আমরা শৈলীর আলোচনা করতে করতে হঠাৎ কবিতার শৈলীর আলোচনায় এসে পড়েছি, যদিও এ আমাদের লক্ষ্য ছিল না। প্রাথমিক ও সাধারণ শৈলীর ধারণাতেই আমরা আবদ্ধ ছিলাম। শৈলীর ওই ধারণার মূল ভিত্তি আমরা বলেছি নির্বাচন। এই নির্বাচন কেন, বা নির্বাচনের ফলে কী দাঁড়ায়, তার উত্তরে ফ্রিম্যানের ওই তিনটি তত্ত্বের উল্লেখ করা যেতে পারে-বিচ্যুতি বা deviation হল এক, recurrence or convergence of textual pattern হল দুই ; আর a particular exploitation of a grammar of possibilities হল দুই ; আর a particular exploitation of a grammar of possibilities হল তিন।

কিন্তু আমরা লক্ষ করি, এ তিনটিস সূত্রই বর্ণনাভিত্তিক, অর্থাৎ ব্যাপারগুলি বর্ণনা করে মাত্র, তার বেশি কিছুই বলে না। বলে না যে, বিচ্যুতি ঘটুক, রচনাবন্ধের পুনরাবর্তন সমন্বয়ই ঘটুক, বা ব্যাকরণ-সম্ভাবনায় সুনির্দিষ্ট সম্প্রয়োগই ঘটুক—তাতে কি ওই রচনা ‘সাহিত্যে হয়ে ওঠে ? উঠবেই, তার গ্যারান্টি কী ? আমি তো অনায়াসেই একটু কিম্ভুত ধরনের বাক্য রচনা করতে পারি, নানা ডিজাইনের পুনরাবৃত্তি-সমাহার দেখতে পারি, ব্যাকরণগত সম্ভাবনার প্রান্তিক সীমায় পৌঁছে নানা বিচিত্র প্রয়োগ উদ্ধার করতে পারি। তা কি আমার রচনাকে স্বতই সাহিত্যের পদবিতে পৌঁছে দেবে? ফ্রিম্যানের ত্রিধা শৈলীতত্ত্বের কোনোটিই প্রাথমিকভাবে এ প্রশ্নের উত্তর দেয় না। এ থেকে এও দাঁড়ায় না যে, এসবের মাত্রা বেশি হলে রচনা ‘বেশি করে সাহিত্য হবে, কম হলে রচনা ‘কম করে’ সাহিত্য হবে। অর্থাৎ ওইসব শাব্দিক কারুকৃতির সঙ্গে সাহিত্যতত্বের সমগা সম্পর্ক (Concommitant variation) নেই। অর্থাৎ আধুনিক শৈলীতত্ত্ব, যা অতিরিক্তরূপে ‘verbal device’ বা রচনার শাব্দিক বিন্যাসের (তাতে শব্দান্তর্গত ধ্বনির বিন্যাসও ধরে নেওয়া হয় হিসেবে) ওপরে নির্ভর করে, তা অ-ব্যাপ্ত (too-norrow), কারণ তা বলে না যে, এইসব ব্যাপারগুলো না ঘটলেই রচনা সাহিত্য হবে না। আবার তা নিশ্চয়ই অতি-ব্যপ্তিও (too-wide) বটে, কারণ এগুলি থাকলেই সাহিত্য হবে, তাও এরা বলতে পারে না। বস্তুতপক্ষে শোয়ার্টস (Schwartz, ১৯৭২ : ২৬-২৮) এমন কথাই বলতে চেয়েছেন রবার্ট ফ্রস্টের “স্টপিং বাই দ উজ্” কবিতাটির আলোচনা করে।

সাধারণভাবে সাহিত্যের ভাষার মধ্যে কবিতার ভাষার একটি বিশেষ চরিত্র তৈরি হয় সমস্ত দেশের সাহিত্যেই। শৈলীবিজ্ঞানীরা আমাদের জানান, তা নাকি ‘চূড়ান্তভাবে বিদ্যুত maximally deviant। রুশ আঙ্গিকবাদীরা প্রথম এই বিচ্যুতি-তত্ত্ব নির্মাণ ও ব্যাখ্যা করেছিলেন, তাঁদের সদস্য রোমান ইয়াকবসন কবিতাকে বলেছিলেন ‘organized violation of language”। কবিতার ভাষার এই ‘অসাধারণত্ব’ আমরা সকলেই লক্ষ করি, এ নিয়ে আমরা অন্যত্র আলোচনাও করেছি।

কিন্তু গদ্যসাহিত্যের ভাষাও তো নিশ্চয়ই আলাদা হয়ে যায় একটু। অন্তত দৈনন্দিন মুখের ভাষা থেকে? হার্ডার ও তাঁর জার্মান অনুরাগীদের অনুসরণ করে রুশ সমালোচক পোতে নিয়া দু’ধরনের ভাষিক ক্রিয়া নির্ধারণ করেছিলেন; কাব্যিক ভাষা, আর গদ্যধর্মী বা বিজ্ঞানের ভাষা। পরে রুশ সমালোচক ইয়াকুবিন্‌স্কি লেখকের উদ্দেশ্য অনুযায়ী ভাষাব্যবহারকে দুটি প্রধান প্রধান ভাগে ভাগ করেন—কাজের ভাষা (practical language)—যাতে ভাষার ধ্বনি, শব্দাংশ, পদ ইত্যাদির কোনো নিজস্ব মূল্য বা গুরুত্ব তৈরি হয় না, সেগুলি আলাদা করে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে না, আমরা বক্তব্য পৌঁছানোর বাহন হিসেবে সেগুলির উপস্থিতি উপেক্ষাই করি : আর একটি হল কাব্যিক ভাষা (poetic language), যাতে কেজো লক্ষ্য, অর্থাৎ তার মধ্য দিয়ে তথ্য, সংবাদ, জ্ঞান ইত্যাদি আহরণ—কিছুটা আড়ালে চলে যায়, ‘and language combinations acquire independent value”।

কেজো ভাষাই কি গদ্যের ভাষা, কাব্যিক ভাষাই কি কবিতার ভাষা ? তা কিন্তু এঁরা বলেন না। প্রথমে রুশ ও পরে তাঁদের চেক অবয়ববাদী অনুগামীদের আলোচনা থেকে আমরা লক্ষ করি যে, ভাষার নীচের কয়েকটি স্তর তাঁদের নজরে থাকছে—

  • ১. মুখের দৈনন্দিন কথ্যভাষা

  • ২. গদ্য ভাষা : কেজো গদ্য

  • ৩. গদ্য ভাষা : কাব্যিক গদ্য

  • ৪. কবিতার ভাষা (পদ্য)।

বলা বাহুল্য, এই স্তরগুলির মধ্যেও নানা ভাঁজ ও পরম্পরা থাকতে পারে, কিন্তু একথা বললে বোধহয় কারো আপত্তি হবে না যে, দৈনন্দিন কথ্যভাষার তুলনায় ২ ৩ ৪-এ ক্রমশ বেশি সংগঠিত, বিন্যস্ত ও পরিকল্পিত ভাষিক প্রয়োগ ঘটেছে। এবং কথ্যভাষার তুলনায় তারই ফলে বাকিগুলি বিচ্যুত (deviant)।

মুখের ভাষার সঙ্গে কাব্যিক বা সাহিত্যিক ভাষার তুলনা করেছেন চেক ভাষাবিজ্ঞানী ইয়ান মুকারোফস্কি (দ্র. ফ্রিমান, ১৯৭০ : ৪০-৫৬)। ঠিক মুখের ভাষার সঙ্গে নয়, মান্য চলিত বা স্ট্যান্ডার্ড ভাষার সঙ্গে। তিনি দেখিয়েছেন যে, মান্য চলিত ভাষা আর কাব্যভাষা দুয়ের ক্ষেত্র ও চরিত্র আলাদা, দ্বিতীয়টি প্রথমটির অন্তর্ভুক্ত নয়’, যদিও দুয়ের মধ্যে যোগ একেবারে অনুপস্থিতও নয়। এখানেও পাই সেই বিচ্যুতি তত্ত্ব, কিন্তু এখানে মুকারোফস্কি মনে করেন স্ট্যান্ডার্ড বা মান্য চলিত ভাষাই হল সেই তুলনীয় norm বা আদর্শ, যার সঙ্গে তুলনা করে কাব্যিক ভাষাকে সরে আসা ভাষা বলা চলে—the standard language is the background against which is reflected the esthetically intentional distortion of the linguistic components of the work, in other words, the intentional violation of the norm of the standard.৮ (ফ্রিম্যান, ১৯৭০ ৪২)। মান্য ভাষার systematic violation থেকেই কাব্যভাষার উৎপত্তি। মুকারোফ্‌স্কি অবশ্য কাব্যভাষা বলতে কবিতার ভাষাই বোঝাচ্ছেন। গদ্য, এমনকি কাব্যিক গদ্য সম্বন্ধে তাঁর কোনো মনোযোগ ও উল্লেখ আমরা লক্ষ করি না। তিনি বলেন চলিত ভাষার বোধ যত প্রবল হবে ততই কবিতায় ভাষাগত বিচার বা distortion-এর বিষয়টি পাঠকের কাছে স্পষ্ট হবে। দু-এর সম্পর্ক নেতিবাচক হলেও মান্যভাষা আর কাব্যভাষা উভয়ের বিবর্তনে যে পরস্পরের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে উভয়েই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে তা মুকারোফস্কি খেয়াল করেন। কিন্তু তাঁর মূল কথা থেকেই যায় যে, কবিতার ভাষা কথার ভাষা থেকে বেশ দূরবর্তী।

তাহলে কি ওই মান্য চলিত ভাষাই সেই আদর্শ, যা থেকে কবিতার ভাষাকে সরে আসতে হবে? বলা বার্তে ( Barthes, ১৯৭০: ৬-১০) বলেন এ ধারণা একই সঙ্গে অতি-ব্যাপ্ত ও অব্যাপ্ত—’excessive and insufficient’। কারণ তাঁর মতে মুখের ভাষাও ভাষার মূল আদলের হুবহু প্রতিফলন নয়, তারও শৈলী আছে—তা ভাষার বহু সম্ভাব্য প্রকারের (Code এর) একটিমাত্র প্রকার। বার্তে একটি উপমা প্রয়োগ করে এ বিষয়টা বোঝাতে চান। তাঁর মতে norm সন্ধান হল পেঁয়াজের শাঁস বা বীজ সন্ধানের মতো। একটি রচনার ভাষাকে অন্য যে-কোনো (রচনার) ভাষার সঙ্গে তুলনা করে তার দুরত্ব বা বিচ্যুতি বোঝানোর চেষ্টা করি না, কারণ দ্বিতীয় ভাষাটিও বিচ্যুত (deviant)। কাজেই পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ওই norm-এর আর দেখা পাওয়া যায় না। স্টাইলের ধারণার মধ্যে তাই এক ধরনের ভাঁজবিন্যাস (layeredness) আছে। তবু যদি তুলনা করতেই হয়, তুলনা করব রচনাটির (১) ‘নিকটতম প্রতিবেশী’-র সঙ্গে, (২) রচনাটির রূপদর্শ বা model-এর সঙ্গে। তোদোরভ (ওই : ৩০-৩১) আবার খুব ব্যাপক একটা জায়গায় আমাদের পৌঁছে দিয়ে বলেন, আদর্শ হতে পারে দৈনন্দিন ভাষা, আদর্শ হতে পারে সমস্ত কথ্য বা লিখিত ষা। কিন্তু এও কি একটা সম্ভব কথা ? তাই শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেবার মতো করে বলেন—‘It is unclear why we should speak of a norm; ordinary language is the meeting place of thousand norms, and thus ‘normless’ in the truest sense.

তোদোরভ্ পরক্ষণেই আবার দেখিয়ে দেন যে, জঁ কোয় (Jean Cohen) ফরাসি প্রতীকবাদী কবিদের কাব্যভাষার তুলনা করেছেন সমসাময়িক পণ্ডিতদের গদ্যভাষার সঙ্গে। দুয়ের তফাত অবশ্যই খুব স্পষ্ট—কিন্তু এক একটাকে norm বলার যুক্তি কী?

কিন্তু কবিতার ভাষা যে বিশেষভাবে বিচ্যুত তা তো বিশেষ করেই চোখে পড়ে আমাদের। তোদোরভ্ স্যামুয়েল লেভিনের বিভাজন উদ্ধৃত করেন যে, বিচ্যুতি দু’ধরনের—গুণগত (ব্যাকরণ বিচ্যুতি), আর মাত্রাগত (উপাদান বিন্যাসর ঘনত্ব বা বিস্তার)। কিন্তু তবু কীসের থেকে বিচ্যুতি তা স্পষ্ট হয় না, এবং শেষ পর্যন্ত ১৯১৭-এর এই সিম্পোসিয়াম (চ্যাটম্যান, ১৯৭১) তোদোরভের নিবন্ধের আলোচনায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় যে, “(the) present conceptions of norm were neither rational nor feasible…it was not clear how the norm was established.” (ওই : ৪০)।