‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের শুরু কথক শ্রীকান্তের এই মন্তব্যে “আমার এই ভবঘুরে জীবনের অপরাহ্নবেলায় দাঁড়াইয়া ইহার একটি অধ্যায় বলিতে বসিয়া আজ কত কথাই না মনে পড়িতেছে।” স্পষ্টতই বােঝা যায় কথক শ্রীকান্ত তার বিক্ষিপ্ত গতিময় জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও উপলদ্ধিকে সজ্জিত করেছে এই উপন্যাসে। আলােচ্য উপন্যাসে অতীতের কথা রােমন্থন করতে গিয়ে শ্রীকান্ত হৃদয়বৃত্তি ও মজ্জাগত সংস্কারের দ্বন্দ্বে চরিত্রগুলাের আত্মানুভবের বিভিন্ন স্তর আশ্চর্য কুশলতার সঙ্গে বিবৃত করেছেন। সমাজের দৃষ্টিতে পতিত ও পাপীরূপে চিহ্নিত মানুষের মধ্যেও মনুষ্যত্বের মহিমা আবিষ্কার করেছেন তিনি। এটা অবশ্যই শ্রীকান্তের চরিত্রের একটা দিক। শ্রীকান্ত যে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের দাবী রাখে সে প্রসঙ্গে আলােচনার ক্ষেত্র এটি নয়, তবে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে শরৎচন্দ্র তাঁর বিভিন্ন বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পর্কেই বলেছিলেন যে ত্রুটি বিচ্যুতি-অপরাধ অধর্মই মানুষের সবকিছু নয়। বস্তুত এ উপন্যাসের কথক শ্রীকান্ত এভাবেই অনুভব করেছে বিভিন্ন ঘটনা বা চরিত্রকে। অর্থাৎ তার বিক্ষিপ্ত জীবনের আপাত হতচ্ছাড়া পরিচয়ের মধ্যেও রয়েছে সহানুভূতির স্বাভাবিক স্পর্শ। বিক্ষিপ্ত গতিময়- জীবনসুলভ কবিত্ব শ্রীকান্তের মধ্যেও পাওয়া যায়, তবে সেইসঙ্গে বহুক্ষেত্রেই যুক্ত হয়েছে। মননসমৃদ্ধ যুক্তিবুদ্ধি। ইন্দ্রনাথের সঙ্গে নিশীথ অভিযানের বর্ণনায় বা শ্মশানে তার অভিজ্ঞতার বর্ণনায় শ্রীকান্তের কবিত্ব শক্তির দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ভুরি ভুরি। (এ আলােচনায় প্রকৃতি চিত্রণ অংশে আছে)। তবে সেইসঙ্গে বেশকিছু মননশীলতারও সমন্বয় ঘটেছে। যেমন শ্মশান দৃশ্যের ভয়ানক পরিস্থিতিতে যে কান্নার সুর ভেসে এসেছে তা যে আসলে শকুন শিশুর কান্না তাও পাঠককে বুঝিয়ে দেয় শ্রীকান্ত। আবার দীর্ঘশ্বাসের যে শব্দ তাও যে মড়ার মাথার খুলির ভিতর বাতাস যাওয়ার ফলেই সৃষ্ট তাও জানিয়ে দেয়- “ক্রমশ ধীরে ধীরে বেশ একটু জোরে হাওয়া উঠিল। অনেকেই হয়ত জানে না যে মড়ার মাথার ভিতর দিয়া বাতাস বহিলে ঠিক দীর্ঘশ্বাস ফেলা গােছের শব্দ হয়?”
শ্রীকান্ত চরিত্র সম্পর্কে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হল জীবনের ক্ষুদ্রতুচ্ছ মুহূর্তগুলােকেও তিনি উপলব্ধি করেছেন বৃহত্তর প্রেক্ষিতে যার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসা তার সঠিক জীবনদর্শন। জীবনের অপরাহ্ন বেলায় লিখতে বসে সে সবিস্ময়ে লক্ষ্য করেছে। কত এলােমেলাে ঘটনা মনের মধ্যে পরিপাটি করে সাজিয়ে দিয়েছেন কোনাে এক ‘জীবন দেবতা’। চিন্তা শিকলের সমস্ত গ্রন্থিই যে বজায় আছে তাও নয়, অনেকে গ্রন্থি ক্ষয়ে গেছে কিন্তু শিকল ছিন্ন হয়নি। আর কাহিনি কথক হিসাবে শ্রীকান্ত চরিত্রটি কখনই কম গুরুত্ব দেয়নি সেই ক্ষয়ে যাওয়া গ্রন্থিটিকে। পরিমাণগত দিক থেকে সব ঘটনা বা চরিত্রের বর্ণনা হয়ত সমান নয় ; কিন্তু ছােটো ছােটো ঘটনা বা চরিত্রের মধ্য থেকে অনেকসময়ই প্রকাশিত হয়েছে ব্যপক অভিজ্ঞতা। যেমন নতুন দাদার বর্ণনা প্রসঙ্গে হাসির ফোয়ারার মধ্যেও কথক বলতে ভােলেনি যে নতুনদার মতাে স্বার্থপর চরিত্র সে জীবনে কখনােই দেখেনি। বস্তুত টিপিক্যাল কিছু শহরে স্বার্থপর চরিত্র সম্পর্কে তার ধারণা খুব সহজেই প্রকাশ হয়ে যায় এই কথায়, ঠিক তেমন খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে নিরুদিদির বর্ণনা দেওয়ার পর তার বক্তব্য-
“সুতরাং সে পাড়ার মধ্যে এমন একটি লােকও বােধকরি ছিল না, যে-কোনাে-না কোনাে প্রকারে নিরুদিদির সযত্নসেবা উপভােগ করে নাই, সেই পাড়ারই এক প্রান্তে অন্তিম শয্যা পাতিয়া এই দুর্ভাগিনী ঘৃণায় লজ্জায়, নিঃশব্দে নতমুখে একাকিনী দিনের পর দিন ধরিয়া এই ছয়মাস কাল বিনা চিকিৎসায় তাহার পদস্থলনের প্রায়শ্চিত্ত সমাধা করিয়া শ্রাবণের এক গভীর রাত্রে ইহকাল ত্যাগ করিয়া যেলােকে চলিয়া গেলেন তাহার অভ্রান্ত বিবরণ যে-কোনাে স্মার্ত ভট্টাচার্যকে জিজ্ঞাসা করিলেই জানা যাইতে পারিত।” আবার ঘটনার দিক থেকে শ্রীকান্তের জীবনের খুব সাধারণ ঘটনাই বলা যায় কুমার সাহেবের আমন্ত্রণ শিকার পার্টিতে যােগ দেওয়া। কিন্তু এখানে এসেই তার সাথে আলাপ হয় বাল্যসঙ্গিনী রাজলক্ষ্মীর। আর রাজলক্ষ্মীর শ্রীকান্তর এই পরিচয় শুধু ক্ষণকালীন আনন্দ বিহুলতার কথা নয়, তার শুরু করেছে শ্রীকান্তের জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের। স্বাভাবিকভাবেই ওই শিকার পার্টির কথাও গুরুত্ব পেয়েছে এই উপন্যাসে।
অন্নদাদিদির চরিত্রে শ্রীকান্ত এমনকিছু প্রত্যক্ষ করেছিল যা তার জীবনকে নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল। অন্নদাদিদির সংস্পর্শে এসে শ্রীকান্ত জীবন সম্পর্কে নতুন দৃষ্টি লাভ করেছে, নারী চরিত্রকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার শিক্ষা পেয়েছে। নারীর পদস্বলনে ও শ্রীকান্তের অন্তরের চিরলালিত চিরন্তন নারীত্বের মহিমা এতটুকু ও ম্লান হয় না। এটা কিছুটা সংস্কার বলা যায় যে সংস্কারের মূল আছে অন্নদাদিদি। অন্নদাদিদির যে সমস্ত গুণগুলি শ্রীকান্তকে মুগ্ধ করেছিল তা হল তার নিষ্ঠা ও সত্যপ্রিয়তা। স্বামীর প্রতি একান্ত নিষ্ঠাবশতঃ তিনি তার পিতৃগৃহের আরামের জীবন ছেড়ে এক ছন্নছাড়া সাপুড়ের সঙ্গী হয়েছিলেন। অন্নদাদিদির জীবনে কোনাে প্রেরণা ছিল না। যে স্বামীর জন্য তার জীবনে এত দুঃখ সে স্বামীর এমন কোনাে গুণ ছিল না যা নিয়ে অন্নদাদিদি গর্ব বােধ করতে পারতেন। পতির প্রতি আনুগত্যই তাঁর একমাত্র ধর্ম। অর্থাৎ সনাতন ভারতবর্ষীয় মহিলার ঐতিহ্যঅনুসৃত শ্রীকান্ত যেভাবে দেখেছিল অন্নদাদিদির মধ্যে তা নারী সম্পর্কে এক বিশেষ জীবনবােধ তৈরি করেছিল শ্রীকান্তের মধ্যে। কিশাের বয়সেই যে মানুষের চরিত্র গঠন হয় এবং জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভেদী স্থিতিলাভ করে একথা আধুনিক মনােবিজ্ঞান সম্মত। তাই কিশাের বয়সে অন্নদাদিদির প্রভাব শ্রীকান্ত চরিত্রে গঠনাত্মক ভূমিকা নিয়েছে যার স্থিতি আমরা লক্ষ্য করি পরবর্তী তিন খণ্ডেও।
শ্রীকান্তের কিশাের বয়সে আর যে চরিত্রটি তার ওপর প্রভাব ফেলেছিল, তার চরিত্রকে বিকশিত হতে সাহায্য করেছিল সে হল ইন্দ্রনাথ। গ্রন্থের শুরুতেই ইন্দ্রনাথ সম্পর্কে শ্রীকান্তের মন্তব্য-
“আমাদের প্রথম আলাপ একটি ফুটবল মাঠে। আজ সে বাঁচিয়া আছে কিনা জানি না-কারণ বহুবৎসর পূর্বে একদিন অতিপ্রত্যুষে ঘরবাড়ি, আত্মীয়-স্বজন সমস্ত ত্যাগ করিয়া সেই যে এক বস্ত্রে সে সংসার ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল আর কখনাে ফিরিয়া আসিল না।’
অর্থাৎ এই উপন্যাসে শ্রীকান্তের যে মূল পরিচিতি ভবঘুরে হিসেবে, তার জীবনের শৈশব অবস্থাতেই ইন্দ্রনাথের সংস্পর্শে তার এই ভবঘুরে পরিণতির জন্য অনেকাংশে দায়ী বলা যায়। ইন্দ্রনাথের কাছ থেকে শ্রীকান্ত সােনারূপাতে মােড়া জীবনের অধিকারী হয়েও ভাবের আদর্শ গ্রহণ করেছিল। এই সর্বরিক্তৃতার আদর্শ আসলে এক ধরনের রােমান্টিক মানসিকতা যা জীবনের সুলভ সুখ আর আনন্দ পেয়েই পরিতৃপ্ত নয়। জীবনের কোনাে মহত্তর প্রাপ্তি কোথায় লুকিয়ে আছে তারই সন্ধানে অন্যতম হয় এই মানসিকতা। শ্রীকান্তের এই মানসিকতাই চার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ফলে সারাজীবনব্যাপী যে সমস্ত মহত্তম প্রাপ্তি ঘটেছে তার জীবনে তাই- সংকলিত হয়েছে এ উপন্যাসে।
কিন্তু শ্রীকান্ত চরিত্রটি তার জীবনের সমস্ত ক্ষুদ্র তুচ্ছ বা মহত্তম সমস্ত অভিজ্ঞতার কথা যে লিখতে বসেছে জীবনের অপরাহ্ন বেলায় সে স্বীকারােক্তি উপন্যাসের শুরুতেই পাওয়া যায়। এই স্মৃতিচারণার একটি অসুবিধার দিক হল এই যে, যেমনভাবে প্রথম যৌবনে বিভিন্ন মানুষজনকে দেখা যায় পৌঢ় বয়সে তার ওপর নেমে আসে অপরাহ্নের দীপ্তি। জটিলতা সমৃদ্ধ মন হয়ে ওঠে বিশ্লেষণাত্মক। সেই কিশােরের আবেগ নিয়ে দেখা ততটা পরিপূর্ণভাবে ফোটানাে যায় না। কিন্তু কাহিনি কথক হিসাবে শ্রীকান্ত কৈশাের ও যৌবনের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গীকে যথাযথই ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে। তাই কমবয়সে দেখা ইন্দ্রনাথ সম্পর্কে যতটা ভাবাবেগে আপ্লুত রাজলক্ষ্মী সম্পর্কে ততটা নয়। তাই ইন্দ্রনাথ সম্পর্কে তার ধারণা-
“ওই লােকটি কি! মানুষ? দেবতা? পিশাচ? কেও? কার সঙ্গে এই বনের মধ্যে ঘুরিতেছি? বুকখানা কি পাথর দিয়া তৈরি? সেটা কি আমাদের মতাে সঙ্কুচিত বিস্ফারিত হয় না?” এখানে অবশ্যই আবেগের প্রাধান্য। আবার শেষ পরিচ্ছেদে রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্তের গভীরতর অন্তরঙ্গতা সত্ত্বেও তারা অবাধ হতে পারেনি। বরং চলে যাওয়ার সময় শ্রীকান্ত অনুভব করেছে- “বড়াে প্রেম শুধু কাছে টানে না—দূরে ও ঠেলিয়া ফেলে।” অর্থাৎ কথক চরিত্র হিসাবে শ্রীকান্ত চরিত্রের মধ্যে বয়সােচিত সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়েছে।
Leave a comment