মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে যে-কোনাে হাসির উৎস অসামঞ্জস্য বা অসংগত হলেও গভীরতা বা প্রকৃতি অনুযায়ী হাস্যরসের বিভিন্ন শ্রেণি নির্দেশিত হয়েছে। তবে বুদ্ধিদীপ্ত বাকচাতুর্য এবং পরিহাস মার্জিত ব্যঙ্গ বিদ্রুপ এই দুয়ের আধিক্য লক্ষ্য করা যায় যেমন চরিত্র সৃষ্টি তেমনি পরিস্থিতির বৃপাংকনে। আলােচ্য উপন্যাসের চারটি খণ্ডেই নানা ঘটনা ও নানা চরিত্রের মাধ্যমে শরৎচন্দ্র হাস্যরসের পরিচয় দিয়েছেন। প্রথম খণ্ডের প্রথমেই শ্রীকান্ত এবং তার গম্ভীর স্বভাব ও বার দুই এট্রান্স ফেল মেজদার পাঠাভ্যাসের যে বিবরণ আমরা পাই তাতে যথার্থই হাসির উদ্রেক করে এবং এই পাঠাভ্যাসের বর্ণনার পর লেখকের বক্তব্য “মেজদার দুভার্গে তাঁহার নির্বোধ পরীক্ষকগুলাে তাঁহাকে কোনােদিন চিনিতেই পরিল না। নিজের এবং পরের বিদ্যাশিক্ষার প্রতি অনুরাগ, সময়ের মূল্য সম্বন্ধে সূক্ষ্ম দায়িত্ববােধ থাকা সত্ত্বেও তাঁহাকে বারম্বার ফেল করিয়াই দিতে লাগিল, ইহাই অদৃষ্টের অন্ধবিচার।”

লক্ষণীয়, এখানে লেখকের বিদগ্ধ বাকভঙ্গিতে যে ‘ঈষৎ ব্যঙ্গের আভাস, মূলত তা হাসির উদ্রেক করে। তবে মেজদা চরিত্রের যে গভীর মনস্তত্ত্ব এখানে ধরা পড়ে তা আবার কিছুটা সহানুভূতিপ্রবণ কৌতুকতার নামান্তর। কেননা চরিত্রটির ওপর অদ্ভুত এক মমত্ব ও সহানুভূতি সৃষ্টি হয়, কিছুক্ষণ বাদে এই পড়াশুনার আসরে শ্রীনাথ বহুরূপীর বেঙ্গল টাইগার রূপে আবির্ভাবে যে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতেও হাসির হুল্লোড় পড়ে যায় এবং উল্লেখ করার বিষয় যে এই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অন্যান্য ছােটো- ছােটো যেসব চরিত্রের কথা পাওয়া যায় তাদের আচরণ ও কথাবার্তা এই হাস্যরসের ক্ষেত্রে গা ভাসিয়েছে। কেননা বাঘরূপী শ্রীনাথকে দেখে হত চৈতন্য মেজদার চৈতন্য ফিরলে সে যেমন বলে ‘দি রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ তেমনি পিশেমশাইও ভয়ার্ত চিৎকারে যেন ছেলেদের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় নামেন। আবার ইন্দ্রনাথ কর্তৃক বাঘ যখন শ্রীনাথ বহুরূপী রূপে আবিস্কৃত হয় তখন এই পিশেমশাই মহাক্রোধে বলেন “শালাকো কান পাকড়কে লও” অথবা “উহার ল্যাজ কাটিয়া দাও” প্রভৃতি। এখানে মূলত পিশেমশাই চরিত্রের যে গভীর মনস্তত্ত্বের পরিচয় দিয়েছেন লেখক তাই-ই হাসির উদ্রেক করে।

কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে তীর্যক ব্যঙ্গাত্মক হাস্যরসেরও প্রকাশ লক্ষ করা যায়। যেমন-

নিশীথ অভিযানকালে ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তকে সতর্ক করে যে মন্তব্য করে তা এইরকম- “সত্য বটে মাছ আর ছিল না, সুতরাং মৎসপ্রার্থীদের শুভাগমন না হইতে পারে ; কিন্তু সকলের লােভ যে মাছেরই ওপর তাই বা কে বলিল ? মানুষের ঘাড় মটকাইয়া ঈষৎ উয় রক্ত পান এবং মাংস চর্বনের ইতিহাস কতাে শােনা গিয়েছে।” এখানে সাধারণ মানুষের অলৌকিকতায় বিশ্বাস সম্পর্কে যে গভীর সংস্কার আছে তাকেই পরিহাস মার্জিত রুচিতে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। আবার নতুনদাদার চরিত্র সৃষ্টিতেও এইজাতীয় বিদ্রুপ বা তির্যক ব্যঙ্গের পরিচয় পাওয়া যায় সিল্কের মােজা, চকচকে পাম্প সু, আগাগােড়া ওভার কোর্টে মােড়া এবং গলায় গলাবদ্ধ, হাতে দস্তানা-এইরকম সুসজ্জিত নতুনদাদার প্রতি লেখকের যে ঈষৎ ব্যঙ্গ তা হাস্যরসের বাহক এবং এই নতুনদাই হাসির চূড়ান্ত মাত্রার দিকে অগ্রসর হন, যখন নাকি সুরে গান ধরে ‘ঠুন ঠন পেয়ালা’ আর সেই অশ্রুতপূর্ব গানে ও অভূতপর্ব পােষাকের ছটায় বিভ্রান্ত হয়ে গেয়ে কুকুরের দল তাকে তাড়া করে এবং নতুনদা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু এত ঘটনার পরেও নতুন দা যখন উঠে এসে বলে “আমার একটি পাটি পাম্প সু?” তখন পাঠকের হাসির বাঁধ ভেঙে যায়।

সন্ন্যাসীর আখড়ায় শ্রীকান্তের অভিজ্ঞতার যে বর্ণনা লেখক দিয়েছেন তাতে টুকরাে টুকরাে বাক্যের মধ্যেই হাসির ছটা উছলে পড়ে। যেমন অজানা এক স্টেশনে এসে শ্রীকান্তের যখন প্রচণ্ড খিধে এবং হাতে টাকা খুবই সামান্য তখন এক সন্ন্যাসীর আস্তানায় ধোঁয়া দেখে সামনে উপস্থিত হন এবং মনে মনে ভাবেন যে এই ‘মুক্তিমার্গের সিংহদ্বার’ ছাড়া আর কোথাও যাবেন না। তারপর দীক্ষার জন্য গেরুয়া বস্ত্র রুদ্রাক্ষ প্রভৃতি ধারণ করে মুখে কিছুটা ধুণীর ছাই মেখে ফেলেন। তারপরের কথাটি এইরকম- “চোখ টিপিয়া কহিলাম, বাবাজী আয়না টায়না, হ্যায় ? মুখখানা যে ভারী একবার দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে।” এখানে শুধু হিন্দি বাংলার মিশ্রণজাত সংলাপই নয়, শ্রীকান্ত চরিত্রের যে মনােভাব ধরা পড়েছে তাও হাস্যরসের সহায়ক। ক্রমশ শ্রীকান্ত প্রভুর স্নেহের পাত্র হয়ে ওঠে। তারপর প্রয়াগ যাত্রার পথে শ্রীকান্ত যখন বাবাজীদের সঙ্গ ত্যাগ করে রামবাবুর বাড়িতেই থেকে যায় তখন সন্ন্যাসীর মন্তব্য “এই অল্পদিনের মধ্যেই আমি যে প্রভুর সর্বাপেক্ষা স্নহের পাত্র হইয়াছিলাম এবং টিকিয়া থাকিলে তাহার সন্ন্যাসী লীলার অবসানে উত্তরাধিকার সূত্রে টাটু এবং উট দুটো যে দখল করিতে পারিতাম তাহাতে কোনাে সংশয় নাই।” এছাড়াও সন্ন্যাসীদের ভেতরের জীবনের অভিজ্ঞতা তিনি যে ভাষায় বর্ণনা করেছেন তাও যথার্থই হাস্যরসের সহায়ক।

এইরকম ছােটো ছােটো বহু অভিজ্ঞতার কথা পাওয়া যায় উপন্যাসের বহু জায়গায়। যেমন গ্রামের যাত্রাপালা দেখতে গিয়ে মেঘনাদ সম্পর্কে লেখকের যে অভিজ্ঞতা এবং তার বর্ণনার যা ভাষা তা হাস্যরসের চূড়ান্ত মাত্রা স্পর্শ করে। অর্থাৎ এখানে চরিত্র নয়, পরিস্থিতির চিত্রণ এবং তার উপযােগী সংলাপই হাস্যরসের বাহক। সবমিলিয়ে বলতে হয়, সমগ্র উপন্যাসে হাস্যরস এসেছে মূলত তিনটি উপায়ে কিছুটা চরিত্র চিত্রণে, কিছুটা পরিস্থিতি রূপাংকনে, এবং কিছুটা শব্দ এবং বাক্য ব্যবহারে। তবে একথা ঠিক যে। হাস্য রসের এই তিনটি উপায়েই একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত। আর সবমিলিয়ে হাসির সঙ্গেই লেখক আমাদের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার জগতে পৌছে দেন। হাস্যরসের স্রষ্টা হিসেবে শরৎচন্দ্রের সার্থকতা এখানেই।