“আজ রাত্রে আবার সেইরূপ উপদ্রব আরম্ভ হইয়াছে”—উক্তিটি কার? কোন উপদ্রবের কথা বলা হয়েছে?

বাংলা ছোটগল্পের জনক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘নিশীথে’ ছোটগল্পের প্রধান চরিত্র দক্ষিণাচরণবাবু ডাক্তারকে এই উক্তি করেছিলেন।

গল্পটির শুরু ডাক্তারের কাছে গল্পের নায়ক দক্ষিণাচরণবাবুর জবানবন্দীতে। তাঁর প্রথমা স্ত্রী গৃহিণী হিসেবে ‘অতিদুর্লভ’, গম্ভীর শান্ত প্রকৃতির, স্বল্পভাষিণী, সেবাপরায়ণা। একটি মৃত সন্তান প্রসবের পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। স্ত্রীর সেবা শুশ্রুষার যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন দক্ষিণাচরণ কিন্তু দীর্ঘদিন রোগভোগের পর দুজনেই বুঝলেন রোগ সারবার নয়। বায়ু পরিবর্তনের জন্য স্ত্রীকে এলাহাবাদে নিয়ে গেলেন, সেখানকার হারান ডাক্তারের মেয়ে মনোরমার প্রতি দুর্বল হলে প্রথমা স্ত্রী অসুস্থ অবস্থাতেও তা বুঝতে পেরে মালিশের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেন যাতে মনোরমাকে বিয়ে করে স্বামী সুখী হতে পারেন। মনোরমার মধ্যে দ্বৈধতার জন্য হাসিখুশি ভাব ছিল না, স্বামীর প্রেমালাপে সাড়া দিত না। দক্ষিণাচরণ মদের নেশা বাড়িয়ে দেয়। একদিন শুক্লা সন্ধ্যায় দ্বিতীয়া পত্নীকে প্রথমা পত্নীর মতো করে বলে ওঠেন—“মনোরমা তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না, কিন্তু তোমাকে আমি ভালোবাসি। তোমাকে আমি কোনোকালে ভুলিতে পারিব না।” নিজের মনের দৈন্যতা বুঝতে পেরে চমকে ওঠে এবং তার পরবর্তীকালে প্রতিটি প্রেমালাপে প্রথমা স্ত্রী তাঁকে মনস্তাত্ত্বিক কষ্ট দিতে থাকে। পাখির ডাক, ডানা ঝাপটানো প্রভৃতির মধ্যে প্রথমা স্ত্রীর হাহা হাহা হাসি এবং ও কে, ও কে, ও কে গো’ সংলাপ শুনতে পায়। প্রতিরাতে এইভাবে মনোবিকারে অর্ধরাত্রে ডাক্তারের কাছে ছুটে এসে প্রথমা স্ত্রীর প্রতি অবিচার, একনিষ্ঠতার অভাব সে অনুভব করত। নিজের জবানবন্দীতে সারারাত্রি তাই তিনি বর্ণনা করতেন। প্রাকৃতিক ঘটনা বা পাখির ডার্ক ও তাদের ডানা ঝাপটানকে প্রথমা স্ত্রীর অতিপ্রাকৃত উপদ্রব বলে মনে করতেন।

“আহার ছিল না, নিদ্রা ছিল না, জগতের আর কোনোকিছুর প্রতিই দৃষ্টি ছিল না।”-কার প্রতি কে এই উক্তি করেছেন? উদ্দিষ্ট ব্যক্তি কে? প্রসঙ্গত তার চরিত্রবৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।

‘নিশীথে’ গল্পের প্রধান চরিত্র অন্তর্দ্বন্দ্বে বিধ্বস্থ দক্ষিণাচরণ পারিবারিক ডাক্তারের কাছে এই মন্তব্য করেছিল।

উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি হলেন দক্ষিণাচরণের প্রথমা পত্নী। যার সেবা-শুশ্রুষা, গাম্ভীর্য, সাংসারিক চরিত্রজ্ঞানের তুলনা ছিল না।

গোটা গল্পটি জুড়ে নায়ক দক্ষিণাচরণের অপরাধজনিত মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বই প্রকটিত হয়েছে। দুই নারীর দ্বন্দ্বেই তিনি অস্থিরচিত্ত হয়ে উঠেছেন। প্রথমা স্ত্রী প্রখর বুদ্ধিমতী, তাঁর স্বামীর আবেগাত্মক কথাবার্তায় বিশ্বাস ছিল না, তবু দক্ষিণাচরণকে ভালোবাসতেন, স্বামীর সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। কল্পনাচারী, কাব্যিক মন নিয়ে তিনি ধরা না দিলেও ছিলেন আদর্শ গৃহিণী। দক্ষিণাচরণের কাছে তাই অবচেতন মনে প্রথমা পত্নীর প্রতি অবজ্ঞাই ছিল, শুধু কামনার বশে মাঝে মাঝে মুখে ভালো ভালো কথা বললেও তা বুদ্ধিমতী স্ত্রীর মনের আয়নায় ধরা পড়ত তাই সে হেসে উড়িয়ে দিত, দক্ষিণাচরণের স্তুতি তাই প্রত্যাপিত হত। আসলে দ্বিতীয়া পত্নীর আবির্ভাবেই দক্ষিণাচরণ প্রথমা পত্নীর অভাব এবং তাঁর প্রতি অবজ্ঞা ও অবিচারগুলি জাগ্রত হয়ে উঠেছিল। দক্ষিণাচরণের মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্ব সেইজন্যই প্রকটিত হয়ে উঠেছে। প্রথমা পত্নী দক্ষিণাচরণের কল্যাণী রূপিণী, নিজের জগতে তিনি ছিলেন সম্রাজ্ঞী, পরম স্নিগ্ধতা ছিল তাঁর সংসারে। যমদূতের মতো রোগযন্ত্রণা তাঁর সংসার জীবন ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়।

“কোনোকালে ভুলিবে না, ইহা কখনো সম্ভব নহে এবং আমি তাহা প্রত্যাশাও করি না।”—উক্তিটি কার? কোন প্রসঙ্গে এই উক্তি? তাঁর এই মন্তব্য কী সত্যি হয়েছিল?

‘নিশীথে’ গল্পে দক্ষিণাচরণের প্রথমা স্ত্রীর উক্তি এটি।

দক্ষিণাচরণবাবুর প্রথমা পত্নী ছিলেন আদর্শ গৃহিণী, সেবাপরায়ণা, সংসারী নারী, তাঁর মধ্যে ছিল কল্যাণী-স্বামী স্বরূপিণী আদর্শ। দক্ষিণাচরণবাবু কাব্যকলাভিজ্ঞ, রসাধিক্যবোধ ছিল তাই স্ত্রীকে সেভাবেই পেতে চেয়েছিল। তাই প্রেমালাপ করার জন্য বলত ‘তোমার ভালোবাসা আমি কোনোকালে ভুলিব না’—এই উক্তিরই প্রত্যুত্তরে বুদ্ধিমতী স্ত্রী এই উক্তি করেছিলেন।

দক্ষিণাচরণবাবু ছিলেন স্খলিতবাক্। স্বভাবজ কামনাবাসনায় দীর্ণ, তা বুঝতে পেরেছিলেন প্রথমা পত্নী : তাই তাঁর কাব্যিক প্রেমালাপের ফাঁকা আওয়াজ ধরে ফেলেছিলেন তিনি। স্ত্রীর প্রতি একনিষ্ঠতাবোধের অভাব ছিল দক্ষিণাচরণবাবুর মধ্যে। তাই এলাহাবাদে হারান ডাক্তারের কন্যা মনোরমার সান্নিধ্যে এসে অসুস্থ প্রথমা স্ত্রীকে ভুলতে বসেছিলেন। তবু তা স্বীকার না করেও স্ত্রীর মনকে প্রবোধ দিতে বলেছিলেন—“যতদিন এই দেহে জীবন আছে—” কথা শেষ করতে দেননি, কারণ স্বামী রত্নটিকে তাঁর চেনার বাকি ছিল না। অসুস্থ শরীরটাকে স্বামীর সুখী জীবনের প্রতিবন্ধক করে রাখেন নি, আত্মহত্যাই শ্রেষ্ঠ পথ বেছেছিলেন। অনতিবিলম্বেই মনোরমাকে দ্বিতীয়া পত্নী রূপে গ্রহণ করেছিলেন দক্ষিণাচরণবাবু। মনোরমার কাছ থেকে অবদমিত সুখ প্রার্থনা করেও না পেয়ে শেষপর্যন্ত মনোবৈকল্যে বিধ্বস্থ হয়েছেন, বারবার ছুটে গেছেন নিজের অপরাধবোধের স্বীকারোক্তি জানাতে পারিবারিক ডাক্তারের কাছে নিশীথে। প্রথমা পত্নীর ভবিষ্যৎবাণী সফল হয়েছিল গল্পের শেষে দেখতে পাই।

“আমার স্ত্রী চমকিয়া আমার হাত ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন ‘ও কে!”–প্রসঙ্গ নির্দেশ করে। উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

‘নিশীথে’ গল্পটি একটি আত্মজীবনীমূলক গল্প। প্রথমা স্ত্রীর প্রতি অশ্রদ্ধা, অবিচার গল্পকথক দক্ষিণাচরণের বিবেকবোধকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। নিজের মনের কাছেই বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিশীথ রাত্রে স্বীকারোক্তির জন্য ডাক্তারের কাছে ছুটে ছুটে গেছেন। প্রথমা স্ত্রীর স্বামীর প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা, তার সেবায় শুশ্রুষায় অর্ধমৃত কথকের দেহে প্রাণ ফিরে এসেছিল, কিন্তু দীর্ঘ পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে নিজেরই অসুখ ডেকে আনেন পতিব্রতা স্ত্রী। প্রথমা স্ত্রীর মধ্যে রসাধিক্যবোধ বা কাব্যকলারীতি না থাকলেও ছিল সাংসারিক পরিমিতি বোধ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন স্বামীর মধ্যে গভীরতাবোধ বা তার প্রতি অনাবিল ভালোবাসার ঘাটতি আছে। তাই বারবার স্বামী প্রেমালাপের স্তোত্র তাঁর কাছে হাস্যকর ঠেকত। বাধা দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যেত। অসুস্থ স্ত্রীকে এলাহাবাদে হাওয়া বদলের জন্য নিয়ে গিয়ে হারান ডাক্তারের অবিবাহিতা কন্যার প্রেমে পড়েন দক্ষিণাচরণ, তা বুঝতেও পারেন স্ত্রী, কারণ শুশ্রুষার ঘাটতি দেখা করার অনিচ্ছার মধ্যে তা প্রমাণিত হয়। একদিন মনোরমা অসুস্থ রোগিনীকে দেখতে আসে, তখনই চমকে ওঠেন দক্ষিণাচরণের স্ত্রী, স্বামীকে বারবার এই প্রশ্ন করতে থাকেন যে, মেয়েটি কে? অর্থাৎ তিনি যা ভেবেছেন স্বামী সম্পর্কে তা কি এত দ্রুত সত্যি হতে চলেছে। সেজন্যই চমকে ওঠা। ভাবনার বাস্তবায়ন পতিব্রতা গৃহিণী স্ত্রীকে অবাক করেছে।

“শোক করিয়ো না, ভালোই হইয়াছে, তুমি সুখী হইবে, এবং সেই মনে করিয়া আমি সুখে মরিলাম।”—উক্তিটি কার? প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বক্তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।

‘নিশীথে’ ছোটগল্পে অন্তর্দ্বন্দ্বে বিধ্বস্থ গল্পের কথকের প্রতি তাঁর প্রথমা স্ত্রীর উক্তি।

স্বামীসেবায় অক্লান্ত, পতিব্রতা স্ত্রী স্বামীকে সুস্থ করে নিজে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনতিকালের মধ্যে মৃত সন্তান প্রসব করে জটিল ব্যাধির শিকার হন। দীর্ঘ চিকিৎসায় তাঁর ব্যাধি সারবার নয় জেনে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই হাল ছেড়ে দেন। তবু শেষ চেষ্টা হিসেবে এলাহাবাদে বায়ুপরিবর্তনে গিয়ে সেখানকার ডাক্তারকন্যার প্রেমে পড়েন গল্পকথক দক্ষিণাচরণ। নিজের অসুস্থতা স্বামীর দ্বিতীয় দার গ্রহণে প্রতিবন্ধক বিবেচনা করে মালিশের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। মৃত্যুকালে স্বামীকে বুকে ধরে উদ্ধৃত কথাগুলি বলেছিলেন। দক্ষিণাচরণের প্রথমা পত্নী ছিলেন আদর্শগৃহিণী, সেবাপরায়ণা সংসার অভিজ্ঞ কল্যাণীসত্তা। সংসারটিকে গড়ে তুলেছিলেন নিজের তৈরি বাগানটির মতো করেই। তিনি জানতেন স্বামীর স্খলিতবাক্ চরিত্র, কাব্যরসাধিক্য, শিল্পকলায় মগ্ন স্ত্রী চেয়েছিলেন, কিন্তু পান নি। মনের গভীরের সেই অবজ্ঞা ধরা পড়ত আচরণে। স্বামীর কঠিন অসুস্থতায় নিজের জীবন বিপন্ন করে শুশ্রুষা করেছেন স্নিগ্ধা নারীর মতোই। কিন্তু মর্যাদা পান নি। শেষ পর্যন্ত প্রতারিত হন পরমদয়িতের কাছেই। তাই জীবনযন্ত্রণার অন্তিমলগ্নে এই উক্তি করেছিলেন।

“সেইসময় সেই জনমানবশূন্য নিঃসঙ্গ মরুভূমির মধ্যে গম্ভীর স্বরে কে তিনবার বলিয়া উঠিল, ও কে? ও কে? ও কে?”সেইসময়’ বলতে কোন সময়ের কথা বলা হয়েছে? বক্তার এমন উপলব্ধির কারণ বর্ণনা করো।

‘নিশীথে’ গল্পে গল্পকথক দক্ষিণাচরণ প্রথমা সাধ্বী স্ত্রীর মৃত্যুর অনতিবিলম্বে দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করেন। পদ্মাচরে বিহারের সময় জনমানবশূন্য বালুকারাশির মধ্যে স্ত্রীকে চুম্বন করলে দক্ষিণাচরণ অতিচেতন মনে এই জিজ্ঞাসা শুনতে পান।

গল্পটিতে গল্পকথকের অপরাধবোধের জটিল মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব প্রকটি হয়ে উঠেছে। প্রথমা স্ত্রীর প্রতি অপ্রেম তাঁকে দ্বিধাজীর্ণ করে তুলেছে, দ্বিতীয়া স্ত্রী মনোরমার মধ্যেও ছিল একটা জড়তাবোধ। উভয়ের কাছ থেকেই প্রত্যাশিত কামনার পূর্তি না হওয়ায়, হারিয়ে যাওয়া পত্নীর প্রতি সহানুভূতি ও মনের পাপবোধ গল্পটিকে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দীতে পরিণত করেছে। অতি প্রাকৃতবোধ গল্পকথককে শিহরিত করেছে। রাত্রির অন্ধকারে অবচেতনের দ্বন্দ্ব-শঙ্কা প্রাক্‌চেতনের পথ বেয়ে চেতন স্তরকে আলোড়িত করেছে। প্রথমা স্ত্রীর প্রতি অবহেলা, প্রতিশ্রুতিপালনে অক্ষমতা তাঁকে হীনমন্য করে তুলেছে। দ্বিতীয়া স্ত্রীর জড়তা, তাচ্ছিল্য তাঁকে তারই অতীতের দুরাচারকে স্মরণ করিয়েছে এবং গল্পকথক জর্জরিত চিত্তে বারবার নিজের ভুলগুলো স্বীকার করতে গহন নিশীথে ডাক্তারের কাছে ছুটে গেছেন।