আমরা যখন যে ভাষা ব্যবহার করি না কেন,—মুখের কথায় হক, লেখায় হক–সে ভাষায় কতকগুলি লক্ষণ ফুটে ওঠে। তার কয়েকটি হল ভাষার অনিবার্য অপরিহার্য অন্তর্গত লক্ষণ। ভাষা ব্যবহার করলেই যে লক্ষণগুলি থাকবে, সেগুলি ভাষার ভাষা হওয়াই অন্যতম শর্ত। এগুলিকে আমরা বলতে পারি ভাষার ব্যাকরণগত’ লক্ষণ। অর্থাৎ আমাকে কয়েকটা কথা নির্দিষ্ট নিয়মে সাজিয়ে বাক্য তৈরি করতে হবে, সেই নিয়মগুলির প্রবল হেরফের ঘটালে ? বাক্যটা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে না। যদি আমি বলি, ‘খেলে ক্ষতি সবজি টাককা কী ? তা শ্রোতার কাছে কোনো অর্থ বহন করবে না। তার বদলে ভাষার অনুমোদিত পরস্পরায় যদি বলি ‘টাটকা সবজি খেলে ক্ষতি কী ?’ তা শ্রোতার কাছে আমার বক্তব্যটিকে স্পষ্ট করে দেবে। দ্বিতীয় অর্থাৎ গ্রাহ্য বাক্যটি, শব্দের যেসব পরম্পরা ভাষার ব্যাকরণ অনুমোদন করে, তার একটি মেনে সাজানো হয়েছে। তাতে বিশেষণ সাধারণভাবে বিশেষ্যের আগে বসবে, কর্ম সাধারণভাবে ক্রিয়ার আগে—এইসব নানা অনুশাসন আছে। সবগুলি অনুশাসন সমান কড়া নয়। যেমন বলতে পারি, বাংলায় বিশেষণ বিশেষ্যের আগে বসবে এ নিয়মটা যত মানতে হয়, কর্ম (মুখ্যকর্ম ও গৌণকর্ম দুইই) ক্রিয়ার আগে বসবে এ নিয়ম তত কড়া নয়। যাই হোক, এই রকম কখনও কিছুটা শিথিল কখনও অলঙ্ঘনীয় নিয়মের গুচ্ছই হল ব্যাকারণ। ভাষার বাক্য বলতে গেলেই এই ব্যাকরণের শাসন আমাদের মেনে চলতে হয়।
শুধু ব্যাকরণ মেনে যে-কথা বলি আমরা, তাতে মনের কথাটা জানিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটাই বড়ো হয়ে ওঠে। ‘আর কিছুদূর গেলে নদী পড়বে’, ‘সকালে আমার বাজার করা হয়নি’, ‘ওর ছোটো ছেলে পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন ইস্কুলে পড়ে’ ইত্যাদি বাক্য আলাদা করে আমাদের নজর কাড়বার চেষ্টা করে না। এগুলিতে “কথাটা কী”—সেইটেই বুঝে নেওয়ার জন্য আমরা ব্যগ্র হই, “কথাটা কীভাবে (গুছিয়ে, সুন্দর করে সাজিয়ে ইত্যাদি বলা হল’—সেদিকে আমাদের মনোযোগ যায় না। ব্যাকরণের নিয়ম এক ধরনের, কথা সাজানো গোছানোর নিয়ম আর এক ধরনের।
কথার এই সাজানো-গোছানোর প্রমাণ যদি আমার ব্যবহার করা বাক্যে থাকে, তাহলে “কী বলা হচ্ছে” তার সঙ্গে সঙ্গে “কেমন করে বলা হল”—এই বিষয়টিও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ তখন বলা কথার মধ্যে একটা ‘সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। ‘সৌন্দর্য’ কথাটার বদলে ‘বিশেষত্ব’ কথাটাই হয়ত ভালো, কারণ আমরা মনে করি সাধারণ সৌন্দর্যের ধারণায় ভাষার ওই সাজগোজকে পুরোপুরি বেঁধে ফেলা যাবে না। আমাদের মতে গালাগালের ভাষারও একটা শৈলী আছে, কিন্তু তাকে ‘সুন্দর’ বলা সাধারণ অর্থে মুশকিল হবে।
ব্যবহৃত ভাষা ‘বিশেষত্ব’ পায় তখনই, যখন আমরা ব্যাকরণের ওই প্রাথমিক ও অনিবার্য নিয়মগুলির মধ্যে মাত্র নিজেদের উচ্চারণকে সীমাবদ্ধ না রাখি, যখন আমরা ব্যাকরণেই, অর্থাৎ ভাষার মধ্যেই, যে অনেক রকমের অদলবদল হেরফের করার সুযোগ রেখে দেওয়া আছে, সেই সুযোগ নিয়ে কথা ‘বেছে’ নিই, বাক্যের মধ্যে কথার অন্য একটা বিন্যাস বেছে নিই, বাক্যের ধরন বেছে নিই—এইরকম নানা নির্বাচনের সদ্ব্যবহার করি। অর্থাৎ ব্যাকরণ মানা যেখানে সাধারণভাবে ‘বাধ্যতা’ সূচক, শৈলীর যে ব্যাপকতার ব্যাকরণ—তা ওই ‘বাধ্যতা’র মধ্যে, বাধ্যতার বাইরে গিয়ে আমাদের নির্বাচনের বা choice-এর স্বাধীনতাকে স্বীকার করে। আমি এই দু-ধরনের নির্বাচনের একটু উদাহরণ দিই। নীচের প্রয়োগগুলিতে পরপর ব্যাকরণের প্রাথমিক শর্ত-মানা, ব্যাকরণের সম্ভাবনাকে অতিক্রম না-করা, এবং ব্যাকরণের সম্ভাবনাকে ছাড়িয়ে যাওয়া বাক্যের উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে—
১. সে এক মাস পরে ফিরে আসুক।
২.
-
ফিরে আসুক সে এক মাস পরে।
-
সে ফিরে আসুক একমাস পরে।
-
এক মাস পরে সে আসুক ফিরে।
-
আসুক সে ফিরে এক মাস পরে …
৩. এক মৃত্যু পরে সে আসুক ফিরে।
প্রথম বাক্যটি আমরা শুনে অর্থটি বুঝে নিই মাত্র, তার দিকে আর দ্বিতীয় বার ফিরে তাকাই না। ২-এর অন্তর্গত যে চারটি বাক্য আছে, তা ব্যাকরণের নিয়মকে কোথাও হিংস্রভাবে লঙ্ঘন করে না, বরং তার মধ্যে অদলবদলের যেসব অনুমোদন আছে তা মেনেই এগুলি তৈরি হয়েছে। এগুলি আমাদের ক্ষণিক মনোযোগ টানে, কারণ এগুলিতে বিষয়ের ওপর যে ঝোঁক বা focus, তার হেরফের ঘটাচ্ছি আমরা। এরকম আরো বাক্য হতে পারে, ..’ চিহ্ন দিয়ে আমরা সেইটে বোঝাতে চাইছি। চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাহার ভাষাবিজ্ঞানীদের পরিভাষা মেনে আমরা ১-এর বাক্যটিকে বলব ‘অচিহ্নিত’ (unmarked), কিন্তু ২-এর বাক্যগুলিকে বলব ‘চিহ্নিত’ (marked), অর্থাৎ ঠিক সাধারণ বাক্য নয় সেগুলি। কিন্তু ৩ এর বাক্যটি শুধু ‘চিহ্নিত’ নয় ‘বিশেষভাবে চিহ্নিত’ (highly marked), কারণ দৈনন্দিন ব্যবহারের ভাষায় অনুমোদিত নয়—এমন ব্যবহার তাতে ঘটেছে। যেখানে আমরা ‘একমাস আগে, এক সপ্তাহ আগে’ বলতে অভ্যস্ত সেখানে দিন, সপ্তাহ, মাস ইত্যাদি সময়বাচক পদের জায়গায় এসে বসেছে ‘মৃত্যু’, তা আমাদের মনে বিশেষ একটি ধাক্কা তৈরি করছে।
এও আমরা একটা সংযত প্রয়োগ হিসেবে মেনে নিচ্ছি। ভাষার ব্যাকরণে না হোক, রোমান ইয়াকবসন (Roman Jokobson ১৮৯৬-১৯৮২) যাকে ‘কবিতার ব্যাকরণই (১৯৬১) বলেন তাতে এ প্রয়োগ সংগত। ভাষার ব্যাকরণে একটি অনড় নিগড়বদ্ধ অংশ আছে, সেখানকার নিয়মগুলি আমাদের মানতেই হবে। আবার তার একটি উদারতর অংশ আছে, সেখানে আমাদের বেছে নেওয়ার কিছু স্বাধীনতা আছে। দৈনন্দিন মুখের ভাষার ব্যাকরণের মধ্যেই এই দুটি অংশ আছে। তার ওপরে আছে কবিতার ভাষার ব্যাকরণ—যেখানে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আরো বেশি, কখনো কখনো তা দৈনন্দিন ভাষার ব্যাকরণকে অতিক্রম করে যেতে পারে। ‘এক মৃত্যু পরে সে ফিরে আসুক’ একরম বাক্য রোজগার মুখের ভাষায়, প্রত্যাশিত নয়।
তিনটি বৃত্তের ভিতরকার সীমাবন্ধনীগুলি জল-অচল নয়। কবিতার ভাষা মুখের ভাষার অনড় ব্যাকরণকে মানা করবে, মুখের ভাষার উদারতা ব্যাকরণের সুযোগুলির ব্যবহৃত করবে, এবং কবিতার নিজস্ব দাবি অনুযায়ী কখনো কখনো উদারতার ব্যাকরণের অনুশাসনকেও ভাঙবে। অর্থাৎ কবিতার ভাষা ব্যাকরণের তিনটি বৃত্তকেই ব্যবহার করে। কিন্তু কোনো কোনো কবি-সম্প্রদায়ের, যেমন ভবিষ্যবাদী বা ফিউচারিস্টদের, বা দাদাবাদীদের যারা অর্থকে শব্দ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়, শব্দের বা অশব্দের ধ্বনি নিয়ে খেলা করতে চায়, তাদের মনঃপুত হোক আর না হোক—ভাষার অনড় মৌলিক ব্যাকরণ তাদের মানতেই হবে। তা অগ্রাহ্য করে যদি আমি লিখি বা বলি ‘এক পরে ফিরে সে মাস আসুক’—তা ‘সাধারণত পাঠকের কাছে কবিতার ব্যাকরণের দোহাই দিয়েও গ্রাহ্য হবে না। কারণ এই বাক্য ভাষা ব্যবহারের মূল শর্তকেই অগ্রাহ্য করে। ‘ধ্বনি দিনে তৈরি কথা সাজিয়ে কোনো একটা অর্থ প্রকাশ করা হবে’—এই হল সমস্ত রকমের ভাষা ব্যবহারের মূল শর্ত। দুর্বোধ্য হোক সে অর্থে, কিন্তু তা যখন সজ্ঞান পাঠকের কাছেও সম্পূর্ণ ‘অবোধ্য’ হয়ে দাঁড়ায় তখনই ভাষার সেই শর্ত ভাঙা হয়, তখন তা আর ভাষা থাকে না। ভবিষ্যবাদী ও দাদাবাদীরা ভাষার এই শর্তটিকেই মানতে চান না। একে ভেঙে তাঁরা অনেক গদ্য বা কবিতাও লিখেছেন। কিন্তু সেসব গদ্য বা কবিতা যে স্মরণীয় হয়নি, অর্থাৎ আমাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতিতে বা ব্যক্তিগত ব্যবহার্য সঞ্চয়ে আমরা সেগুলিকে জমিয়ে রাখার আগ্রহ বোধ করিনি তাতে প্রমাণ হয় ভাষা ওই দুধর্ষণ সহ্য করেনি।
Leave a comment