শরৎচন্দ্র বুঝেছিলেন, হাত দুটো থাকলেই শুধু লেখা যায় না এবং গাড়ি পাল্কী লােক লস্কর নিয়ে বেড়ানাের নাম ভ্রমণ হতে পারে না, তাকে নিয়ে ভ্রমণ সাহিত্যে রচনা করা যায় না। কাজেই প্রমাণ দিতে তাঁর ভবঘুরে জীবনের অভিজ্ঞতার সঞ্চয়টুকু উজাড় করে দিতেই হল। সংকোচ ভীরু মন নিয়ে ‘শ্রী শ্রীকান্ত শর্মা’-কে পাঠকের সামনে এনে হাজির করালেন সৃষ্টি হল শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনি। প্রথমে তিনি ভাবতে পারেননি ভারতবর্য পত্রিকা তাঁর ওই লেখা ছাপাবে, কিন্তু পরে যখন দেখলেন সত্যই ছাপা শুরু হয়েছে, তখন কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চিঠি লিখলেন হরিদাস চট্টোপাধ্যায়কে- “শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনি যে সত্যিই ভারতবর্ষে ছাপবার যােগ্য আমি তাহা মনে করি নাই-এখনও করি না…..।” এ থেকে বােঝা যায় শরৎচন্দ্র তাঁর শ্রীকান্তকে ঠিক উপন্যাস হিসাবে দাঁড় করাতে চাননি। ছেলেবেলায় দেবানন্দপুরে, ভাগলপুরে, এবং উত্তরকালে রেঙ্গুনে তিনি যে গভীর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন, যে ভ্রমণের স্মৃতি তাঁকে অহরহ মাতাল করে রাখততাকে প্রকাশ করার জন্য কথাকোবিদ ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। প্রকাশের আত্যন্তিক তাগিদেই শ্রীকান্তের সৃষ্টি, অতএব ভ্রমণ সাহিত্য হিসেবেই শ্রীকান্তের বিচার হওয়া আবশ্যক।

মূলত ভ্রমণ সাহিত্যের সঙ্গে উপন্যাসের পার্থক্য বিস্তর। যে যে বৈশিষ্ট্যের সাহচর্যে একটা সাহিত্য ভ্রমণ-সাহিত্যরূপে পরিগণিত হয় তা কিন্তু ‘শ্রীকান্ত’-এর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। আসলে ভবঘুরে শ্রীকান্তের জীবন অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করার দিকেই শরৎচন্দ্রের ঝোক ছিল ; তার জন্য ভ্রমণ কাহিনি উপন্যাস যে কোনাে একটা স্বীকৃত মাধ্যমই ছিল যথেষ্ট। সুতরাং ভ্রমণ কাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ করাকেই শরৎচন্দ্র শ্রেয় বলে মনে করলেন। উপন্যাসের শুরুতেই ভ্রাম্যমান জীবনের কাহিনি বলবেন—এই প্রতিশ্রুতি লেখক দিয়েছেন। অন্যান্য উপন্যাসের মতাে শ্রীকান্তের শরৎচন্দ্র কোনাে প্লট সংক্রান্ত চিন্তা ভাবনাই করেননি। এখানে কাহিনিগুলাে তাই খাপছাড়া, চরিত্র সংখ্যা বহু, স্থান কালের কোনাে ঐক্য নেই। উপন্যাসের অধ্যায় বিভাগ তেমন চোখে পড়ে না। মূলকাহিনি এবং উপকাহিনির কোনাে পার্থক্য নেই ও উপন্যাসে, অর্থাৎ যে-কোনাে কাহিনিই মূল কাহিনির দাবী করতে পারে।

পথ চলতে যার অফুরন্ত আনন্দ, সেই শ্রীকান্ত মাঝে মাঝে তার বিচরণশীল মনকে স্তব্ধ করে প্রকৃতির রহস্য বা ঐশ্বর্যটুকু আহরণ করে পাঠককে উপহার দিয়েছে যথেচ্ছভাবে। যেমন- “অস্তগামী সূর্যের তির্যক রশ্মিচ্ছটা ধীরে ধীরে নামিয়া আসিয়া দীঘির কালাে জলে সােনা মাখাইয়া দিল—আমি চাহিয়া বসিয়া রহিলাম। তারপর ক্রমশঃ সূৰ্য্য ডুবিয়া দীঘির কালাে জল আরও কালাে হইয়া উঠিল ; অদূরে বন হইতে বাহির হইয়া দুই একটা পিপাসার্ত শৃগাল ভয়ে ভয়ে জলপান করিয়া সরিয়া গেল। আমার যে উঠিবার সময় হইয়াছে….।” এই ভ্রমণ রস রসিক মুক্তিকামী শ্রীকান্তের জীবনে বন্ধন আসে না এমন কথা জোর করে বলা যায় না, কারণ, মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে যাওয়া রাজলক্ষ্মীর স্মৃতি তাকে ব্যাকুল করে তােলে। সুতরাং এক পুণ্য দোল পূর্ণিমার পরের দিনেই পিয়ারীকে মনে পড়ায় শ্রীকান্তকে পাটনার নিকট টিকিট কেটে ট্রেনে চড়ে বসতে হয় উদ্দেশ্যে রাজলক্ষ্মীর সাক্ষাৎ।

কিন্তু পাটনাতে যাওয়া তার হয়নি। পয়সার অভাবে মাঝপথেই নেমে তাকে গ্রহণ করতে দেখা গেছে সন্ন্যাসী জীবন। অর্থাৎ শ্রীকান্ত উপন্যাসে একটি ভবঘুরে মানুষের ভ্ৰমণেতিহাসই লেখা হয়েছে, অন্তঃত তার পথ পরিক্রমা দেখেই তা মনে হয়, সুতরাং বলা চলে শ্রীকান্ত উপন্যাস নয়, ভ্রমণ কাহিনি। তবে এই বক্তব্যই যথার্থ নয়, কারণ একটি উপন্যাসের কয়েকটি লাইনকে জোর করে প্রাধান্য দান করে কোনাে সিদ্ধান্তে উপস্থিত হওয়া উচিত নয়। মনে রাখা আবশ্যক শরৎচন্দ্র যখন ভারতবর্ষ পত্রিকায় শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনি পরপর কয়েকটি সংখ্যায় প্রকাশ করেন, তখনই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি যা শিখেছিলেন, তা ভ্রমণ কাহিনি নয়, উপন্যাস, সুতরাং ভ্রমণ কাহিনি বাদ দিয়ে নামকরণ করলেন—’শ্রীকান্ত’। এই সঙ্গে সঙ্গে তাই ছদ্মনাম উঠে গিয়ে দাঁড়াল-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

অন্যদিকে শ্রীকান্ত উপন্যাসে ভ্রমণ কাহিনির মতাে নির্দিষ্ট কোনাে প্লট নেই—একথা বলা চলে না। সমগ্র উপন্যাসটি একটি মানুষের গভীর জীবন দর্শনকেই ব্যক্ত করেছে। শ্রীকান্তের আপন সংসারের মধ্যে থেকেই ভবঘুরে জীবনে হাতেখড়ি হয়েছিল। কিন্তু ইন্দ্রনাথের কাছে সেই দীক্ষা হল, সম্পূর্ণ ; অন্নদা দিদির কাছে শ্রীকান্ত পেয়েছে ত্যাগের আদর্শ, তপস্যার আদর্শ। সে দেখেছে স্বার্থশূন্য গ্রামীণ নিরুদিদিকে ; এর পরের জীবনে দেখা হয়েছে রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে। রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর শ্রীকান্ত আরও বড়াে জীবনের সন্ধান পেয়েছে। বড়াে প্রেম তাকে ঠেলে কর্তব্যের দিকে। মােটামুটি এটাই হল শ্রীকান্তের প্লট।

ভ্রমণ কাহিনি লিখতে বসে জাত ঔপন্যাসিক নিজের অলক্ষ্যে যখন উপন্যাস সৃষ্টি করে ফেললেন, তখন আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলে উঠলেন- “লিখিতে বসিয়া আমি অনেক সময় আশ্চর্য হইয়া ভাবি, এইসব এলােমেলাে ঘটনা আমার মনের মধ্যে এমন পরিপাটিভাবে সাজাইয়া রাখিয়াছির। কে? যেমন করিয়া বলি, তেমনি করিয়া তাে তাহারা একটির পর একটি শৃঙ্খলিত হইয়া ঘটে নাই।” লেখকের এই স্বীকৃতির পর বােধ করি আর উল্লেখ করতে হবে না যে, শ্রীকান্তের কাহিনি এলােমেলাে বা বিক্ষিপ্ত নয়। আপাত দৃষ্টিতে শিথিল সংবদ্ধ মনে হলেও ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটি সামগ্রিক জীবন দৃষ্টির বাণীবহ।’

সর্বোপরি, শ্রীকান্ত উপন্যাসটি ভ্রমণ কাহিনির মতাে গতিশীল নয়। লেখক যখন ইন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেন তখন সবটুকু বলা না হলেও সন্তুষ্ট হন না, আবার অন্নদাদিদির প্রসঙ্গ এলে ইন্দ্রনাথের কথা অনায়াসে ভুলিয়ে দেন। অন্যদিকে উপন্যাসের ফলশ্রুতিতে ইন্দ্রনাথও নেই, অন্নদাদিদিও নেই, আছে রাজলক্ষ্মী, এইভাবে ধীরে ধীরে চরিত্রের মালা গেঁথে উঠেছে শ্রীকান্ত। সুতরাং শ্রীকান্তের উপজীব্য মানব জীবন, মানব রহস্য, কোনাে স্থানিক সৌন্দর্য বা বস্তুর রহস্য উন্মােচন করা নয়। তাই শ্রীকান্তকে ভ্রমণ-কাহিনি বা ভ্রাম্যমান দিনপঞ্জিকা বলে ক্ষান্ত না থেকে রসবােধের বিচারে শ্রীকান্তকে উপন্যাসরূপে স্বীকৃতি জানানােই শ্রেয়। বােধ করি, এখানেই শ্রীকান্ত উপন্যাসের নামকরণের সাথর্কতা নিহিত।