আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানীদের অভিমত হল, প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যেই এমন এক ‘যোগ্যতা’ আছে যার ফলে তিনি তাঁর ভাষায় কথিত বা অকথিত সীমাহীন বাক্য বুঝতে পারেন এবং সেটাই তাঁকে ক্ষমতা জোগায় বলার। এই যোগ্যতার ভিত্তি হল, সেই ভাষার গঠনপ্রকৃতি বা ব্যাকরণ সম্বন্ধে তাঁর সহজাত ধারণা। কিন্তু ভাষা বিজ্ঞানের কাজ যদি সাহিত্যের ভাষাকে শুধু বর্ণনা মূলক পদ্ধতিতে বস্তুনিষ্ট ভাবে বিশ্লেষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে তা যান্ত্রিক ভাবে অতিক্রম করে সাহিত্য সমালোচনাকে গভীরতা দান করার মতো সহায়কের ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে না। তাই রোজার ফাউলার সাহিত্যিক শৈলীবিজ্ঞানকে ভাষাবিজ্ঞানের বিষয় থেকে স্বতন্ত্র করার জন্যে ‘Stylistics’-এর পরিবর্তে তাঁর গ্রন্থের নাম রেখেছেন—Linguistic Criticism শৈলীবিজ্ঞান অর্থাৎ ভাষাবিজ্ঞান ভিত্তিক সাহিত্য ভাষা বিশ্লেষণ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হল—“Here, the linguistic study of literary texts means, not just the study of language, but study of the language utilizing the concepts and methods of modern linguistics.”
এবং সাহিত্যের শৈলীর আলোচনার পদ্ধতিকে তুমি কেবল ধ্বনিতত্ত্ব, শব্দতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি।
বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞান ভাষার নুন্যতম একক হিসেবে ‘বাক্য’-কে গ্রহণ করে বাক্যেরই গঠন প্রকৃতিকে বস্তুনিষ্ট করে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে বলে এবং উচ্চারণের নূন্যতম এক ‘ধ্বনি’ বলে, তার আলোচনা সীমাবদ্ধ থেকেছে ধ্বনিতত্ত্ব ও ধ্বনি বিজ্ঞান, রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্বের মধ্যেই। কিন্তু মানুষ মাত্রেই ভাষা ব্যবহার করেন পরস্পরের মধ্যেই সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। আর একটি মাত্র বাক্য ব্যবহারের মধ্যেই সে সম্পর্ক স্থাপিত হয় না। একই ভাষাকে কী সমাজে, কী সাহিত্যে, ভাষা ব্যবহারকারী নিরপেক্ষ ভাবে যেমন পূর্ণাঙ্গরূপে বিচার করা যায় না, তেমনি বাক্য বিশেষকে পারম্পর্য রহিত ভাবে বিচার করাও বিজ্ঞানসম্মত হবে না, এটা হল সাহিত্যিক শৈলী বিশ্লেষণের পদ্ধতিগত ব্যাপারের প্রাথমিক দিক। পদ্ধতিমাত্রই হচ্ছে নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্যে পৌঁছোবার উপায় মাত্র। অর্থাৎ পদ্ধতির অন্য নিরপেক্ষ কোনো অস্তিত্ব নেই। এখানে ভাষার গঠনগত উপাদানগুলিকে বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করে ভাষার স্বরূপ উদ্ঘাটন করার লক্ষ্য। তবে সামাজিক ভাষা ব্যবহারকে বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করার ইচ্ছে শৈলীবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য।
সাহিত্যের অনুশীলন ও অভ্যাসের মধ্য দিয়ে ‘Competent reader’ এর মধ্যে যে শৈলিক স্বজ্ঞার ক্ষমতা গড়ে ওঠে, তার ফলে তিনি যখন কোনো কবিতা বা সাহিত্য কর্ম বিশেষ পাঠ করে প্রাথমিক একটা সিদ্ধান্ত উপনীত হন, তখন তার সমর্থন যদি ভাষা বিজ্ঞানসম্মতভাবে তার ভাষাভিত্তি দেহকে বিশ্লেষণের মধ্যে পান, তবেই তার স্বজ্ঞাপ্রসূত সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে গ্রহণ করা যেতে পারে। নচেৎ তাঁর পূর্ব সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে বিশ্লেষণ লব্ধ তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে।
ফাউলালের বক্তব্য থেকে জানা যায়, সাহিত্য কর্মের ভাষা বিশ্লেষণের ভাষাবিজ্ঞানের প্রথাসম্মত শিশুর অর্থাৎ ধ্বনিতত্ত্ব, ধ্বনি বিজ্ঞান, অর্থতত্ত্ব এবং বাক্যতত্ত্বের আলোচনাই পর্যাপ্ত নয়, বাক্যবদ্ধ ব্যাকরণ এবং ভাষা ব্যবহার তত্ত্ব এরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। আলোচনার সুবিধার জন্য যদিও এই স্তরগুলিকে পৃথক পৃথক ভাবে ভাগ করে দেখানো হয়ে থাকে, তবু মনে রাখা দরকার যে, ভাষা ব্যবস্থার কালে এদের কোনো একটাই বিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে না। তাই শৈলীবিজ্ঞানের পদ্ধতি অনুসারে আলোচনাকালে বিশেষ কোনো একটা প্রসঙ্গে অন্যটাও এসে যেতে পারে।
ভাষাবিজ্ঞান ভাষা ব্যবহারের বৈশিষ্ট্য নিরূপণকালে আর একটি বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে থাকে তথ্যগুলিকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পর্যবেক্ষণের জন্যে। সেই বিজ্ঞানটি হল ‘সংখ্যাবিজ্ঞান’ (Statistics)। সাহিত্য কর্ম বিশেষের ভাষা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও সংজ্ঞাবিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূ মিকা গ্রহণ করে। এ প্রসঙ্গে টার্নার বলেছেন— “Idealy the Critic using these methods should have the sensitivity to literature that any critic must have, combind with a through knowledge of linguistics and an equally Sound Knowledge of Mathematics.”
সাহিত্য সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত শৈলীবিজ্ঞান সম্পর্কে যা যা আলোচনা সাপেক্ষ সমস্তই ভাষা বিশেষ নিরপেক্ষ। তবে একথাও বলতে হয়, শৈলীবিজ্ঞানকে তার প্রকৃত উদ্দেশ্যের পথে পরিচালিত করতে হলে শৈলীবিজ্ঞানের একদিকে যেমন ভাষাবিজ্ঞান সম্পর্কে নিবিড় জ্ঞান থাকা দরকার, তেমনি অন্যদিকে থাকা দরকার গভীর সাহিত্যবোধ। সেইজন্য বোধ হয় ভারতীয় অলংকারশাস্ত্রীরা শুধুমাত্র ভাষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে বৈয়াকরণকে সাহিত্য বিচারক হিসেবে মেনে নিতে পরাম্মুখ।
Leave a comment