‘অচিহ্নিত’ ভাষাতে শৈলী আছে কি নেই তা নিয়ে প্রচুর তর্ক তৈরি হয়েছে। এই তর্কটা ভাষাবিজ্ঞানের দু-একটি মৌলিক ধারণার সঙ্গে জড়িত।
একটা ধারণা হল ফের্দিনা দ সোস্যুর-এর langue/parole বিজাজন (১৯৬৬: ১৪)। সোস্যুর ভেবেছেন, ভাষার বোধগত রূপ আর স্পষ্ট, প্রকট ভাষা ব্যবহারের মধ্যে তফাত আছে। লাঙ্ হল ভাষার সেই রূপ বা বিন্যাস যা সকল মানুষের কাছে লভ্য (লম্ব নাও হতে পারে), আর পারোল হল বিভিন্ন মানুষের ব্যবহৃত স্পষ্ট ও প্রকট ভাষা। অনেক সময় যে বলা হয় স্টাইল ব্যক্তিত্বের চিহ্নমাত্র, অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি প্রাণীবিদ বুফো (Buffon) র কথা ‘Lifestyle, cest homme meme’—স্টাইল ও ব্যক্তি অভিন্ন—এই ধরনের কথাবার্তা থেকে এমন মনে হতে পারে যে, ব্যক্তির ব্যবহৃত ভাষাই হল পারোল, কিন্তু সকলের যৌথ ভাষাই হল লাঙ্ বস্তুতপক্ষে ফরাসি শৈলীতাত্ত্বিক পিয়ের জিরো এ ধরনের একটা বক্তব্য খাড়া করবার চেষ্টা করেছিলেন এক আলোচনাচক্রে ; (দ্র. চ্যাটম্যান, ১৯৭১ : ২১), কিন্তু সে সময়ে তা নিয়ে দ্বিধা দেখা দিয়েছিল। তখন সকলের মতো মোটামুটি এই ছিল যে, ভাষার যে মূল যৌথ রূপ, তারই মধ্যে শৈলীর অজস্র সম্ভাবনা নিহিত থাকে, কাজেই শৈলী ওই লাঙের বৈশিষ্ট্য, পারোলের নয়। লিচ ও শর্ট (Leech and Short, ১৯৮৩ ১১) আবার এই কথাটার ভিতরে না ঢুকে সরলভাবে বলে দেন, “Style, then pertains to parole : it is selection from a total linguistic repertoire that constitutes a style.” আমরাও একথা স্বীকার করি যে, শৈলীর পারোল লাঙ্ বিভাজনে বেশ কিছু অস্পষ্টতা আছে (দ্র. কালার, Culler. ১৯৭৬ : ৩০), তা সত্ত্বেও লাঙ্ হল ভাষার নানা উপাদান (ধ্বনি, রূপ বা শব্দাংশ, বাক্য ইত্যাদি) ও তাদের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের মূল system-টি, এবং পারোল হল স্পষ্ট বাচনক্রিয়া, যা ওই উপাদান ও সম্পর্কের সম্ভাবনাগুলিকে ব্যবহার করেই গড়ে ওঠে। ব্যবহারের উপাদান, উপাদানের নির্বাচন ও প্রতিস্থাপনের নিয়ম নিশ্চয়ই লাঙের অন্তর্গত, কিন্তু আমি কী উপাদান কোন্ বিন্যাসে সত্যি সত্যি ব্যবহার করছি, তার পরিমাণবদ্ধ চেহারাটা পারোলের এক্তিয়ারে চলে আসে। তার ফলে শৈলী পারোলের অংশ, একথা স্বীকার করতে ক্ষতি নেই। কাজেই শৈলীর মূল ভিতি লাঙ্ হলেও তার আশ্রয় যে পারোল, সে কথা স্বীকার করাই ভালো।
বলা বাহুল্য সোস্যুর যাকে লাঙ্ বলেন তা একটি সিস্টেম বা সংবিধি, কেবল উপাদান ও সম্পর্কের জাল মাত্র। তাতে আছে ভাষার ব্যবহৃত ধ্বনির তালিকা ও এই ধ্বনিগুলির পরস্পরের সম্বন্ধের ছক—এই সম্বন্ধ অনুযায়ীই রূপ (morph) তৈরি হয় বিভিন্ন ধ্বনির অনুমোদিত বিন্যাস করে। আছে ভাষার রূপগুলির তালিকা ও তাদের পরস্পরের সম্বন্ধের ছকা ওই সম্বন্ধ ধরে আবার রূপগুলিকে সাজাতে হবে, যে-কোনো রূপের পাশে যে-কোনো রূপ বসানো চলবে না; আর আছে অনুমোদিত বাক্যের ও এই ছকগুলির পরস্পরের সম্বন্ধ ইত্যাদি।
কিন্তু যখনই আমরা ভাষা ব্যবহার করি, তখন আমরা অনেকগুলি একজাতীয় উপাদানের মধ্য থেকে একটি উপাদান বেছে নিই, অনেক দুটি সম্বন্ধের মধ্য থেকে দুটি উপাদানের একটা সম্বন্ধ বেছে নিই, বহু বিন্যাসের সম্ভাবনা থেকে একটি সম্ভাবনা বেছে নিই। আমাদের এই বেছে নেওয়ার কাজটা চলে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে, পারোলের ক্ষেত্রে। ফলে ভাষা ব্যবহারমাত্রেই একটা নির্বাচনের প্রসঙ্গ এসে যায়।
এই সাধারণ, অসচেতন বা প্রায়-অসচেতন নির্বাচনই কি শৈলী ? না কি শৈলী হল সচেতন নির্বাচন, তা বিশেষ একটা প্রতিক্রিয়া (effect বা ফরাসিতে valeur) তৈরি করার জন্য বিশেষ মনোযোগ দিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে ? নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনা করে আমরা সেই তর্কের মধ্যে প্রবেশ করব।
Leave a comment