ে ছিল। অসংখ্য মৃত মানুষের দেহাস্থি।


‘কিন্তু যে মিথ্যা কুৎসার রটনা হবে তার দাম ত কম নয়।’—এই কথাটি কে কাকে কোন্ প্রসঙ্গে বলেছে? কীসের কুৎসা?

কুমার সাহেবের শিকার পার্টিতে থাকার সময় শ্রীকান্ত দ্বিতীয়বার মহাশ্মশানে গিয়েছিল। এবারে সে স্বেচ্ছায় যায় নি, তার মনে হয়েছিল সন্ধ্যায় অন্ধকারে কে যেন তাকে ডেকে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছিল মহাশ্মশানের ঠিক মাঝখানটিতে। সারারাত সেখানে সে চুপচাপ বসেছিল। ভোরের‌ আধো অন্ধকারে সে পথের পাশে এসে দাঁড়ালো বুঝতে পারলো পিয়ারী বাইজী দলবল নিয়ে গো-শকটে স্টেশনের দিকে যাচ্ছে। রতনের ডাকে শ্রীকান্ত শকটের কাছে যেতেই পিয়ারী তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে সেখানে থেকে চলে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ জানালো। এই প্রসঙ্গেই শ্রীকান্ত পিয়ারীকে এই কথা বলেছে। শ্রীকান্ত যদি তাঁবুতে না ফিরে সোজা সেখান থেকেই চলে যায় তাহলে কুমার সাহেব এবং তাঁর লোকেরা ভাববে যে একজন বাইজীর সঙ্গে শ্রীকান্ত পালিয়ে গিয়েছে। এটাকেই শ্রীকান্ত কুৎসা‌ বলছে।


‘সন্ন্যাসীদাদা, তুমি ত সত্যিই সন্ন্যাসী নও’—একথাটি কে কাকে কোন প্রসঙ্গে বলেছে?

সন্ন্যাসীর বেশে শ্রীকান্ত যখন ছোটো বাঘিয়া গ্রামে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেই সময় তার সঙ্গে রামবাবু নামে [ ভদ্রলোকের আসল নাম আমরা জানি নে ] একজন বাঙালি ভদ্রলোকের পরিচয় হয়েছিল। এই সময় ছোটো বাঘিয়াতে বসস্তের মড়ক শুরু হয়। রামবাবুর বড়ো ছেলেটি চার দিন ধরে ভুগে বসন্তে আক্রান্ত হয়েছিল। ছোটো ছেলেটিও জ্বরে অচৈতন্য। সেখানে বাঙালি বলতে কাউকে না পেয়ে রামবাবুর স্ত্রী শ্রীকাত্তকে এই কথা বলেছিল তার সাহায্য পাওয়ার জন্যে।


‘এই বিঠৌরা গ্রামের নামটা কেন আমার মনে আছে।’— ‘বিঠৌরা’ গ্রামের নামটি শ্রীকান্ত কেন দীর্ঘকাল মনে রেখেছিল? সেখানে কী ব্যাপারে শ্রীকান্তের মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে?

বিঠৌরা গ্রামের নামটা শ্রীকান্তের মনে ছিল গৌরী তেওয়ারীর দশ-এগারো বছরের মেয়ের বিষাদক্লিষ্ট, অশ্রুঝরোঝরো চোখ দুটির জন্যে।

গৌরী তেওয়ারীর বাড়ী বর্ধমান জেলার রাজপুরে। সেখানে স্ব-ঘর পাওয়া যায় না বলে সে তার দুটি নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল অ-ভাষাভাষী বিহারী ঘরে সুদূর বিহারের বিঠৌরা গ্রামে। সেখানে শ্বশুর বাড়ির অত্যাচারের জ্বালায় তার বড় মেয়ে আত্মহত্যা করেছিল; ছোটো মেয়েটিও সেই পথে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত। এর জন্যে দায়ী হচ্ছে হিন্দুদের জাতিভেদ প্রথা। সেদিন শরৎচন্দ্রের মনে হয়েছিল এই জাতিভেদের কট্টর প্রথাটাই হিন্দুমেয়েদের জীবন নষ্ট করে দিয়েছে।