কোনো বন্ধু, আত্মীয় বা অতি নিকট জনের বিয়োগ ব্যথাকে উপলক্ষ্য করে কবির ব্যক্তিগত শোক ভাবনাকে বলা হয় শোকগীতি বা এলিজি (Elegy)। তবে সমালোচক জেব তাঁর প্রাইমার অব গ্রীক লিটারেচার’ গ্রন্থে এই শোকগীতি সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন—এর বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তি অত্যন্ত বেশি। যুদ্ধ বিগ্রহ, পরাধীনতার যন্ত্রণা, রাজনৈতিক ব্যঙ্গবিদ্রুপ আদর্শ জীবনযাত্রা সম্বন্ধে কবির ধারণা, মৃতের প্রতি কবির শোক জ্ঞাপন প্রভৃতি অনেক বিষয়ই নিয়ে এলিজি লেখা হতে পারে। সমালোচক শ্রীশচন্দ্র দাস মনে করেন,— “মৃতের উদ্দেশ্যে রচিত কবিতাকে ‘মোলোডি’ নামে আখ্যাত করা উচিত।” আবার সমালোচক হাডসন বলেছেন—“গ্রিক এবং ল্যাটিন সাহিত্যে একটি বিশেষ ছন্দ রূপকেই এলিজি বলা হয়।” প্রথমে দু মাত্রা ও পরে পাঁচ মাত্রায় সজ্জিত এই ছন্দরূপের আদর্শ যে কবি লংফেলোর একটি কবিতায় ধরা পড়েছে তাও তিনি প্রমাণ করেছেন।
Elegy শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক Elegia শব্দ থেকে। যার অর্থ বেদনার আকুলতা এবং বর্তমানে শোক প্রকাশ কবিতা হিসাবেই প্রচলিত। সুতরাং প্রচলিত অর্থকে মেনে নেওয়াই শ্রেয়। ইংরাজীতে শোকজ্ঞাপক ছোটো এক ধরনের কবিতাকে বলা হয়, ‘ডার্জ’, তা সত্ত্বেও শোকের কবিতাকে এলিজি রূপে আখ্যাত করাই বিধেয়। এলিজির কয়েকটি স্পষ্ট বিভাগের কথা স্মরণে রাখা ভালো। একধরনের এলিজিকে বলা হয় ‘Critical Elegy’, এতে কবি সাহিত্যিকের স্মরণে তাঁর রচনা কর্মের সৌন্দর্য বিশ্লেষণ করা হয়। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাও জ্ঞাপন করা হয়। ইংরেজিতে এই ধরনের এলিজির মধ্যে ম্যাথু আর্নল্ডের—‘হাইনেজ গ্রেভ’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এলিজির অন্য আর এক বিভাগকে বলা হয়—Pastoral Elegy বা রাখালিয়া শোকগীতি। এর বৈশিষ্ট্য হল—কবি তাঁর ব্যক্তিগত শোককে এক নিঃসঙ্গ রাখালের বেদনার সঙ্গে অভিন্ন করে তোলেন এবং রাখাল যখন তার শোকসন্তপ্ত চিত্তের পরিচয় ফুটিয়ে তোলে তাতেই প্রকাশিত হয় কবির বেদনা। এই ধরনের এলিজির উদ্ভাবক গ্রিক কবি ‘বিয়ন’ তিনি ‘ল্যামেন্ট ফর অ্যাডেনিস’ কবিতায় এই রীতির প্রথম প্রয়োগ ঘটান। বিয়নের মৃত্যুর পর তার শিষ্য কবি মস্কাস লেখেন- একই রীতিতে ‘ল্যামেন্ট ফর বিয়ন।
বাংলা সাহিত্যে এলিজির সন্ধান মেলে বিস্তর, তবে বেশিরভাগ বাংলা এলিজি মূলত Critical বা সমালোচনামূলক। যেমন—হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিদ্যাসাগর’ ও ‘এবে কোথায় চলিলে ?’ নবীন চন্দ্র সেনের ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত’ বা গোবিন্দ দাসের ‘বঙ্কিম বিদায়’ থেকে শুরু করে আধুনিককালের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এলিজি ‘পাথরের ফুল’ বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’। অবশ্য এছাড়াও বাংলা কবিতায় এই জাতীয় এলিজি বহু আছে। রবীন্দ্রনাথের কথা বাদ দিলে—নজরুল ইসলামের ‘গোকুল নাগ’ ববিহারা, সজনীকান্ত দাসের ‘সত্য হইতে বিদায়’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
রাখালিয়া শোকগীতি বা Pastoral Elegy, বাংলায় বিশেষ নেই, কিন্তু ব্যক্তিগত শোক থেকে লেখা বহু কবিতা আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিহারীলাল চক্রবর্তীর ‘কিছু বিয়োগ’, অক্ষয় কুমার বড়ালের ‘এষা’, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উদ্দেশে’, রবীন্দ্রনাথের ‘স্মরণ’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তিনটি গুলি’ প্রভৃতি। ব্যক্তিগত শোককে বা বহু বিয়োগকে লঘু রীতিতে পরিবেশনের যে দু-একটি উদাহরণ পাওয়া যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বনফুলের লেখা ‘পরিমল গোস্বামী’। যেমন—
পরিমল চলে গেলে। বেশ গেছো ভাই।
এ জগতে বেঁচে থেকে কোনো সুখ নাই ৷৷
ব্যক্তিগত শোক বা রহস্য ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে সাধারণ শোকাবহ ঘটনা নিয়েও বাংলা এলিজি লেখা হয়েছে। যেমন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’ নামক দীর্ঘ কবিতায়। এই জাতীয় কবিতায় শোকের প্রাথমিক আঘাত কাটিয়ে যে আশার সুর শুনিয়েছেন কবি মিল্টন ‘weep no more’ রবীন্দ্রনাথও সেই আশার কথা বলেছেন এই কবিতায়—
“বাধা কি ঘুচিল চোখের,
সুন্দর কি ধরা দিল অনিন্দিত নন্দন লোকের
আলোকে সম্মুখে তব, উদয় শৈলের তলে আজি
নবসূর্য বন্দনায় কোথায় ভরিলে তব সাজি
নব ছন্দে, নূতন আনন্দ গানে ?”
এই বলিষ্ঠ আশাই কবিতাটিকে ভিন্নতর মাত্রা দান করেছে।
Leave a comment